মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৩

মে দিবস পালন এখন ফ্যাশানে পরিণত হয়েছে


মে দিবস পালন এখন ফ্যাশানে পরিণত হয়েছে

 নুরুল্লাহ মাসুম

ইতিহাসের যে বাঁকে আমেরিকার শ্রমজীবী মানুষেরা মে দিবসের আলোকবর্তিকা জ্বেলেছিলেন, আজকের বাংলাদেশ ও উন্নয়নশীল বিশ্ব তেমনি এক সন্ধিক্ষণের মধ্য দিয়ে পার হচ্ছেদুনিয়ার মজদুর এক হও’  স্লোগান দেয়ার দিন পহেলা মেবিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশের এক ঐতিহাসিক গৌরবময় দিনআন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করা হলেও মে দিবসনামেই অধিক পরিচিতি লাভ করেছে দিনটিএদিন শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিনমে দিবস শ্রমিকদের একটি বড় বিজয়রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রমিকেরা বিজয়ের ইতিহাস রচনা করেছেদিন বদল হয়েছে, উন্নত প্রযুক্তির আশীর্বাদে পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়তবে দিন বদলের ছোঁয়া লাগেনি শ্রমিকদের জীবনেফলে দেখা যায় আবারও বঞ্চনা, বৈষম্য, শোষণ প্রতিনিয়ত তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে
বর্তমানে সমগ্র বিশ্বের মত আমাদের দেশেও মে দিবস পালন করাটা ফ্যাশানে পরিণত হয়েছেমালিকপক্ষ অবশ্য বলতে পারেন, শ্রমিকরা এ দিনটিতে ছুটিতো পাচ্ছেহ্যা, সরকার দিনটিকে সরকারী ছুটি হিসেবে ঘোষণা করেছেএ দিনটিতে রাষ্ট্রপতি, সরকার প্রধান ও সংসদের বিরোধী দলের প্রধানও বাণী দিয়ে থাকেনশ্রম মন্ত্রণালয় আয়োজন করে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানমালাবিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুর শ্রমিক সংগঠনগুলো  বর্নাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করে থাকেশ্রমিকরা (অবশ্যই কিছু সংখ্যক) নেচে-গেয়ে কিছু সময় আনন্দ করেসহযোগী সংগঠন বা অঙ্গ সংগঠন যে নামেই হোক, কিছু শ্রমিক সংগঠন থাকলেও সেগুলো প্রকৃত শ্রমিকের প্রতিনিধিত্ব করে কি না তা শ্রমিকরাই বাল জানেনএ দনিটিতে প্রচার মাধ্যমগুলোর আয়োজনও থাকে চোখে পড়ার মত।  তবে প্রকৃতার্থে মে দিবসের আর্জন কতখানি, শ্রমিকরা তা অনুধাবন করতে পারছে, বিশেষত পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা সব চেয়ে বেশী বুঝতে পারছেমে দিবস তাদের কষ্ট বাড়িয়েছে বই কমায় নিনা জেনে গাধার মত খাটতে যতটা না কষ্ট, সুযোগের কথা জেনে সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কষ্ট অনেক বেশীসে কথা লিখে কি আর বোঝানো যাবে?
শ্রমিকের দাবী আদায়ের লক্ষ্যে দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবিতে বিশ্বের প্রথম শ্রমিক ধর্মঘট হয়েছিল অবিভক্ত বঙ্গে১৮৬২ সালের মে মাসে অর্থা শিকাগোর ঘটনার ২৪ বছর আগেঐ ধর্মঘট ডেকেছিলেন রেলওয়ে শ্রমিকরারেলওয়ের বিভিন্ন বিভাগের শ্রমিকদের মধ্যে কর্মঘন্টা বিভাজন ছিলএ নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়হাওড়া স্টেশনের সহস্রাধিক রেল শ্রমিক দশ ঘন্টার বদলে আটঘন্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘট করেছিলঐ ধর্মঘটের সংবাদ ছাপা হয়েছিল ৫ মে, ১৮৫২, বাংলা ২৩ বৈশাখ ১২৬৯ সনে প্রকাশিত দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত সাপ্তাহিক সোম প্রকাশপত্রিকায়বিবিধ সংবাদশিরোণামে পত্রিকাটির ৩০৫ পৃষ্ঠায় ধর্মঘটের খবর ছাপা হয়ঐ সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘সম্প্রতি হাবড়ার রেইলওয়ে স্টেশনে প্রায় ১২০০ মজুর কর্মত্যাগ করিয়াছেতাহারা বলে লোকোমোটিব (গাড়ি) ডিপার্টমেন্টের মজুরেরা প্রত্যহ আটঘন্টা কাজ করেকিন্তু তাহাদিগকে দশঘন্টা পরিশ্রম করিতে হয়কয়েক দিবসাবধি কার্য্য স্থগিত রহিয়াছেরেইলওয়ে কোম্পানি মজুরদিগের প্রার্থনা পরিপূর্ণ করুন; নচে লোক পাইবেন নাঐ ধর্মঘট এখনো বিশ্বের প্রথম সংগঠিত ধর্মঘট হিসেবে চিহ্নিতসেই  পথ ধরেই বুঝি ইউরোপ, আমেরিকায় শ্রমিক শ্রেণী অধিকার রক্ষার আন্দোলনে এগিয়ে গিয়েছিলএ যেন আজ বাংলা যা ভাবে, কাল বিশ্ব তা ভাবেঅবশ্য রেল ধর্মঘটের আগে এদেশেই ১৮২৩ সনে পালকির বেহারারা কর্মবিরতি পালন করেছিল; যা নাড়া দিয়েছিল ইংরেজ শাসককেধর্মঘট আরো একটি হয়েছিল ১৮৩৫ সালেনদী পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত মালবাহকরা ধর্মঘট করেছিলএর প্রভাব পরেছিল পণ্যের মূল্যে সে আমলেতবে ঐ দুটি ধর্মঘট কোন সংগঠিত ধর্মঘট ছিল নাসংগঠিত ক্ষেত্রের আধুনিক শিল্প শ্রমিকদের কাজের ঘন্টা কমানোর দাবিতে আন্দোলনের প্রথম নথিভূক্ত ঘটনা এই রেল শ্রমিক ধর্মঘট
বাংলার রেল ধর্মঘটের ৪ বছর পর ১৮৬৬ সালে বাল্টিমোড়ে ৬০টি ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা একজোট হয়ে কাজের দিন ৮ ঘন্টায় নামিয়ে আনার দাবিতে প্রভাাব নেয়তারপর দাবি আদায়ে শুরহয় আন্দোলনমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তখন বিকশিত হচ্ছে ফোর্ড-রকফেলারদের সাম্রাজ্যএর পরের ইতিহাস সকলের জানা
পয়লা মে, ১৮৮৬শনিবারস্বাভাবিক কাজের দিনশ্রমিকরা কারখানায় যাবার পরিবর্তে নেমে আসে রাজপথে, কারখানার চাকা বন্ধশ্রমিকরা চলছে মিশিগান এভিনিউর মিছিলে যোগ দিতেআট ঘন্টা জুতো পায়েদিয়ে, ‘আট ঘন্টা চুরুটমুখে তাদেরমিছিল গিয়ে শেষ হলো লেকফ্রন্টেদাবি আদায়ের কথা উঠে এলো ভাষণেসুনসান সমাবেশকোথাও কোন গোলমাল নেইযে যার বাড়ি ফিরে গেল, পরদিন রোববার ছুটির দিনসোমবারও চলে ধর্মঘটম্যাককর্মিক হার্ভেস্টার ওয়ার্কসের শ্রমিকরা ধর্মঘট ভাঙতে আসা ঠ্যাঙারদের মোকাবেলা করতে গেলে পুলিশ গুলি চালায়ছয়জন শ্রমিক নিহত হয় ঘটনাস্থলেইপরদিন প্রতিবাদ সভা হে মার্কেট স্কয়ারেআকষ্মিকভাবে পুলিশ এসে সমাবেশ বন্ধ করার নির্দেশ দেয়সমাবেশের ভীড়ে তখন আত্মগোপনকারী অন্তর্ঘাতকরা, ছুঁড়ে দিল বোমাপ্রচন্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে চারদিকএকদিকে বোমায় আহত মানুষ, অন্যদিকে পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে সমাবেশে উপস্থিত শ্রমিকদের উপর
১২৫ বছর আগে ১৮৮৬ সালে শ্রমজীবি মানুষ সেদিন স্পষ্ট করেছিল, অত্যাচার করে কখনো কাউকেই খুব বেশিদিন দাবিয়ে রাখা যায় নামানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে নাশ্রমের বিনিময়ে ন্যায্য মজুরি পাবার অধিকার সব শ্রমিকই রাখেশ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগে তার পাওনা পরিশোধ করার কথাতো সেই চৌদ্দশ বছর আগেই বলা হয়েছেতারপরও কি বলা যাবে পূরণ হয়েছে সে সব? কিংবা ভাগ্যের হেরফের ঘটেছে তেমন? তবে কি এক নিগড় থেকে আরেক নিগড়ে পৌঁছা? এটাতো সত্যিই ক্রীতদাসের জীবন থেকে বেরিয়ে আসা; রক্ত ঢেলে দিয়ে শ্রমজীবির শ্রমের কর্ম সময় আটঘন্টা নির্ধারণ করতে পারা, সে এক যুগাš—কারী ঘটনা অবশ্যইআর এই যে অর্জন, তা অনুপ্রাণিত করেছে বৈকি, বিশ্বের শ্রমজীবি মানুষকে যার যার পরিধিতে
১২৬ বছর আগের সেদিনে যে অধিকার অর্জিত হয়েছিল; যে সংহতির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল, সময়ের পরম্পরায় নানা আবর্তন-বিবর্তনে বিষয়গুলো স্বস্থানে থাকেনিসচেতনভাবে সংহতির চেতনায় উদীপ্ত হয় কজন শ্রমিক আর? শিল্প শ্রমিকদের রয়েছে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারসেসব নিয়েও আছে নানা প্রশ্নইতিহাসের যে বাঁকে আমেরিকার শ্রমজীবী মানুষেরা মে দিনের আলোকবর্তিকা জ্বেলেছিলেন, আজকের বাংলাদেশ ও উন্নয়নশীল বিশ্ব তেমনি এক সন্ধিক্ষণের মধ্য দিয়ে পার হচ্ছে
বর্তমানে আমাদের দেশে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি, যাদের প্রতিদিনের উপার্জনে প্রতিদিন চলেঅধিকাংশ ক্ষেত্রে এ মজুরি উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় নির্ধারিত দারিদ্র্য সীমার নিচেইতিমধ্যে সরকার দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে যে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছেএসকল পদক্ষেপের সুফল ৫ কোটি মজুরি শ্রমিকের কাছে পৌঁছবে কীভাবে, তা ভাবতে হবে? যেখানে সরকারের নির্ধারিত মজুরিই একজন মানুষকে বাধ্য করছে দাারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতেঅধিকাংশ শিল্পখাতে শ্রমিকের জন্য মজুরির কোনো নির্ধারিত মাশ্রন্ডই নেই, সেখানে শ্রমজীবী মানুষ কীভাবে দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করবে? কীভাবে গার্মেন্টস শ্রমিক তার বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাবে? ৫ কোটি পরিবারকে দরিদ্র্যসীমার নিচে রেখে দারিদ্র্য বিমোচনে কতোখানি সাফল্যের মুখ দেখবে? এ প্রশ্নগুলো আজ ভাবতে হবেতাই মজুরির প্রশ্ন আজ কেবল শ্রমিক বা তার পরিবারের কোনো স্বতন্ত্র বিষয় নয়এর আন্ত:সম্পর্ক অনেক ব্যাপক ও গভীরএকে শুধু শ্রমিকের সঙ্গে বা ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখলে চলবে নাএকে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখতে হবেবাংলাদেশের ভবিষ্য লক্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখতে হবে
ন্যায্য মজুরি না পেলে বা মজুরিই আদৌ না পেলে, ছুটি না পেলে, কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হলে এদের নালিশ করার কোনো জায়গা নেইঅনেক ক্ষেত্রে আইন তাদের নালিশ করার অধিকার দেয়নিআবার অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে কোনো নির্দিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ নেই যেখানে এ অসহায় শ্রমিক যেতে পারেআশ্চর্য হলেও সত্য, একজন নারী শ্রমিক স্ত্রী হিসেবে স্বমীর বিরুদ্ধে দেনমোহর না দেওয়া বা নির্যাতনের জন্য মামলা করতে পারেসেই নারী শ্রমিককে তার মালিক যদি কাজ করিয়ে মজুরি না দেয় বা ঠিক সময় মজুরি পরিশোধ না করে অথবা কাজ করতে গিয়ে কারখানার অব্যবস্থাপনার জন্য সে আহত হয় তাহলে ঐ নারী শ্রমিকের নালিশ জানাবার কোনো জায়গা নেইপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে কর্মরত কিছু সংখ্যক শ্রমিক ব্যতীত দেশের কোটি কোটি নারী ও পুরুষ শ্রমিকের ক্ষেত্রে আজ এ কথা প্রযোজ্য
মে দিবস পালন যাতে ফ্যাশন থেকে সত্যিকার অর্থে শ্রমিকের দাবী আদায়ের দিনে পরিণত হয়, শ্রমিক যেন ন্যায্য মজুরী পায়, সরকার ঘোষিত ছুটি পায়, নারী শ্যমিকরা যাতে তাদের পাওনা ঠিকমত পেতে পারে; সে সব দিকে সরকার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় একটু নজর দিলে বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক পেতে পারে সত্যিকারের মে দিবসের ফসল

বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৩

শবের মিছিল আর কত দীর্ঘ হলে আমরা মানুষ হবো?: এত মৃত্যুর দায়ভার কে নেবে

শবের মিছিল আর কত দীর্ঘ হলে আমরা মানুষ হবো?

এত মৃত্যুর দায়ভার কে নেবে

নুরুল্লাহ মাসুম

আবারো লাশের মিছিল! এক, দুই, তিন নয় শত শতলাশের প্রাথমিক আবাস হয় এনাম মেডিকেলের লাশ ঘরে, তারপরে হাসপাতালের ওয়ার্ডে, তারও পরে বরান্দায়- সবশেষে গ্যারেজেনা, তাতেও কুলোয়নিহাসপাতালের গন্ডি ছাড়িয়ে লাশদের জায়গা হয় পার্শবর্তী অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ের বারান্দায়সব জায়গাতেই লাশের উত্তরাধিকারদরে আহাজারি, আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়; চোখে জল আসে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী সেনা সদস্যদেরও- তারাওতো মানুষদমকল বাহিনীর সদস্যরা হামেসাই এমন দৃশ্য দেখে তাকে, বরা যায় লাশ আর ধ্বংসস্তুপের মাঝেই তাদের বসবাস
একবার মনে হচ্ছিল, প্রয়াত অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর কবরনাটকে যেভাবে লাশের আগমন ঘটে, সেই বর্ণনার সাথে তুল্যমান হতে পারে; ভেবে দেখলাম মুনীর চৌধুরী হয়তো ভাবতেও পারতেন না, এভাবে লাশের মিছিল হতে পারেতাঁর ভাবনার একটা গন্ডি ছিল- দুই, চার, ছয়....বাস্তবে বুধবার দেশবাসী যা দেখলো তা মুনীর চৌধুরীর সেই ভাবনা ছাপিয়ে, এমনকি স্মৃতিতে এখনো উজ্জল আশুলিয়ার তাজরিন গার্মন্টেসের লাশের মিছিলকেও ছাড়িয়ে গেল এবারেএ নিবন্ধ যখন লেখা হচ্ছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা আটটা পর্যন্ত সাভারের রানা প্লাজা ধ্বসের কারণে মৃতের সংখ্যা ২৩০ জনভবনে আটকে থাকা দুই হাজার জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে
ঢাকার অদূরে সাভারে রানা প্লাজা নামের আট তলা ঐ ভবনের তৃতীয় তলার নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেড, চতুর্থ তলার প্যান্টম এ্যাপারেলস লিমিটেড, পঞ্চম তলার প্যান্টম ট্যাক লিমিটেড ও ষষ্ঠ তলার ঈথার টেক্সটাইল লিমিটেডে পাঁচ থেকে ছয় হাজার শ্রমিক কাজ করতো বলে জানা গেছেনীচের তলা গুলোয় ব্যাংক ও মার্কেট ছিলহরতাল তাকায় মার্কেট ছিল বন্ধ, না হলে হতাহতের সংখ্যা আরো বাড়তোভবনটিতে আগেই ফাটল দেখা দেয়ায় ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়প্রকৌশলীদের নিষেধাজ্ঞা সত্তে¡ও ভবন মালিকের আশ্বাসে গার্মেন্ট মালিকরা কারখানা খোলা রাখেধ্বংসযজ্ঞের ভেতর থেকে উদ্ধার পাওয়া আহত কর্মীরা জানিয়েছেন প্রকাশ্যে- কারখানার মালিকপক্ষের লোকজন জোর করে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করেশ্রমিকরাও জানতো ভবণে ফাটল ধরার কথাকারখানা মালিকদের আশ্বাস দিয়েছিলেন ভবনের মালিক, স্থানীয় যুবলীগ নেতাফাটল আসলে ভবনে নয়, পলেস্তায়- এমন কথা তিনি বেসরকারী টেলিভিশন ক্যামেরার সামনেই বলেছেন
খবরে প্রকাশ, ভবন মালিকও দুর্ঘটনার সময় ভবনের নীচ তলাতে অবস্থান করছিলেনএ সংক্রান্ত পত্রিকার খবর এমন- বুধবার সাভারের বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বহুতল ভবন রানা প্লাজার মালিক স্থানীয় যুবলীগ নেতা মো. সোহেল রানাও ভবনটি ধ্বসের সময় নিচতলা ছিলেনজনতার রোষানলে পড়ার ভয়ে তিনি বের হতে না পেরে স্থানীয় সাংসদসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের খবর দেনপরে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সাংসদ তৌহিদ জং মুরাদ ঘটনাস্থলে গিয়ে ভবন মালিক রানাকে বের করে নিয়ে যানভবন ধ্বসে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটলেও সোহেল রানা আঘাত পাননি বলে জানান ঘটনাস্থলে রানার সঙ্গে থাকা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এডভোকেট মাসুদ চৌধুরী
মঙ্গলবার বিকেলেই ভবনটিতে বড় ধরণের ফাটল দেখা দিলে ভবন মালিক সাভার পৌর যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক মো. সোহেল রানা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ভবনের বড় ধরনের কোন তি হয়নিসামান্য একটু প্লাস্টার খসে পড়েছেএটা তেমন কিছু নাযদিও স্থানীয় প্রকৌশলী আব্দুর রাজ্জাক ভবন ঘুরে দেখে বলেছিলেন, ভবনের নিরাপত্তার স্বার্থে বুয়েট থেকে প্রকৌশলী এনে পরীক্ষা করা প্রয়োজন, তা না হলে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারেবুধবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে নয় তলা ভবনটি ধসে পড়ে বহু মানুষ হতাহত হয়ওই ভবনে চারটি তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে, যেখানে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক কাজ করেধ্বসের সময় কারাখানায় কাজ চলছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম বলছে, ভবনটি নির্মান করা হয়েছিল একটি পুকুর ভরাট করেএমনও শোন গেছে ভবনটির নকশা অনুমোদন করেছে সাভার পৌরসভারাজউক বলছে তাদের অনুমতি না নিয়েই পৌরসভা ভবনটির নকশার অনুমোদন দিয়েছেসংগত কারণে ধরে নেয়া যায়, অনুমোদন দেয়ার আগে পৌরসভার প্রকৌশলী সয়েল টেস্ট করেননি যথাযথভাবেঅথবা এমনও হতে পারে, রাজনৈতিক চাপের কারণে পৌরসভারও হয়তবা তেমন কিছু করার ছিলনাকারণ যা হোক, ভবন মালিক এ দুর্ঘটনার দায় এড়াতে পারেন নাতেমনি সাভার পৌর কর্তৃপক্ষ এবং এমনকি রাজউকও এর দায়িত্ব এড়াতে পারে নারাজধানীর এতকাছে, গুরুত্বপূর্ণ শিল্প এলাকা সাভার, সেখানে ভবন নির্মানে তাদের কোন দায়িত্ব নেই এমনাটাতে ভাবা যায় নাএমনও শোন যাচ্ছে, ভবন মালিক নাকি বলেছেন, একটা পিলার ফাটলে কিছু হয় নাপ্রকৌশলীদের চেয়ে তিনি বেশী বুঝেছিলেন বলেই এমন দুর্ঘটনা
শ্রমিকদের আপত্তির মুখেও তাদের জোর করে, কারো কারো ভাষ্যমতে পিটিয়ে কাজে যোগদানে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়ার জন্য কারখানার মালিকরাও দায়ী; তাদেরকে সকলের আগে বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করাতে হবেভবন মালিক ক্ষমতাসীন দলের বলেই নিয়ম ভেঙ্গে চাঁচ তরা ফাউন্ডেশনে আট তলা নির্মান করবেন, এটাও কি মেনে নেয়ো যায়? বিল্ডিং কোড না মানলে যে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, এমন উদাহরণ আমাদের সামনে অনেক রয়েছেমালিকরা হয়ত বীমার টাকায় উদ্ধার পেয়ে যান, কিন্তু অভাগা এই শ্রমিকরা- তারা কি একরে পর এক জীবন দিয়েই যাবে? তারা কি ক্রমাগত সংবাদ মাধ্যমের লিড নিউজ হয়ে থাকবে?
যে কোন জরুরী প্রয়োজনে উদ্ধার কার্যে সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন স্থানীয় জনসাধারণসাভারের এবারের ভয়াবহতম দুর্ঘটনায়ও তাই ঘটেছেআশেপাশের সাধারণ মানুষ নিজ নিজ সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন উদ্ধার কাজ চালাতেপরে যোগ দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস, সেনা বাহিনী, নৌ বাহিনীসহ অন্যান্য সরকারী বিভাগদেশবাসী ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে দেখেছন, উদ্ধারকাজে ধীরগতি এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমš^হীনতার বিষয়টিআমাদের দেশের সরকারী সংস্থায় যারা কাজ করেন তারা হয়তো অসাধারণ মানুষ, তাই সাভারে উদ্ধার কাজে নিয়োজিত সেনা সদস্যদের মতো তাদের চোখে হয়তো পানি আসে নাতাই অবস্থাটা এমন- দেখি না কি হয়
দেশের যে কোন বিপদে সাধারণ মানুষ সবার আগে- এটা আবারো প্রমানিত হলইন্টারনেটে কয়েকটি পোস্টের মধ্যদিয়ে দ্রুত শুরু হয়ে যায় শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের রক্ত সংগ্রহ অভিযানজানা গেছ কেবল গণজাগরণ মঞ্চ থেকেই পাঁচ সস্রাধিক ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ হয়েছে বুধবার রাত আটটার মধ্যেরক্ত সংগ্রহ করেছে বিরোধী দল বিএনপি- দলীয় কার্যালয়ের সামনেরক্ত দিয়েছে স্কাউটরাও- রেড ক্রিসেনট সোসাইটিতেদুর্ঘটনাস্থলেও স্কাউটরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেসাধারণ মানুষের রক্ত দেবার এ মহৎ কাজে হাজার হাজার তরুণ অগ্রগামী, অন্তত শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ চত্তরে মানুষের ভীরে তাই মনে হয়েছে
বিরোধী দল দেরিতে হলেও হরতাল তুলে নিয়েছে, সে জন্য সংসদে দাড়িয়ে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলকে ধন্যবাদ জানিয়েছেনআমার জানতে ইচ্ছে করে, দুর্ঘটনা ঘটলো সকালে- হরতাল প্রত্যাহারে বিরোধী দলের এত বিলম্ব হলো কেন? তারা কি পারতো না তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্তে অবিলম্বে হরতাল কর্মসূচী প্রত্যাহার করে নিতে? যদি তাই হতো, সাধারণ মানুষের আস্থা তাদের প্রতি বাড়তো বই কমতো না
দুর্ঘটনার পরে ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই সেখানে গেছেনগেছেন  বিরোধী দলের নেতাসহ অনেকে নেতাঅনেকের কথার মাঝে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কথাটা প্রনিধান যোগ্য, যদিও তিনি কথাটা বলেছেন মুন্সীগঞ্জে গিয়ে- পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদটি এমনতরে:  সাভার ট্র্যাজেডিকে মানবতাবিরোধী অপরাধ আখ্যায়িত করে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার করার দাবি জানিয়েছেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরতিনি বৃহস্পতিবার সকালে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ঘাটে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ পরিদর্শনের আগে মাওয়া সার্কিট হাউসে সাংবাদিকেদের এ কথা বলেনএ সময় তিনি আরো বলেন, সেখানে নিরীহ শ্রমিকদের জোর করে কাজে পাঠিয়ে তাদের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে, এটাকে আমি আরেক রকমের মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে মনে করিবিষয়টা এখন দিবালোকের মতো পরিষ্কার, নড়বড়ে একটা ভিত্তির ওপর নয়তলা বিল্ডিং করা হয়েছেযারা অপরাধ করেছে তদন্ত কাজের নামে তাদের বিচারকে বিলম্বিত করার কোনো মানে হয় নাএ ধরণের তদন্তের ওপর দেশের মানুষের খুব একটা আস্থা এখন নেইসাভারের ঘটনাকে তিনি সতর্কবার্তা হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, দেশে মাঝারি আকারের ভূমিকম্প হলে দেশ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে সাভার ট্রাজেডি নিয়ে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য এখানে উল্লেখ না করাই ভালতবে সাধারণ মানুষ বলছেন, যদি গুটি কয়েক পিকেটারের ধাক্কায় আটতলা ভবন ভেঙ্গে যায়, তবে সেই সব পিকেটারদরে জাতীয় সম্মাননা দেয়া হোক- কেননা, তারা জাতির গর্ব হতে পারে, তাদের দিয়ে অনেক শক্ত কাজ করানো যেতে পারে
গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সংশ্লিষ্ট পাঁচ কারখানার সদস্যপদ স্থগিত করেছে বলেও জানা গেলমামলাও হয়েছে একাধিকসরকারী নিয়মে তদন্ত কমিটিও হয়েছে; তবে কমিটির রিপোর্ট আদৌ কোনদিন প্রকাশ পাবে কি না, পেলেও দোষীরা রাজনৈতিক কারণে পার পেয়ে যাবে কি না, তা ভবিষ্যতই বলতে পারে
আশুলিয়ার তাজরিন গার্মেন্টস দুর্ঘটনার ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই সাভারের এ ঘটনা, এতেও যদি দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের হুশ ফিরে না আসে, তবে বলতেই হবে একবিংশ শতকের অগ্রসরমান এ জগতে বসবাসের যোগ্য নই আমরাআমাদের নতুন করে ভাবতে হবে অগ্রসরমান দুনিয়ার বাসিন্দা হতে হলে প্রয়োজন নতুন প্রজন্মের নতুন নেতৃত্বধুয়ে মুছে সাফ করতে হবে পুরাতনের ধ্যান ধারণা
আমরা দেশবাসীর সাথে একমত হয়ে বলতে চাই, এ জাতীয় দুর্ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের প্রকৃতার্থে বিচার হতে হবে, দিতে হবে কঠোর শাস্তি, নইলে দেশে এ শবে মিছিল থামবে না, দিনে দিনে জাতীয় শোক দিবসের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে, যা আমরা আর দেখতে চাই না


বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৩

আষাঢ়ের শুক্লপক্ষ


নুরুল্লাহ মাসুম


প্রায় ফাঁকা মানিক মিয়া অ্যাভিন্যুর পূর্ব প্রান্তে রিক্সা থেকে নামে সুজনভাড়া মিটিয়ে দিয়ে খামার বাড়ির পশ্চিম প্রান্তে বা খেজুর বাগানের দক্ষিণ প্রান্তে অথবা সংসদ ভবনের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে দাঁড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেট থেকে একশলা সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগায়দেশলাই খুঁজতে গিয়ে ঝামেলা হয়প্যান্টে গোটা চারেক পকেট থাকলেও কোথায়ও দেশলাই পেল না সেবুক পকেটে হাত দিতে গিয়ে মনে মনে একচোট হেসে নেয়- গায়ে টি-শার্ট- পকেট থাকবে কি করে! বুঝলো, বেটা দেশলাই কখন হয়তো গলে বেরিয়ে গেছে পকেট থেকে- কোরবানীর এই দিনে সুজনের পকেটে নিঃস্পৃহ হয়ে থাকাটা ওর হয়ত ভাল লাগেনি
অন্যান্য দিনের মত গলায় গামছা জাতীয় কিছু দিয়ে ঝুলিয়ে ছোকরা টাইপের সিগারেটওয়ালাদেরও দেখা মিলছে নাসুজন বোঝে- সিগারেট বিকিকিনিতে যে লাভ হবে তার থেকে কোরবানীর মাংস কালেকশনে লাভ ঢের বেশীখানিকটা সময় কেটে গেলেও ওর মুখের সিগারেটে অগ্নিসংযোগ হলো নাঅগত্যা কিছুটা এগুতে হলো- অবশেষে মিললো
সুজনের জীবনটাই এমনি করে কাটছেসকল সমস্যার সমাধান হয়ে যায় ঠিক পৌনে বারটাবাজার পরে
জীবন্ত সুজনের মুখাগ্নি ঘটার পর আয়েশ করে টান দিয়ে পাঞ্জাবীদের মত লম্বা নাকের ততধিক সরু নাসিকা ছিদ্র দিয়ে গোয়ালন্দ থেকে খুলনাগামী স্টিমারের চিমনির মত ধোঁয়া ছেড়ে  স্বস্তি অনুভব করে সে; যদিবা এ চিমনির রঙ কালো নয়, শ্বেত-শুভ্র
আনমনে হাটতে তাকে সুজনসংসদ ভবনের উত্তর-পূর্ব কোনে এসে মন্ত্রীবাহী গাড়ীর বহরের হুইসেল শুনে মেজাজটা খিঁচ্ড়ে যায়কোরবানীর ঈদে নয় কেবল; বছরে দুটো ঈদের ছুটিতে ঢাকা যখন একেবারেই ফাঁকা হয়ে যায়, যখন ফাঁকা মহানগরীকে সত্যিকার বসবাসের উপযুক্ত মহানগরী বলে মনে হয়; তেমনি সময়ে ফাঁকা পথে মন্ত্রীবাহী গাড়ীর এই আর্তচিকার অসহনীয় লাগেদাঁড়াতে হয় তাকে; ফুটপাথ ঘেঁষেসামনে দিয়ে যে গাড়ীটা গেল- পরিস্কার বোঝা গেল, এটা প্রধানমন্ত্রীর গাড়ীর বহন নয়তবু গাড়ীর বিদঘুটে হর্ন বেজেই চলেছেসুজনের মনে হচ্ছে জবাইয়ের আগে পশু যেভাবে আর্তনাদ করে; তেমনি শব্দ করে চলে গেল ভিআইপি গাড়ীবহর
এরপর প্রায় বিনা বাঁধায় সে পথ চলেছে- অবশ্য নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে; রাস্তার বাম দিকের ফুটপাথ ধরেআইন বলে- রাস্তার ডান দিকে চলবে মানুষ- বায়ে যান্ত্রিক বহরকথাটা মনে হতেই হাসি পায় তারসে কি আসলেই মানুষ; না কি যান্ত্রিক কিছু একটা!
যান্ত্রিক কিছু একটা না হলে সে যন্ত্রের মত জীবনের চারটা দশক পার করলো কি করে! বাবা-ঠাকুর দার দেয়া সুজন গাঙ্গুলী নামটা বদলে ফেললো কি করে? পাঠক, জেনে নিন- আলোচ্য সুজন এক সময়ে ছিলো- সুজন কে গাঙ্গুলীবাংলায় লিখতো সুজন কুমার গঙ্গোপাধ্যায়যখন থেকে সে বুঝতে শিখেছে- মানব ধর্মের চেয়ে বড় কিছু নেই; তখন থেকে সে হয়ে গেছে সুজন; কেবলই সুজনইউরোপীয় কায়দায় তার ফার্স্ট নেম আর লাস্ট নেম বলে কিছু থাকলো নাফলে ইদানিং অনলাইনে কোন তথ্য ফরম পূরণ করতে গেলে; শেষতক তার নাম দাড়ায় সুজন সুজনফার্স্ট আর লাস্ট নেম একটাইমিডেল নেম এর কোন অপশনতো আর ম্যান্ডেটরী নয়ফলে নেটের বন্ধুরা বেশ আগে থেকেই তাকে সম্বোধন করে সুজন স্কয়ারবলে
এই সুজন কে গাঙ্গুলী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ভালবেসে, জাত-পাত খুইয়ে একটি উচ্চ বংশীয় মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করেছিলজাত-পাত নিয়ে সুজনের কোন দুঃশ্চিন্তা ছিল না বলেই খুব সহজে বাবা-মায়ের অমতে সানজিদা চৌধুরীকে নিয়ে ঘর বেঁধেছিলবিষয়টা মনে হতেই পাঞ্জাবী নাকের সরু ছিদ্র দুটো দিয়ে ঠান্ডা বায়ু নির্গত হয়; হৃদপিন্ডের নীচে হালকা একটা চাপ অনুভূত হয় তার
তালতলার কাছে আসতেই একটু ঝামেলার মত মনে হলসারিবদ্ধ প্রাইভেট কার দাড়িয়ে- গ্যাস নেয়ার জন্যছুটির দিনে, বিশেষ করে ঈদের ছুটিতে ঢাকা যখন একেবারেই ফাঁকা তখন এই সারিবদ্ধ গাড়ী দেখতে খুবই বেমানান লাগছে।  ওই জায়গাটুকু অতিক্রম করতে গিয়ে মনে মনে গালি দেয় গাড়ী চালকদেরআজ ওরা যেন সবাই রিক্সা চালক; দুটো গাড়ীর মাঝখানে যে পরিমান ফাঁকা থাকার দরকার, তা নেইসুজন ভাবে নিশ্চয়ই এ সব চালক পেশা হিসেবে শুরুতে রিক্সা চালনাকেই বেছে নিয়েছিল
রোকেয়া সরণিতে ব্লু লেগুন বলে একটা নামী রেস্তোরাঁ রয়েছে- আগারগাঁ ও মিরপুরের সঙ্গম স্থলেবহু বছর আগে ঐ রেস্তোরাঁর ধারে কাছে কোন ভবন ছিল না; এমনকি রেস্তেরাঁটাও ছিল জলাশয়ের ওপরে মোটা মোটা পিলারের ওপরেভরা বর্ষায় বেশ ভাল লাগতো সেখানে বসতেসুজনও দুএকবার সেখানে বসে পর্যটনের স্বাদ নেয়ার চেষ্টা করেছেঅবশ্য সে সময়ে রোকেয়া সরণিতে যানবাহনের চাপ এতটা ছিল নাসেই রেস্তোরাঁর কাছে আসতেই পুরানো দিনের কথা ষষ্ঠ ঈন্দ্রিয়ে ভর করে তাররাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পশ্চিমাকাশ দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করে সেআশ-পাশের উঁচু ভবনগুলো মুখ বাঁকিয়ে ওর দিকে তাকায়; ফলত তার মনে হয় কিছুটা হলেও তার শরীরে ঘাম জমেছেমনের রঙ সবসময় ছয়টা থাকে নাএক্ষণে ওর মনে হলো পিঠের মধ্যখানে- যেখানে শীর দাড়া রয়েছে- সাধু ভাষায় যাকে বলে মেরুদন্ড; ওখানটায় ঘামের স্রোত বইছেঅভ্যেস বা বদ-অভ্যেস, যা-ই হোক না কেন হাতটা পেছনে নিয়ে টি-শার্টের ভেতরে চালান করে ঘাম মুছে ফেলার চেষ্টা করতেই- খিল্ খিল্ করে কচি নারী কণ্ঠের হাসি কানে ভেসে অসেতাকিয়ে দেখে, চৌদ্দ-ষোল বছরের দুটি মেয়ে হাসতে হাসতে তাকে অতিক্রম করে এগিয়ে চলছে এবং একে অপরকে বলছে:
-চুপ, শুনতে পাবে
চুপ করেনি কেউই; বরং দুজনে পেছন ফিরে আরেকবার সুজনকে দেখে নিয়ে দ্রুত পথ চলতে তাকে
চল্লিশোর্ধ সুজনের খোলা পৃষ্ঠদেশ দেখে ওরা যখন হাসে- পুলকিত হয়; তখন কিশোরী বা যুবতীর উন্মুক্ত পৃষ্ঠদেশ এক যুবক বা প্রৌঢ়ের কাছে মহা আনন্দের বিষয় হবে; তাতে দোষের কি! সুজন নিজেও কি দেখেনি বা দেখার চেষ্টা করেনি কখনো?
নারী পুরুষের এই আকর্ষণ চিরন্তন এবং ঈশ্বর প্রদত্তএ কারণেই পৃথিবীর অবয়ব না বাড়লেও বেড়ে চলেছে মনুষ্য জনগোষ্ঠীসহ তাব প্রাণীকলের পরিধি
এমনই এক আকর্ষণে সুজন আজও ছুটে চলেছে মিরপুরের কোন এক প্রান্তে এবং পদব্রজেহঠা করেই তার মনে খটকা লাগলো, কেন সে রিক্সা বা স্কুটার খুঁজলো না! কেনইবা হেঁটে চলেছে এতটা পথ! প্রশ্নের উত্তর জানা নেই সুজনের; পথ চলাও থেমে নেই
শেওড়াপাড়ার ফুটপাথ সাধারণত সবসময়ে ফল-ফলাদির দোকানে ভরা থাকেআজ অবশ্য তেমনটি নেইবরং রাস্তার ধারে সকালে কোরবানী দেয়া গরু ছাগলের রক্ত, কিছুটা গোবর এবং কোরবানীর আগে উসর্গীকৃতদের ভোজনের জন্য দেয়া খাবারের কিছু উচ্ছিষ্ট এখনো রয়ে গেছেতুলনামূলকভাবে ফুটপাথটাই হেঁটে চলার জন্য উত্তম মনে হয় তার কাছে
এমনিতরো জীবনের স্বর্ণালী দিনগুলোর কোন এক সময়ে সানজিদা চৌধুরীও বোধকরি সুজন কে গাঙ্গুলীর সাথে ঘর বাঁধাটা তুলনামূলকভাবে উত্তম মনে করে ছিলসুজনও সম্ভবত উত্তম সময় ভেবে তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলস্বপ্নই বা বলা কেন; বাস্তবে তারা  একই নীড়ে নীবিরভাবে বসবাস করেছিলপঞ্চাশ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে কোন এক মহাকুমা হাকিমের দপ্তরে দুজন বাঘা উকিল স্বাক্ষী রেখে স্বাক্ষর করে বন্ধু থেকে স্বামী-স্ত্রীতে রূপান্তরিত হয়েছিল তারাসেখানে অবশ্য কে গাঙ্গুলীবাদ দিয়ে কেবলই সুজনলেখা হয়েছিলহাকিম সাহেব বা উকিল- কেউ-ই সুজনের পুরো নাম জানতে চায়নিসুজনের বাবার নামটা লেখার সময় উকিল কি যেন জানতে চাইলে সানজিদাই উত্তর দিয়েছিল
বেশ সুখেই দিন কাটছিলোসানজিদা আর সুজনের ভালবাসার ফসলও এসেছিল বছর দুয়েক বাদেবড় আদর করে সুজন নাম রেখেছিল সুমনা
না, সে এখন আর সুমনা নামে পরিচিত নয়অন্য কোন নাম হয়ে গেছে তারনামের শেষে চৌধুরীও যোগ হয়েছেকত বড় হয়েছে মেয়েটি- সুজন জানে নাসানজিদা জানতে দেয় নাসুমনার কি মনে আছে বাবার কথা? স্মৃতিপট থেকে হারিয়ে যাবারই কথামাত্র দেড় বছর বয়সে সুমনা হারিয়ে যায় সুজনের জীবন থেকে
সানজিদার বাবা, সুজনের শ্বশুর; মস্ত ব্যবসায়ী- মেয়ে আর নাতনীকে দূরে পাঠিয়ে দেনশ্বশুর অবশ্য এ কাজে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন; বলেছিলেন- ওদের আমেরিকা বেড়াতে নিয়ে যাবেনসুজনকেও প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল; সুজন অবশ্য রাজী হয়নি
আমেরিকা যাবার সময় সানজিদার অনুনয়-বিনয়ে সুজন চৌধুরী সেজে নীল রঙের একটা কাগজে স্বাক্ষর করেছিল সে- যা কাবিননামা হিসেবে সকলে জানেসুজন পড়েও দেখেনি কি কি লেখা হয়েছিল ঐ নীল রঙের কাগজটায়আমেরিকার ভিসা পাবার জন্য ঐ কাগজটা নাকি খুবই দরকারী ছিল
তিন মাস পরে, সুজনের কাছে আরেকটি নীল রঙের কাগজ এসেছিল রেজিস্টার্ড ডাকে, আগেরটার থেকে খানিকটা ছোট আকারের; যা তালাকনামা হিসেবে সকলে জানেসুজন সব বুঝলেও তালাকের কারণ হিসেবে কি লেখা ছিল তা কখনো পড়ে দেখেনি
ভুত দেখার মত সুজন দেখে শেওড়াপাড়া ও কাজীপাড়ার মাঝামাঝি একটা জায়গায় ফুটপাথের ওপর একটি চায়ের স্টল খোলা রয়েছেঅবাক হয় সে- আজ তো চায়ের দোকান খোলা থাকার কতা নয়! দাঁড়ায় সে; চায়ের ফরমায়েস দেয়আবারো মুখাগ্নি ঘটায় পশ্চাদেশে হালকা সোনালী রঙের ফিল্টারসহ সাদা সিগারেট মুখে নিয়েচায়ে চুমুক দিতে দিতে মোবাইলটা হাতে নেয় হিপ পকেট থেকেসুজন বরাবরই হিপ পকেটে মোবাইল রাখে- এ নিয়ে বন্ধু মহলে কত কথা হয়েছে- ভেঙ্গে যাবে, হারিয়ে যাবেসুজন শোনেনি- ওর স্বভাবটাই এমন; যদিবা স্কুটারের সিটে হিপ পকেট থেকে পড়ে গিয়ে মোবাইল হারিয়েছে সে একবার
অপর প্রান্তে দুটো রিঙ বাজতেই উত্তর পাওয়া গেল
- কোথায়?
- কাজীপাড়া
- ওখানে কেন?
- তোমাদের দিকে আসছি
- কতক্ষণ লাগবে?
- চল্লিশ মিনিট বা তারও বেশী
- এত কেন, রিক্সায়?
- না, এগারো নম্বর বাস
রোকেয়া সরণি হয়ে এগার নম্বর বাস চলে না, সুষ্মিতা তা ভাল করেই তা জানে; তাই অবাক হয়ে প্রশ্ন করে:
- মানে?
- মানে হেঁটে আসছি
- কেন? কোত্থেকে হেঁটে আসছো?
মৃদু হেসে সুজন বলে:
- একটা একটা করে প্রশ্ন করো, এক সাথে দুটো প্রশ্নের জবাব দেব কি করে?
- হেঁটে আসছ কেন?
- মন চাইলো, তাই
-কোত্থেকে হেঁটে আসছে?
- বাঙালী জাতির ঐতিহাসিক ঐক্যের প্রতীক জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ-পূর্ব কোন থেকে
- কেন?
- এসে বলবো, কেমন!
- পাগলামী, তাই না! জলদি রি·া নাও
- দেখি
কথা বাড়ায়নি কেউ-ইচা পর্ব শেষ করে আবারো পথ চলে সুজনওর গন্তব্য মিরপুর
আকাংখিত মানবী সুষ্মিতা, সুমাইয়া চৌধুরীচাকুরে বাবার একমাত্র মেয়েচৌধুরী পিতৃকলের পদবী নয়; স্বামীর বংশ মর্যাদাওর বাবা সৈয়দ বংশেরপিতৃভক্ত সুষ্মিতা স্বামীর বংশ মর্যাদা ধারণ করে আছে আজওসেই সাথে স্বামীর দেয়া অনন্য উপহার মৌমিতাবয়স বার বছরইরেজি মাধ্যমে স্ট্যান্ডার্ড-টু ক্লাসে পড়ছে
মিরপুর দশ নম্বর গোল চক্করে এসে প্রকৃতার্থে চক্করে পড়ে যায় সুজনহিপ পকেটে রাখা মোবাইলটা বেজে ওঠে ফোনটা মাধবীর:
- কোথায় আছ?
- মিরপুর
- ওখানে কেন?
- কাজ আছে
- ঈদের ছুটিতে কি কাজ ওখানে?
- আমারতো ঈদ নেই, পুজোও নেই
- রমনায় আসবে?
- রাত হবে
- কোথায় যাচ্ছ?
- পরে বলবো
- আমি কি অপেক্ষা করবো?
- না, আজ নয়; কাল দেখা হবে
কথা প্রলম্বিত হয় নামাধবী অভিমান করে লাইনটা কেটে দেয়
মাধবী, মাধবী রানী গুহসুজনের কলিগ; একত্রে ওরা কাজ করে একটি দৈনিকেমাধবী মফষ্মল পাতা দেখে, সুজন বিজ্ঞাপন বিভাগেতবু কেন যেন মাধবী সুজনকে লাইক করে; হয়ত স্বধর্মী ভেবেমাধবী সুজন থেকে অন্তত দশ বছরের ছোট হবে বয়সেতবু ওদের মধ্যে সম্পর্কটা তুমিপর্যায়েসুজনের আপনিসম্বোাধনটা একেবারেই অপছন্দ; তবু অপরিচিতজন বা বয়স্কদের আপনি-ই বলতে হয়কারো সাথে বছরখানেক সম্পর্ক রয়েছে- এমন কাউকে সে আপনি বলছে- এমন মানুষ মেলা দুষ্কর
চাকুরে বাবার মেয়ে সুষ্মিতা বহুজাতিক কোম্পানির পাবলিক রিলেশনে কাজ করেচাকুরীর সুবাদেই সুজনের সাথে পরিচয়- বছর দুয়েক হবেপরিচয়ের ছমাসের মধ্যেই সম্বোাধনটা তুমিতে চলে এসেছেএর কারণও অবশ্য রয়েছেঅনেক কারণের একটি হাস্যকর কারণ হলো, ওরা দুজনেই পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে ভালবাসেরমনা, সোহরাওয়ার্দী বা চন্দ্রিমা উদ্যানে ওরা নিদেন পক্ষে বারটি পূর্ণিমা উপভোগ করেছে এরি মধ্যে
দুএকবার চাঁদের উপমায় সুষ্মিতার নাম সুজনের ঠোঁট গলে বেরিয়েছে বটেসুষ্মিতাও বলেছে:
- তুমি কি মুসলমান হতে পার?
- হয়েছিতো!
- কই! দেখছি না তো
- সানজিদার নীল কাগজে লেখা আছে
- ওটাতো ভুয়া, মেকিআসলে মন থেকে হতে হয়
- হলে কি হবে?
- তুমি আমি এক হব
- এমন ভাবছ কেন?
- তোমার মত বন্ধু কি আর পাব?
- চেষ্টা করেছ কখনো?
সুষ্মিতা সরাসরি উত্তর না দিলেও সুজন জেনেছে ওর জীবন কথামৌমিতার বাবা চৌধুরী সাহেবের করুন পরিনতি; জেনেছে সুষ্মিতার জীবন সংগ্রামের কথাবাবা তার জন্য নিশ্চিত আশ্রয় দিয়েছেন বটে, জীবন সংগ্রামে অন্য কোন ভাবে সহায়তা করেন নিতবু সে বাবার কাছে কৃতজ্ঞঐ ঠাঁইটুকু না পেলে মৌমিতাকে নিয়ে তার দুঃসময় কিভাবে কাটতো- ভেবে পায় না সে
দশ নম্বর গোল চক্কর থেকে সোজা যাবে না বাম দিকে মোড় নেবে; ভাবতে ভাবতে আরেকটা সিগারেট ধরায় সুজন।  কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারে নাএমনি সময়ে সোনালীর ফোন- ছেলে বেলার বন্ধুথাকে যাত্রাবাড়ীস্বমী সন্তান নিয়ে সুখেই আছেফোনটা রিসিভ করতেই
- কিরে, এলিনা কেন?
- আমি একটু দূরে আছি; আজ আর আসবো না
- দুপুরে খেয়েছিস?
- হুম
- কোথায় খেলি? তোর কোন্ বান্ধবী খাওয়ালো রে?
- না রে, আমিই খেয়েছিডাল আর ডিম
- এভাবে কদ্দিন চলবে? পুজার দিনও এলি না; ঈদের দিনও না; কবে আসার সময় হবে তোর?
- বড় দিন তো বাকী আছেঅপেক্ষা কর, আসবো
- তোর জামাই বাবু বসেছিল তোর জন্য
- বলে দে, বড় দিনে একসাথে খাব
সোনানী জানে সুজন এমনি বাউÊুলেখাবার হিসেব নেই, চলার তো নয়ইকেবল একটা জায়গায় সে পারফেক্ট- তা হলো কাজকাজে তার কোন ফাঁকি নেই কোন দিনসে জন্য সোনালীর স্বামী সুজনকে নিজের কোম্পানীতে কাজ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছিলসম্পর্ক নষ্ট হয়ে যেতে পারে আশংকায় সুজন সেই আগ্রহে সাড়া দেয়নি
অবশেষে ইনডোর স্টেডিয়ামের দিকে এগোতে থাকে সুজনতার গন্তব্য মিরপুর সাত ন¤^র সেকশনের সাত নম্বর রোডের সাত নম্বর বাড়ীর সাত তলার ফ্ল্যাটফ্ল্যাট নম্বরটাও সাতের ঘরে, ইংরেজীতে জিসাধারণত কোন উঁচু ভবনের ফ্ল্যাট নম্বর হয় প্রতি তলার ফ্ল্যাট ধরে ধারাবাহিকভাবেওদের ফ্ল্যাটটের নম্বরের ধারাবহিকতা হয়েছে নীচ থেকে উপরে; এমনটি করে- নীচ তলার প্রথম ফ্ল্যাটটি ’; এর পরে দোতলার ঠিক ওপরেরটি বি’- এভাবেসুজন বাড়ীওয়ালার রুচির তারিফ করে মনে মনে
কল বেল বাজানোর সাথে সাথেই দরজা খোলে সুষ্মিতামনে হলো দরজা খোলার জন্যই হয়তবা সে দাড়িয়েছিল ঠাঁয়মুখদর্শনে চমকে যায় সুজন
বসার ঘরে সোফায় আরাম করে বসেই
- এক গ্লাস পানি দেবে?
হাসিমুখে উঠে পানি দিতে দিতে বলে সুষ্মিতা
- এমন পাগলামী না করলে হতো না?
- তা হলে চলে যাই?
- যাও তো দেখি!
সুষ্মিতা জানে, সুজন এতটা পথ হেঁটে এসে ক্লান্ত; মুখে বললেও সে এখনই উঠবে নাসুজন নিজেও এখনই ওঠার জন্য আসে নি এতটা পথ
সুষ্মিতা বাঙালী ঢঙ্গে শাড়ী পড়েছেএকেবারেই সাদাসিধা আটপৌঢ়ে শাড়ীহালকা সবুজ রঙের ব্লাউজের গলাটা একটু বড়এমন ব্লাউজ পড়ে সে বাড়ীর বাইরে যায় না কখনো- একটু ঢিলে-ঢালা; বেশ লাগছিলো তাকেপ্রকান্ড গলার ব্লাউজের ওপর সাদা এবং তার ওপরে সাদা সুতোর কাজ করা শাড়ীর আঁচল ডান হাতের নীচ থেকে পয়তাল্লিশ ডিগ্রী কোনে বাম কাঁধের ওপর পেচানোগলায় সরু স্বর্ণের চেইনবুকের মাঝখানে, যেখানটায় ছোট একটা শীর্ণধারা দৃশ্যমান, লাল পাথর বসানো লকেটটা সেখানে সেঁটে আছেওটা সুষ্মিমতার সৌন্দর্য বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছেএক নজরে তাকিয়ে সুজন; যেন গোগ্রাসে গিলছে তার সৌন্দর্য
দার্জিলিং এর টাইগার হিলে উঠে প্রত্যুষে কাঞ্চজক্সঘা ও হিমালয়, দুটোই দেখেছে সুজন- বহুবারতুলনামূলকভাবে কাঞ্চজঙ্ঘই ভাল লেগেছে তারতবে প্রকৃতির কাঁচুলী জড়ানো উই ঢিবি দেখতে সব থেকে ভাললাগে তার কাছে- বান্দবানের নীলগিরীতেসারিবদ্ধ টিলা, সবুজ রঙের কাঁচুলী জড়িয়ে পুরো বান্দরবানের সৌন্দর্যকে সত্যিকার রমনীয় করে রেখেছেসুষ্মিতার দিকে তাকিয়ে সামনে নীলগিরী থেকে দেখা বান্দরবানকেই দেখছিল সুজন
সুষ্মিতা জানে সুজনের স্বভাবতাকিয়ে থেকে দেখায় তার জুড়ি নেইনীরব দর্শক হিসেবে সুজনের চেয়ে উত্তম কাউকে পাওয়া যাবে নাতাই সেও তাকিয়ে থাকে সুজনের দিকেকতক্ষণ! এক মিনিট, দুই মিনিট; না কি তারও বেশী! সুজনের মত নীরব দর্শক সে নয়, তাই
- ক্লান্ত শরীরে অমন করে কি দেখছো?
- কাঁচুলী জড়ানো নীলগিরী
এবারে সুষ্মিতা শাড়ীর আঁচল ঠিক করার চেষ্টা করে, যদিবা ওটা আগে থেকেই সঠিক জায়গাতেই ছিল
- হাত যখন লাগালেই, আঁচলটা নামাও না!
- ধ্যাত!
- কেন, ভরসা হারিয়ে গেছে?
- চোখে কোন জড়তা নেই তোমার?
- না!
- হেঁটে এলে কেন?
- মন চাইছিল, তাই
- আমায় ই¤েপ্রস করতে চাও?
- বলতে পারো, আবার নাও বলতে পারো
- এতটা পথ কোন পাগলেও হাটে না!
- আমি তো পাগল নই
- তুমি মহাপাগল
এবারে দুজনেই হাসে
উঠে দাড়ায় সুষ্মিতাচা বানানোর জন্য ছুটি চায়সুজনও সায় দেয়সুষ্মিতার প্রস্থান লক্ষ্য করলেও সহসা সোফায় শরীরটা এলিয়ে দেয় সুজন
গুলশান বনানীর সীমানা নির্ধারণী লেকের ওপরে নতুন তৈরী সেতুর ওপর দাড়িয়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখবে সুষ্মিতা আর সুজনমেঘলা আকাশ ওদের আনন্দের মাঝে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে এরি মধ্যেতবু মাঝে মধ্যে হালকা কালো-সাদা মেঘের ফাঁকে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ যখন আকাশে হেসে-খেলে ছুটে চলে অবিরাম, লেকের জলে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে হাজারো চন্দ্রকণার কৃত্রিম ও ক্ষণস্থায়ী উপস্থিতি বেশ উপভোগ করে ওরাশরতের প্রথম পূর্ণিমা; প্রথাগতভাবেই খন্ড খন্ড সাদা আর ছাই রঙের মেঘের ফাঁকে ফাঁকে ভরা যৌবনা নারীর মত প্রস্ফুটিত র্পূণ চাঁদ। 
যখন ওরা লেকের ধারে পৌঁছায়, তখনও চাঁদ ছিল মেঘে ঢাকাসুষ্মিতা মন খারাপ করে বলে
- ভাগ্যদেবতা আমাদের অনুকলে নয়, চলো ফিরে যাই
- এসেছি যখন, একটু বসে যাই
সেতুর ওপরেই দাড়ায় ওরালোক-জনের বেশ আনাগোনাগল্প করে সময় কাটানোর জন্য দারুন একটা জায়গাওদের সময়টা বেশ কাটে! ওরা দুজনেই পূর্ণ চাঁদ ভালবাসে; জীবনের পূর্ণতা পায়নি বলে হয়তোবা
সুষ্মিতার মত সংগ্রামী নারীকে শ্রদ্ধা করে সুজননিজে কাজ ভালবাসেই বলেই হয়তসুষ্মিতাকে সংগ্রামে উসাহ দেয়, সাহস জোগায়বিনিময় একটাই- একত্রে পূর্ণ চাঁদ দেখা
না, ওদের চাওয়া-পাওয়ার গন্ডি এখনো সীমানা  অতিক্রম করেনি
সীমানা অতিক্রমে সুজনের একটা নিজস্ব মতামত রয়েছেছেলে বেলায় এনুয়েল স্পোর্টস্ এ তিন পায়ের দৌড় বলে একটা খেলা হতদুজন প্রতিযোগী মিলে তিন পায়ে দৌড়াতে হতোএকজনের ডান পায়ের সাথে অন্যজনের বাম পা বেঁধে দেয়া হতদুজনের তখন কর্মক্ষম পা তিনটিসেই জুটি সবচেয়ে ভাল দৌড়াতে পারতো, যাদের মধ্যে পারষ্পরিক সমঝোতা বা একসাথে দৌড়ানোর ইচ্ছেটা একসাথে হতো; তারাই প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান দখল করতো
নারী পুরুষের সম্পর্কের সীমানা অতিক্রমের ক্ষেত্রেও এমনি ইচ্ছে শক্তি বা একে অপরকে পাওয়ার ইচ্ছেটা জন্ম নিতে হয়; একজন চাইলেই তা পূর্ণ হবার নয়
রাত বাড়ে; সুষ্মিতা ফেরার তাগিদ দেয়সুজন অসম্মতি জানিয়ে বলে:
- আমি পূর্ণিমার স্বাদ নেব, ঈশ্বর তা হতে দেবেন না- এমনটি হতে পারে নাআধা ঘন্টা অপেক্ষা করো, মেঘ না কাটলে চলে যাব
সুজনের অপ্তবাক্যে সুষ্মিতা রাজী হয়সে বহুবার দেখেছে ধর্মহীন মানুষটার একটা শুভ পরিনতি আছেধর্মীয় অনুশাসন না মানলেও তার চলার পথে বক্ররেখার কোন উপস্থিতি নেইতার চাওয়া-পাওয়ার হিসেবে-মেলে সবসময়ে, তবে ঠিক পৌরে বারটায়
চা নিয়ে ফিরে এসে সুষ্মিতা দেখে সুজন ঘুমিয়ে গেছে সোফায়মাথায় হাত রেখে ডাকতে যায় সে- তখনই চোখ মেলে তাকায় সুজন
- বড্ড ক্লান্ত, তাই না?
- হুম! তবে, সেই রাতে আমরা ঠিক পূর্ণিমার চাঁদ দেখেছিলাম, তাই না?
হেসে ফেলে সুষ্মিতাকাবাবের প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বলে:
- তোমার জীবনটাইতো পৌনে বারটায় বাঁধা
সুজনও হাসেগরুর মাংসের গরম কাবাব হাতে নিয়ে বলে:
- এত অল্প সময়ে করলে কি করে?
- সবই তৈরী ছিল, কেবলি তেলে ভাজার কাজটা করেছিনাও, ঠান্ডা হয়ে যাবে
সুজন এলেই নিজের হাতে বানানো খাবার খাওয়াতে পছন্দ সুষ্মিতারকারণ হয়তো সুজনের ভাল কাওয়া হয় না বহুদিন ধরে, তাইসুজনও বিষয়টা বেশ উপভোগ করেএমনও দিন গেছে, সুজন আসার পর ভাত সাংস রান্না করে খাইয়েছে সে
সুষ্মিতার সবই পছন্দ সুজনের; কেবল ধর্মবিশ্বাস ছাড়াসুজনও মানব ধর্মের বাইরে যেতে চায় নাসে কারণেই কাঁচুলী জড়ানো ধরণীর কাছাকাছি যাওয়া হয়ে ওঠেনি সুজনেরসুষ্মিতা বহুবার বলেছে:
- আমার জন্য অন্তত এই টুকু করে দেখাও
- নিজের সাথে প্রতারণা করতে বলো?
- তা কেন?
তা নয়তো কি? যা আমি বিশ্বাস করিনা, সেইটে করা বা বলাই তো নিজের সাথে প্রতারণার সামিল
- সানজিদাকে তো এমনি একটা কাগজ দিয়েছিলে তখন!
কথাটা বলেই দাঁতে জিব কাটে সুষ্মিতাসুজন কিছু বলার আগেই বলে:
- তোমায় কষ্ট দেয়ার জন্য কথাটা বলিনি সুজন
সাবলিল ঢঙে সুজন উত্তর দেয়:
- ওটা দিয়েছিলাম ওর বিদেশ যাওয়ার সুবিধের জন্যকাজটা অন্যায় ছিল বলেই হয়ত ওকে আর ফিরে পাইনি
- এ জন্য কষ্টবোধ আছে তোমার?
- থাকলেই বা করার কি আছে, বল?
কথা বাড়ায়নি সুষ্মিতা; সুজনও নাপ্রসঙ্গ বদলে সুজন এমনটি বলে:
- ধরণীর বুকে সমর্পিত না হতে পারলেও দর্শনে কোন দোষ থাকার কথা নয়
সুষ্মিতা বোঝে- সুজন কি বলতে চাইছেচোখের ভাষায় সে বলতে চাইছে:
- এমনটি আব্দার করোনা গো!
একই ভাষায় সুজনও বলে:
-তাই হোকআমরা না হয় রেল লাইনের মত সমান্তরালে চলতে থাকি; সেটাই উত্তম পথদেখা হবে, কথা হবে, দূর থেকে দৃশ্যমান হবে- দূরে কোথায়ও আমরা মিলিত হয়েছি; প্রকৃতার্থে তা হবার নয় কোনও দিন!
সাদামাটা আল্লাহ হাফেজশব্দে বিদায় জানায় সুষ্মিতা; সুজন অবশ্য বলে খোদা হাফেজ
রিক্সা ব্লু লেগুর অতিক্রম করছেহেমন্তের আকাশে একাদমীর চাঁদ মেঘে ডেকে আছেসুজন জানে খানিক বাদে একাদশীর চাঁদ মেঘমুক্ত হবেসোডিয়াম বাতির কিম্ভুতকিমাকার রঙে উদ্ভাসিত ঢাকায় ঐ চঁ দের আলোর বন্যা কোনই আবেদন তৈরী করতে পারবে নাঢাকাবাসী উপভোগ করতে পারবে না একাদশী চাঁদের অপূর্ব রূপ ও রস
বাসায় ফিরে নিত্যকার অভ্যেসমত চা তৈরী করে বিছানায় চারটে কুশন দিয়ে কৃত্রিম টেবিল বানিয়ে বই নিয়ে বসে; পাশে কাগজ কলমতো রয়েছেই
চারিদিকে নীরব- নিত্যকার মতসুজন বুদ্ধদেব গুহবনজ্যোস্নায় সবুজ অন্ধকারেনিমগ্নবনে-জঙ্গলে গুরতে ঘুরতে হঠা তার চোখের গতি থেমে যায় একটি চরনে, “নারীমাত্রই জলের মতকোথায় যে তারা কখন গড়িয়ে যায় স্বভাবেরই কারণে, তা শুধু ঈশ্বরই জানেনতখনি মুঠোফোনে সর্ট মেসেজ, যা এসএমএস নামে সকলে জানেন; প্রাপ্তির ঘোষণাগত দুতিন দিন ধরে ঈদের শুভেচ্ছা জ্ঞাপক সর্ট মেসেজ ডিলিট করতে করতে সুজনের বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুল বিরক্ত হয়ে গেছেডান হাতে ফোনটা নিয়ে অবাক হয় সে, সুষ্মিতা লিখেছে:
কিছু কিছু বিদায় সুখের হয় নাআজ ঠিক তাই হলএকটা কি যেন অপূর্ণতা ছিল
সর্ট মেসেজ পাঠাতে সুষ্মিতার জুড়ি নেইকোন কোন দিন ৫টা বা তারও বেশী সর্ট মেসেজ পাঠায় সেসুজন সেগুলো সুন্দর করে লিখে রাখে ডাইরীর পাতায়বিষয়টা জেনে সুষ্মিতা বলেছিল:
- এটা পাগলামী ছাড়া কিছু নয়
সুজন বলেছিল দৃঢ়তার সাথে:
- তোমার সর্ট মেসেজগুলো আগে-পরে সাজিয়ে সুন্দর একটা গল্প হতে পারেদেখো, এই আমি একদিন এ অসাধ্য সাধন করে ফেলবো
কথাটা মনে হতে দিন কয়েক আগে সুষ্মিতার পাঠানো আরেকটি মেসেজ আবারো পড়তে মনে চাইলো তারমেসেজটির কথাগুলো ছিল এমনতরো:
মনের মাধুরী মিশিয়ে ভাল লাগার মানুষের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছি বহুবার, পারিনিপুজোর বলির জন্য উসর্গীকৃত পশুর মত হাতে-পায়ে শিকল আমারমনটাতো আর ওরা বেঁধে রাখতে পারেনিতাই উদ্যামে ছুটে যায় সেটি যখন তখন, সেথা খুশী সেথাতাইতো মন ভরে কথা বলি, মিষ্টি প্রেমের কথা বলতে চাইদুনিয়ার তাব জটিলতার কাছে এ জীবন উসর্গীকৃত হলেও মনটা ভাললাগা আর ভালবাসার কাছে উসর্গীকৃত
এ দুটো সর্ট মেসেজ সুজনকে ভাবতে শেখায়ভাবতে বাধ্য করে সুষ্মিতার পূর্ণ গগণ নিয়েতবে কি সুষ্মিতার পূর্ণ চন্দ্র আলোক বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছে? মনে হয় তাই; তবে আকাশের যেখানটায় পূর্ণ চন্দ্র, তারও অনেক অনেক নীচে কালো মেঘের ঘনঘটাতাই দৃশ্যমান নয় সেই আলোর ছটা; এ যেন আষাঢের শুক্লপক্ষের ভরা পূর্ণিমার চাঁদ- আলো ছড়াচ্ছে- মনুষ্যকূল দেখতে পাচ্ছে না; ধরণী বঞ্চিত হচ্ছে  ভরা পূর্ণিমার আলোর বন্যার সৌন্দর্য থেকে

২১ নভেম্বর ২০১২