রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৩

বেদনার নীল আকাশ


বেদনার নীল আকাশ

নুরুল্লাহ মাসুম


সন্ধ্যা রাতস্ট্রীট ল্যাম্প জ্বলছেঢাকার রাস্তায় গাড়ী চলছেড্রাইভার ছাড়া গাড়ীতে আরোহী একজন, স্যুটেড-বুটেডবড় কোম্পানির এক বড় কর্তা-ধ্রুব

বহুতল ফ্ল্যাটের গেট খুলে দেবে গার্ডদূরে দাড়িয়ে থাকা আরেকজন গার্ডধ্রুবকে স্যালুট দেবে এক গার্ড গাড়ী থামবেধ্রুব নামতে থাকবে, ড্রাইভার দরজা খুলে দেবে

লিফটে ধ্রুবসপ্তম তলায় নামবেঘরের দরজায় বেল বাজাবেদরজা খুলে যাবে, খুলে দেবে হালিমা

তিন বেডের ফ্ল্যাটের ড্রয়িং রুম পেরিয়ে ধ্রুব দরজা খুলে নিজের ঘরে ঢুকতে যাবেহালিমা তার হাতে একটা বড় খাম তুলে দেবেখাম হাতে নিয়ে ধ্রুব নিজের ঘরে প্রবেশ করতে করতে হালিমাকে প্রশ্ন করবে -
- অতসী কোথায় রে?
নেপথ্যে হালিমার কণ্ঠ
- বিকাল বেলা বাইরে গেছে ভাইজান
- কোথায় গেছে কিছু বলে গেছে?
- কিছু কইয়া যায় নাই
- কখন ফিরবে কিছু বলেছে?
- না ভাইজান
ঘরে ঢুকে টেবিলে খামটা রাখে ধ্রুবটাই খুলে সোফায় গা এলিয়ে দেয়ক্লান্তি-অবসাদ দূর হলে খানিক বাদে উঠে টেবিল থেকে খামটা নিয়ে সোফায় ফিরে আসেআরাম করে অলস ভাবে বসে খামটা খোলে সে
হাতে নেয় মাধবীর পাঠানো ডিভোর্স লেটারএকটা হালকা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে¯^গত কণ্ঠে বলে
-         জানতাম, এমনটাই হবে
-          
বাথ রুম থেকে বেরুচ্ছে ধ্রুবপড়নে টি-শার্ট ও সাদা ট্রাউজারসোফায় বসে টেলিভিশন অন করে
অস্থির একটা ভাব পরিলক্ষিত হয়বারবার চ্যানেল বদলায়
নেপথ্যে হালিমার কণ্ঠ
- খাবার দিমু ভাইজান?
- না
ক্ষানিক বাদে হালিমার প্রবেশবলে
- খাইয়া লন ভাইজানখালার আইতে দেরি হইবো মনে হয়
- খাবার টেবিলে রেখে শুয়ে পড়গে যা
হালিমা আর কোন কথা না বলে চলে যায়ধ্রুব টেলিভিশনের চ্যানেল বদলাতে থাকে

ক্লোজ আপে ধ্রুবটেলিভিশনের দিকে তাকিয়েসহসা ওভার ল্যাপিং হয়ে দেখা যাবে পাহাড়-পর্বত-নদীবাংলার বিশাল অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতিধীরে ধীরে ধ্রুবর চেহারা আবছা হয়ে যাবেপ্রকৃতির অস্তিত্ব বাড়বে

পল্লীর ছোট এক খালছোট্ট নৌকায় বৈঠা হাতে ধ্রুবধ্রুবর কোল ঘেঁষে বসে মাধবীপ্রথম জীবনের মধু চন্দ্রিমামনভোলানো আবহ সংগীত র্দশ্যটিকে মধুময় করে তোলেশব্দহীন কথা বার্তাদুষ্টুমীর ভাব ফুটে উঠবেনেপথ্যে কলিং বেলের শব্দে ধ্রুবর কল্পনা হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে

পূর্ববর্তী দৃশ্যের ধারাবাহিকতায় ধ্রুবর চেহারা পর্দায় স্পষ্ট হবেচম্কে উঠবে ধ্রুবনিজেকে সামলে নিয়ে একটু জোড়ে বলবে
- হালিমাজেগে আছিস? দেখতো অতসী এলো বোধ হয়
- যাই ভাইজান
হাটার শব্দ এবং কিছু সময় ব্যবধানে দরজা খোলার শব্দ শোন যাবেধ্রুব সোজা হয়ে সোফায় বসবে

অষ্টম দৃশ্যের ধারাবাহিকতাধ্রুব সোফায় বসেঅতসী ঘরে প্রবেশ করবেপোশাকে পরিষ্কার বোঝা যাবে সে সংস্কৃমনা উদার স্বভাবের মেয়েবিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েবাবাকে খুব ভালবাসেঅনুভব করে অন্তর দিয়ে
বাবার কাছে এসে জানতে চায়
- বাবা, শরীর খারাপ করেছে?
- নারে
- তবে?
- তোর অপেক্ষা করছি, এক সাথে খাব
- সরি বাবাদেড়ি হয়ে গেলজাস্ট এ মিনিট, আমি এক্ষুণি আসছি
কথাগুলো বলে দ্রুত নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায় সে
মেয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধ্রুব

১০
খাবার টেবিলআভিজাত্যের ছাপ রয়েছে ডাইনিং রুমের সজ্জায়ছোট খাবার টেবিল, চেয়ার তিনটেবাবা মেয়ে খেতে বসেছেহালিমা খাবার তুলে দিচ্ছে
- মার চিঠি পেয়েছে বাবা?
- হুমাথা দুলিয়ে খেতে খেতে বলে ধ্রুব
এরপর নিরবতাঅতসী কোন কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে নেয়বাবার আগেই খাওয়া শেষ করেবেসিনে হাত ধুয়ে হাত মুছতে মুছতে বলে
- গুড নাইট বাবা
আদরের স্বরে ধ্রুবও বলে
-         গুড নাইট, হ্যাভ অ্যা নাইস ড্রিম

১১
ধ্রুব বেড রুমেগাউন চাপিয়ে বিছানার পাশে ইজি চেয়ারে বসার আগে মাধবীর পাঠানো চিঠিটা হাতে নেয়চেয়ারে বসে মনোযোগ দিয়ে পড়েএ সময়ে আবছা আবছা মাধবীর চেহারা পর্দায় দেখা যাবে
পড়া শেষ হলে চেয়ার থেকে উঠে বিছায় গা এলিয়ে দেবেহাতের চিঠিখানা বিছানার ওপরে আলতো করে পড়বেচোখ বুজতে বুজতে বালিশে মাথা রাখবেধীরে ধীরে লং শটে চলে যাবে সে
পরবর্তী দৃশ্য ফ্ল্যাশ ব্যাকে

১২
ধ্রুবর নিজস্ব অফিসবড় আকারের টেবিলে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে সেদরজা খোলার শব্দে মুখ তুলে তাকায় ধ্রুব
দরজা খুলে মাধবীর প্রবেশসামনের চেয়ারে বসতে বসতে হাত ব্যাগ থেকে একটা খাম বেড় করবেখামটা ধ্রুবর হাতে দিয়ে বলে
- আমার একটা স্বপ্ন পূরণ করবে নিশ্চয়ই!
ধ্রুব খামটা খুলে দেখবেপড়া শেষ করে বলে
- কংগ্রাচুলেশন! (মাধবীর মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠবে)তবে খরচটা বড্ড বেশী
- তা হোক, আমার এটা চাই-ই চাই
ধ্রুব একটু ভেবে বলে
- ভেবে দেখি, কি করা যায়
- ভাবার কোন অবকাশ নেইআমায় যেতেই হবেযে করেই হোক একটা ব্যবস্থা তোমাকে করতেই হবে
চিন্তাযুক্ত হাসিমাখা মুখে ধ্রুব বলে
- ওকে মাই ডিয়ারতোমার জন্য প্রয়োজনে বনবাসী হবতুমি যাচ্ছ
মাধবী আহ্লাদিত হয়ে বলে
- গুড! তোমাকে ধন্যবাদ দেব নাবাড়ী ফিরে এসো, তোমার পাওনা মিটিয়ে দেব
ওদের দুজনই ধীরে ধীরে লং শটে চলে যাবে এবং ফ্ল্যাশ ব্যাক এর সমাপ্তি ঘটবে-ওভার ল্যাপিং হবে পূর্ববর্তী দৃশ্য

১৩
ধ্রুব বিছানায় পাশ ফিরে শোবেবিছানা থেকে উঠে চিঠিটা টেবিলে রাখতে রাখতে স্বগতোক্তি করবে
- সত্যিই তুমি শেষ পাওনাটা মিটিয়ে দিলে মাধবী
ঘুমিয়ে যাবে ধ্রুব

১৪
খাবার টেবিলে ধ্রুব অতসীর অপোয়হালিমা খাবার নিয়ে আসেতার কাছে ধ্রুব জানতে চায়
- অতসী উঠেছে?
- জীউঠছেনআহনি আইতাছেন
বলে রান্না ঘরের দিকে যায় হালিমা
পরক্ষণেই অতসী আসবেটেবিলে বসবেবাবা মেয়ের একত্রে সকালের খাওয়াটা বহুদিনের অভ্যাস
খেতে খেতেই অতসীর মোবাইল বেজে ওঠে
অতসী বিরক্ত হয়ে মোবাইল ধরেওদিকের কণ্ঠ শুলে গলার ¯^র শান্ত হয়বলে
- বলো, গিরি--------.তাই? ------------ ওকে ------ আমি আসছি------হ্যা হ্যা এক্ষুণি রওয়ানা দিচ্ছি
ফোনটা রেখে জলদি খাবার শেষ করে
- এত তাড়া কেন মা?
- গিরি ডেকেছে বাবাচারু কলায় একটা অনুষ্ঠান আছে
টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে বলে
- আমি চলি বাবা
- খাবারটা শেষ করে যা
- সরি বাবালেট হয়ে যাবে
বলেই সে নিজের ঘরের দিকে যায়ধ্রুব একাই খেতে থাকেঅল্প সময় বাদে অতসী ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলবে
- বাই-ই, বাবা
মেয়ের চলে যাবার দিকে তাকিয়ে অন্যমনষ্ক হয়ে যায় ধ্রুব
অতসীর চলে যাবার দৃশ্যের ওপর ওভার ল্যাপিং হয়ে পর্দায় ভেসে উঠবে ছয় বছর আগের একটি দৃশ্য

১৫
ধ্রুব খাবার টেবিলেপরিপাটি পোশাকে মাধবী এসে পাশে বসবেএকটু আদরের কণ্ঠে, ভালবাসার আবেগ জড়িয়ে মাধবী বলে
- রাগ করেছ?
- নাহ!
- খাচ্ছ না যে?
- তোমাকে ছাড়া খেয়েছি কখনো?
- কাল থেকে তো একাই খেতে হবে
- হুম! প্রথম প্রথম কয়েকটা দিন কষ্ট হবেএক সময় সহ্য হয়ে যাবেতা ছাড়া মাত্র তো ছয়টি বছরতারপর তুমি আমি আবারো এই টেবিলে বসবো....
- তা তো বটেইতোমায় ছেড়ে থাকতে আমারও কষ্ট হবেতবে ডিগ্রীটা আমার দরকার
- অবশ্যই
একরাশ নিরবতা
মুখে ক্লেশ নিয়ে বলছে মাধবী
- তুমি কি আমার ওপর অভিমান রাখবে?
- কেন, বলোতো?
- তোমার কতগুলো টাকা গেলোব্যবসা গেলৃচাকরী করে কত টাকা আর পাবে ভাবছি
- ওটা তোমায় ভাবতে হবে নাআমি আর অতসী তো? কোন না কোনভাবে দিনগুলো কেটে যাবে
এমন সময় অতসীর প্রবেশপড়নে স্কুলের পোশাক
- মা, তুমি সত্যি প্যারিস যাচ্ছ?
- সন্দেহ আছে তোমার?
- তুমি আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবে?
- কষ্ট হবেতবে, থাকতে যে আমাকে হবেই
এ সময়ে ক্লোজ আপে ধ্রুবর চিন্তিত চেহারা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাবেওভার ল্যাপিং হবে নতুন দৃশ্য

১৬
অফিসে টেলিফোন ধরে ধ্রুব কথা বলছেআবহ সংগীত থাকবেকথা থাকবে নাধ্রুবকে বিচলিত দেখা যাবেআবহ সংগীত ধীরে ধীরে কমে আসবেটেলিফোন রেখে দেবে সে
ক্লোজ আপে ধ্রুব স্বগতোক্তি করবে
- কি সব আজে বাজে কথা বলছে ওরা! শিল্পী হিসেবে তার দুচারটা বন্ধু থাকতেই পারেতাই বলেৃ
ফেড হয়ে পরবর্তী দৃশ্যে চলে যাবে

১৭
ধ্রুবর চোখ জানালা থেকে বাইরের আকাশেকালো মেঘের ভেলা আকাশে আনাগোন করছে.. খুবই হালকাক্যামেরা আকাশ থেকে ক্রমে গাছ-পালার দিকে নেমে আসবেএক নজরে প্রকৃতি দেখিয়ে লং শটে আসবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ

১৮
বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে ছেলে-মেয়েরা হাটছেলং শট ক্রমে মিড শটে পরিণত হবেগিরি আর অতসী পাশা-পাশি হাটছেপ্রথমে পেছন থেকে ওদের দেখা যাবেপরে সামনে থেকেগিরি বলছে
- তোর মন ভাল নেই বলে মনে হয়?
- কৈ, নাতো! আমি ঠিক আছি
- অমন চুপসে আছিস কেন তাহলে?
- ভাবছি
- কি ভাবছিস?
- বাবার কথা
গিরি জানে, অতসীর বাবা একাঅতসীর মা কাছে নেইগিরি এও জানে শিল্পীদের মতিগতি কেমন হয়মৃদু হেসে সে বলে
- তোর বাবার কি হলো হঠাৎ করে?
- মার দেয়া আঘাতটা কেমনে সামলাবেন তাই ভাবছিবড্ড চাপা ¯^ভাবের মানুষকোন দুঃখই কাউকে শেয়ার করেন না
- সেই-ই তো ভালকেউ কিছু জানলো না
- তুই বুঝবি নাচুপ কর
গিরি শান্ত কণ্ঠে অতসীকে বোঝাবার চেষ্টা করে
- শোন, কাঠ নিজে জ্বলেঅন্যকে উত্তাপ দেয়তোর বাবাও অমনিভাবিস না
- তুই বুঝবি নারে গিরি (প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে সে)
- কাঠ পুড়ে গেলেও বিনষ্ট হয় না, হয় কয়লা; আবারো জ্বলেহয় ছাইতাও কাজে লাগে
- কি বলতে চাইছিস তুই?
এসময়ে ওরা একটা গাছের নিচে বসে
- তোর বাবা, দেখবি মোটেও ভেঙ্গে পড়বেন নাতাঁদের মত মানুষ সমাজে খুব বেশী একটা জন্মায় নাদেখিস সব সামলে নিয়ে তিনি ঘুরে দাড়াবেন
- তুই কি বলতে চাস, বাবা আবার বিয়ে করবেন?
- নাহতাতো বলিনি
- তবে?
- তোর মার জন্য সব কিছু বিক্রি করে দিয়েও তিনি তোকে ভালভাবেই ভরণ-পোষণ করছেন, তাই না?
- হ্যা
- তবে ভয় কেন? দ্বগ্ধ কয়লার মত তিনি নতুনত্ব এনে দেবেন তোর জীবনেএক্কেবারে কিচ্ছু ভাবিস না
আবহাওয়া সংগীতের কারণে ওদের আর কোন কথা শোন যাবে নাক্রমে ওরা দুজন লং শটে চলে যাবে

১৯
ঘরের জানালা দিয়ে দিগন্তে পানে তাকিয়ে ধ্রুবঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা নগরীর দৃশ্য মিড শট থেকে লং শটে চলে যাবেওভার ল্যাপিং হয়ে ঘন বনানী ধীরে ধীরে পর্দায় ভেসে উঠবে

২০
বনের মধ্যে একাকী হাটছে ধ্রুবসাদা ধোঁয়ার হালকা আনাগোনা রয়েছেআনমনে হাঁটবে সেদুএকটা গাছের পাতা ছিঁড়বে
ধ্রুবর স্বগতোক্তি
- মাধবীকে নিয়ে অনেকের অনেক কথা আমি কোন দিন কানে তুলি নিসেটা কি আমার দুর্বলতা ছিল? নাকি উদারতা? মাধবী খুঁজে পেয়েছে স্বীয় পথআমি আত্মজা নিয়ে দায়িত্ব পালন করেছি সাধ্যমতকিন্তু ........ কেন এমন হলো? ........ (করুন মিউজিক বাজবে)
ধ্রুব আবারো আনমনে ভাববে
- মাতৃহারা কন্যা সম্প্রদানেও যখন বাধা আসে, সেখানে মায়ের চলে যাওয়াটা কন্যার কি কল্যাণ বয়ে আনবে? সমাজকে কি দিয়ে বোঝাব? আমাদের সমাজ কি আমার মত উদার? নাকি আমার মত বোকা?
আকাশের দিকে তাকিয়ে
- আমি কি উদার না বোকা? (কথাগুলোর প্রতিধ্বনি হবে)
- কি হবে অতসীর? (প্রতিধ্বনি হবে)
- কাকে শোনাবো আমার এ না বলা কথা?
- কাকে দেখাবো এই বেদানার এ নীল আকাশ? (প্রতিধ্বনি হবে)
নীল আকাশে ভাসমান কালো মেঘের আনাগোনা বাড়তে থাকেদৃশ্যপট থেকে বিদায় নেয় ধ্রুব।

কোন মন্তব্য নেই: