বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৩

গোলিকর চর

গোলকীর চর
নুরুল্লাহ মাসুম

বোশেখ মাসের বিকেলকেরায়া নৌকায় করে যখন কাউখালীর কাছাকাছি পৌঁছালাম, মাঝি প্রায় চিৎকার করে আঞ্চলিক ভাষায় বলে ওঠে
-        সার, ওই দ্যাহেন একটা চর
রোদের তীব্রতা উপো করে গাঢ় অথচ মোটা কাঁচের চশমার পেছনে লুকানো চোখ দুটো দিয়ে ওদিকটায় তাকাবার ব্যর্থ চেষ্টা করলামপশ্চিমে হেলানো সূর্য নদীর জলে হাজার রবির জন্ম দিয়েছে ইতোমধ্যেইরবিরশ্মি যেমনি আঘাত হানছে অসংখ্য রবিকনা তেমনি আঘাত হানছেকেরায়া মাঝির ওই চরআর দেখা হল নাব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ না ঘটিয়ে বিজ্ঞের মতো প্রশ্ন করলাম
-        কতণ লাগবে?
-     ঘণ্টা খানেক
বুঝলাম বেশ দূরের পথসন্ধ্যাও নেমে যেতে পারে, ভয় পেতে লাগলামচরে পৌঁছতেই যদি সন্ধ্যা হয়ে যায়, ফিরবো কখনসান্তনা পেতে চাইলাম
-        চরে থাকোনের মতো কোন জায়গায় আছে?
এক গাল হেসে পৌঢ়ত্বের কাছে হার মানা মাঝি জবাব দেয়
- থাকোনের জাগা পাইবেন কই? গোলকীর চরে মানুষ থাকে নাকি?
-        তাহলে?
-        বেলাবেলি ফিরা আইতে অইবো
এবার বুঝলাম এবং নিশ্চিন্ত হলাম, ঘণ্টাখানেক দূরের পথ বলে মাঝি যে কথা বলেছিল সে পথটুকু যেতে ততটা সময় লাগবে না
হাদিস অবশ্য বলেছিল স্টিমার থেকে নেমে গোলকীর চরে পৌঁছতে সাকুল্যে এক ঘণ্টা লাগতে পারে, যদি উজান বাইতে না হয়সে হিসেব মতে তিনটে নাগাদ পৌঁছতে পারবো বলে ভাবতে চাইছি
গোলকীর চরপিরোজপুর জেলার একটা ছোট্ট চরসাধু ভাষায় বললে বলতে হয় দ্বীপদণিাঞ্চলে এমন বহু দ্বীপ আছে, যা কোন দিন মানচিত্রে উঠবে নাবহু ছোট্ট চরের একটি গোলকীর চরঐ গন্তব্যে পৌঁছার জন্য আমি একাকী এ পথে
দৈনিক সান্ধ্য কাগজের একটি রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রথম এ চরের প্রতি আমার আগ্রহ সৃষ্টি হয়মুক্তিযুদ্ধের সাথে মিশে আছে এর ইতিহাস
১৯৪৭ সালের কোন এক সময়-অবশ্যই ১৪ আগস্টের পর, গোলক বানু আশ্রয় নেয় সন্ধ্যা নদীর এক নাম না জানা চরেঅন্যভাবে বলা যায়, তখনো চরটির নামকরণ হয়নিদেশ ভাগ হয়ে গেলগোলক বানু সকলের অলক্ষ্যে  আশ্রয় নেয় সেখানেসাথে তার প্রাণের সখা ভূবনেশ্বর হালদারওদেও সম্পর্ক  স্বাধীন পাকিস্তনে কেউ মেনে নেবে না ভেবেই ওদের ঐ গোপন মিশনওরা এসেছিল সাগর পাড় থেকেএখন আর কেউ জানে না ওরা মূলত কোন এলাকার বাসিন্দা ছিল
মুসলিম প্রধান পাকিস্তনের নেতৃবৃন্দ মতার ভাগাভাগিতে ব্যস্তলোকাল লিডাররাও কেন্দ্রীয় নেতাদের তোষামোদে আরো বেশি ব্যস্তসে কারণে অসময়ে ঐ জমির খবর তখন তেমন কেউ নেয় নিতাছাড়া চরটি তখনো ডুবো ডুবোঅমাবশ্যা ও পূর্ণিমার জোয়ারে চর ডুবে যায় ঘোলা জলেতাই কারো নেক নজর নেই ওদিকে
দিন কাটেকালের হিসেবে পার হয়ে যায় অনেক গুলো বছরদেশ রাজনীতি অর্থনীতি কোন কিছুই গোলক বানু আর ভবনের জীবনে প্রভাব ফেলতে পারেনাভূবনেশ্বর খেটে খাওয়া মানুষদিন মজুরীর কাজ করে দিন গুজরান করেচরের মাঝে একটা খড়ের ঘর তুলে সংসার শুরু করেছিল অনেক আগেই, ওরা এখন তিনজনসংসারের সীমানা বাড়ে নিগোলক বানু শুকরিয়া আদায় করে আল্লাহর কাছেভূবন ভগবানের কাছে নতজানু হয়ে কৃতজ্ঞতা জানায়নবাকে নিয়ে ওদের দিন ভালই কাটে
ভর অমাবশ্যা-পূর্ণিমার জোবায় পানি বাড়লে ওরা মাচা বানিয়ে দিন কাটায়নবা জানতে চায়
-        মা আমরা এইহানে ক্যান?
-        এইটা আমাগো বাড়ি
-        ক্যামনে আইলা নদীর মদ্যি?
-        আল্লাহ দিসে
বাবা বলে-
-  ভগবানের কৃপায় এটা আমাদের বাড়ি হয়েছেনদীর জল আর মাছ আমাদের দেবতাজল আমাদের তি করে না, মাছ খাইয়া বাঁচি
নবা মা-বাবা দুজনকেই ভালোবাসেপ্রকৃতি নবাকে দুরন্ত বানায়প্রায় সময় ওকে দেখা যায় নদীর জলেফিরবে মাছ নিয়েজাংলা দিয়ে মাছ ধরার কৌশল সে বাবার কাছে শিখেছেশুকনার সময় লাউ গাছ, কুসির গাছ আর নানান পদের সবজির চাষ করে নবা
এত কিছুর পর ওর একটা দুঃখ আছেসেই দক্ষিণে কাউখালী, পশ্চিমে গাববাড়ি, পূর্বে আমড়াজুড়ি আর উত্তরে জলাবাড়ি, কোনটাই তার দেখা হয় নিনিজের বাড়ি সম্পর্কে নবার  বাবা ভূবন বলে
- আমাদের বাড়ি গোলকীর চর
একদিন গোলক বানু জানতে চায় স্বামীর কাছে
-        তুমি এইডারে গোলকীর চর কও ক্যান?
-        তোমার লাইগ্যা এই চর আমি পাইছিএত বছর অইল, কেউ আহে নাই দখল করতেএইডার মালিক তুমিতাইতো এইডার নাম গোলকীর চর
নবা মায়ের কাছে জানতে চায়
-        মা, তোমার নাম গোলকবানু হইল ক্যান?
-        জন্মের সময় আমার বদন খানি আছিল গোলহেই লেইগ্যা তোর নানায় নাম রাখছিলো গোলক বানু
নবা মায়ের কথায় হাসেআবারো জানতে চায়
-        আমার নানা-নানী কই?
-        হেরা হেই-ই দক্ষিণে থাকতোএহন মনে অয় নাই
-        তুমি আর যাবা না?
-        তৌফিক নাইরে বাবাবলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে
ভূবন একদিন বলেছিল
-        গোলকী, তুমি বাপের বাড়ি যাবা না?
- কেমতে?
- ধর আমি যদি লইয়া যাই?
- না, তা অইবো নাতুমি গেলে তোমারে আস্তা রাখবে না।   আমি তোমার হারাইতে পারমনা
এরপর কখনোই গোলক বানুকে বাপের বাড়ি যাবার কথা বলেনি ভূবনসে জানতো নিজের বাবা-মা বহু আগেই কলিকাতা চলে গেছেঅবশ্য সে কারণে কখনোই তার দীর্ঘশ্বাস বের হয় নি
নবা একবার বাবার কাছে আবদার করেছিল কাউখালি যাবেবাবা বলেছিল
- দেশ স্বাধীন হইলে যাবি
স্বাধীন মানে কি জানতে চাইলে সে বলেছিল-
-        আমাগো মতন যহন পুরা দেশটা হইবোবিদেশীরা আমাগো উপর মাতুব্বরী করতে পারবো না
মুর্খ নবা বাবার কথার মানে বুঝতে পারে নাইগোলকবানু কিন্তু ঠিকই বুঝেছিলভূবন তাকে কিছু না বললেও দেশের খোঁজ খবর রাখেগোলক বানুর মনটা গর্বে এক হাত ফুলে যায়ও হাসে, ভূবন এইট পর্যন্ত পড়েছিল
অঘ্রাণ মাসবিকেল বেলা থেকেই আকাশে মেঘপানি বাড়তিভূবন বা গোলক বানুকে এ নিয়ে ভাবতে দেখা যায় নাবাইশ তেইশ বছর ধরের ওরা এমনি দেখে আসছেনবার মনে ভয় লাগেঅঘ্রাণ মাসে আকাশে মেঘ থাকবো ক্যান? জল বাড়লেও এতটা বাড়ার কথা নারাত বাড়তেই পানিও বাড়তে থাকেএবারে ভূবন আর গোলক বানুও ভয় পেয়ে যায়মাচাং বানাতে ব্যস্ত্ হয়ে যায় ওরা, সময়ে কুলায় নাশেষে, ঘরের চালে আশ্রয় নেয় ওরাগোলকীর চরে বড় কোন গাছ নেইসেজন্য ওদের আফসোস ছিল নাভূবন জানতো, বড় বড় গাছ হলেই সরকারি লোকের চোখে পড়বেআর চর চলে যাবে সরকারের দখলেআজ পানি বাড়ার গতি দেখে ভয়ে ভয়ে সে ভাবছে, বড় গাছ থাকলে ভাল হতোতিনজনের একটা আশ্রয় হতো
সারা রাত শংকায় কেটে গেলোকোন মতে বেঁচে রইল ওরাভগবানের কাছে কৃতজ্ঞতা জানায় ভূবনগোলক বানু বহুদিন পর নামাজ পরেনবা, সে আর কি করে, তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকেকখন মেঘ কেটে সূর্য উঠবে সেই আশায়
এরপর থেকে ভূবন বিকল্প বাসস্থানের চিনন্তা ভাবনা করতে থাকেগোলক বানু সায় দেয় নাতবে নবার জন্য মায়া ছাড়ে গোলক বানুনবাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়ে মিয়ার হাটের একটা কাঠের গোলায়ভূবনের আশা, নবা যেন ভাল থাকেগোলক বানুর আশা, নবা কাজ করে অনেক টাকা জামিয়ে এই চরে বড় ঘর বানাবেসরকার এই চর নিলেও যেন কিনে রাখতে পারে সেতারপর-
তারপর নবার ঘরে আসবে সুন্দরী একটা বউসে হবে শ্বাশুরী, আরও পরে দাদিছোট সোনার সংসার আনন্দে হাসিতে ভরে রাখবে আরেক নবা
একদিন গভীর রাতে নবা বাড়ি আসেসাথে জনা চারেক বেটা ছেলেমায়ের কাছে মিছা বলেনা নবা
-        মা দেশে যুদ্ধ শুরু হইছেপীর সাহেব আমাগোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতাছেপাকিস্তানীরা বাঙালি মারতাছে
গোলক বানুর মাথায় ঢোকে না কিছুসে বুঝতে পারে নাপাকিস্তানতো একটা দেশতারাও তো এ দেশের লোকনিজেরা নিজেগো মারবো ক্যান? তবে ছেলে যখন যুদ্ধ করছে, মায়ের মত যুদ্ধের পক্ষেতাছাড়া বাবা খুশি হয় যে, স্বাধীনতার কথা কদিন আগেও নবা বুঝতো না, সেই ছেলেই এখন স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছেসে প্রতিজ্ঞা করে যুদ্ধের পে তারা কাজ করবে

গোলকীর চরে পৌঁছতেই চোখ দুটো ভরে গেলচারিদিকে সবুজের সমারোহবড় কোন গাছ নেইসবুজ ঘাস আর মাঝে মধ্যে দুএক গোছা বিচালি, মাঝি নৌকা বেঁধে রেখে আমায় সঙ্গে নিলদুজনে হাঁটছিসে বলে যাচ্ছে......
-        যুদ্ধের সময় গোলক বানুর বাড়িতে মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্প হইছিলোআমড়াঝুড়ির হাশেম চেয়ারম্যান খবরটা কাউখালী থানায় জানাইয়া দিছিলরাজাকারের বাচ্চা আছিল বেডা
-        তার মানে ওর বাবাও রাজাকার ছিল?
-        না ভাই সাবহের বাবাতো আরো আগেই মরছিলতয় রাজাকারগো রাজাকারের বাচ্চা কইতে ভালো লাগে
-        তারপর?
-        খবর পাইয়া কাউখালী আর স্বরূপকাঠী থেইক্যা গানবোটে মিলিটারীরা আইলো, লগে বহুত রাজাকারপুরা চরডা দখল কইরা ফালাইলো
-        মুক্তি বাহিনীরা কোথায় ছিল?
-        হগলতেই চোরা ডুব দিয়া গাববাড়ির দিকে পালাইছিলদিন ভর পুরো গোলকির চরে কাউরে পায় নি পাক আর্মি, কেবল গোলক বানুকে ছাড়াহাশেম চেয়ারম্যানের ভাষ্যমতে ক্যাপ্টেন বুঝতে পারে পুরো চরটা গোলক বানুরএকাই মুক্তিদের ক্যাম্পটা সে চালাইতোকিন্তু কোন মুক্তি ধরতে না পারায় ােভে গুলি করে হাশেম চেয়ারম্যানকে মেরে ফেলে মিলিটারীরামাঝির ভাষায়
-        কুত্তা হাশেমের লাশ মাস খানেক সন্ধ্যা নদীতে ভাসছিলজোয়ার ভাটায় এই নদীতেই আওয়া-যাওয়া করছেঅন্য কোন হানে যায় নাই
-        গোলক বানুর কি হলো?
-        কুত্তার বাচ্চারা গোলক বানুরে মাইরা একটা খুটি পুইতা ঝুলাইয়া রাখছিল
কথাগুলো বলে মাঝি চোখ মুছলো
-        তয় দেশ স্বাধীনের পর হগলে মিল্লা নবারে লইয়া হের মায়ের হাড্ডি গুলান ওই-ই হানে কবর দিছিল
না, দেশ স্বাধীন হবার পর নেতা গোছের কেউ গোলকীর চরে আসে নিকোন সৌধ নির্মিত হয় নি গোলক বানুর কবরেতবে সার্ভে বিভাগ যখন এই চরটিকে তালিকাভুক্ত করে তখন সরকারের খাতায় এর নাম স্থায়ীভাবে হয়ে যায় গোলকীর চর
কিভাবে হলো এই নামকরণ? মাঝির ভাষায়-
-        একদিন লাল নিশান উড়াইয়া একখান ইস্প্রিট বোট আইলোসায়েবরা কি জানি কওয়া কওয়ি করলোহেই সময় গোলক বানুর কবরের সামনে বওয়া আছিল হের স্বামীআধ পাগলা তহনসায়েবরা যখন জিগাইলো তোমার নাম কি? চরের নাম কি? তখন হের খালি একখান কথা
- গোলকীরে, তোর চর আইজ থেইক্কা সরকার লইয়া গেলরে
কতাডা কইয়াই হেও মইরা গেল
সূর্য ডুবো ডুবোপাশাপাশি দুটো সমাধিকোন সৌধ নেইশান্তিতে চির নিদ্রায় শায়িত গোলকবানু আর ভুবনেশ্বরতাদের ছেলে নবা আর আসে না এ চরে
নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়ে চোখের কোনায় জলের উপস্থিতি অনুভব করলামসেই সাথে শুনতে পেলাম তিব্র চিৎকার
-        গোলকীরে, তোর চর আইজ থেইক্কা সরকারে লইয়া গেলরে

কোন মন্তব্য নেই: