রবিবার, ১২ মে, ২০১৩

কোন্ পথে চলেছে দেশ?


কোন্ পথে চলেছে দেশ?

নুরুল্লাহ মাসুম


গত সপ্তাহজুড়ে দেশের অবস্থা দেখে সাধারণের মনে প্রশ্ন জাগছে, কোন্ পথে চলেছে দেশ? যে কোন গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদের শেষ বছরে বিরোধী দল নিজ নিজ কর্মসূচী নিয়ে র্নিবাচনী প্রচারণায় নামবে, সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরে ভোটারের মন কাড়বে- এটাই স্বাভাবিকতবে বাংলাদেশ যেন একটু ব্যাতিক্রমী দেশএখানে সরকার পরিবর্তনে গণতান্ত্রিক ধারা চলছে দুদশকেরও বেশী সময় ধরেতবে কোন পরিবর্তনই রক্তপাতহীন হয়নিহরতাল যেমন গণতান্ত্রিক অধিকার তেমনি হরতাল না মানাও জনগণের স্বীয় এখতিয়ারভুক্ততবে আমাদের দেশে জনগণের সেই অধিকারটুকু হরণ করেছে বিরোধী দল গুলোফলে প্রতিটি হরতালেই জান-মালের ক্ষয়-ক্ষতি একেবারেই যেন মামুলী ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে
ক্ষমতাশীন মহাজোট সরকার হাইকোর্টের আদেশের কিয়দংশ মেনে যেদিন সংবিধান পরিবর্তন করে তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়, সেদিন থেকেই বিরোধী জোট একটা মওকা পেয়ে যায়সরকার বিরোধী আন্দোলনে সংবিধান পরিবর্তন যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেবার মত হয়ে উঠলসাথে যুক্ত হয় মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারসরকারী দল ও জোট শুরু থেকেই বলে আসছে, মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার বানচালের জন্য বিরোধী দল এ আন্দোলন করছেমানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের প্রক্রিয়ায় সরাসরি অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামী নামক দলটিতো এর বিরোধিতা করবেইঅবাক হতে হয়, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যখন মানবতা বিরোধী অপরাধএর বিচার চাইলেও এ সংক্রান্ত ট্রাইবুনালের আন্তর্জাতিক মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে এর বিরোধিতা করে এবং যুদ্ধাপরাধী জামাতের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করে; ক্ষেত্র বিশেষে জ্বালাও পোড়াও জাতীয় কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হয়মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল থেকে বিচারের রায় প্রদানের দিন থেকে জামায়াত ধংসাত্মক কার্যক্রম করে যাচ্ছে, এর বলি হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকেট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়কে কেন্দ্র করে রাজধানীর শাহবাগে গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চএ নিয়েও রাজনীতি কম হয়নিদেশের তরুণ প্রজন্ম, যারা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি- মূলত তাদের উদ্যোগেই শুরু হয় শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চপ্রগতিশীল সকল মানুষসহ সাধারণ মানুষ তাদের প্রতি আস্থাশীল হয়ে দলে দলে সমবেত হয় শাহবাগেদেশের প্রতিটি জেলায়ও গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে ওঠেসরকারও তাদের প্রতি সহানুভুতিশীল ছিল প্রথম থেকেইগণজাগরণ মঞ্চের দাবীর মুখেই সংসদে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করা হয় দ্রুততার সাথেসেদিন থেকেই গণজাগরণ মঞ্চের কার্যক্রম শিথিল করার ঘোষণা আসেবিষ্ময়কর ঘটনা ঘটে সে রাতেইগণজাগরণ মঞ্চের কার্যক্রম শিথিল করার ঘোষণা দেবার দুই ঘন্টার মধ্যে এক ব্লগার- রাজীবকে নির্মমভাবে হত্যার করার মধ্য দিয়েচলতে থাকে গণজাগরণ মঞ্চের কার্যক্রমএরই মধ্যে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম নামের একটি অরাজনৈতিক সংগঠনতারা শাহবাগের তরুণদের ঢালাওভাবে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে তাদের প্রতিরোধে মাঠে নামেফলে গণজাগরণ মঞ্চ চট্টগ্রামে তাদের নির্ধারিত সমাবেশ করতে পারেনিসরকারের ভাষ্যানুযায়ী সংঘর্ষ এড়াতে নির্ধারিত দিনে ১৪৪ ধারা জারি করে সকল ধরণের সমাবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়
বিএনপি গণজাগরণ মঞ্চের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে সাত দিনের মাথায় একটা সতর্ক অবস্থান নেয় এবং পরবর্তীতে হেফাজতের নাস্তিক ঠেকাও আন্দোলনে সহযোগী হয়ে ওঠেঢাকায় হেফাজতের বিশাল সমাবেশ হওয়ার পরে তাদের কর্মোদ্যগ বেড়ে যায়৫ মে তারা ঢাকা অবরোধের ঘোষণা দেয়প্রথম দফায় মহাজোটের শরীক জাতীয় পার্টি হেফাজতের পাশে থাকে প্রকাশ্যেবিএনপিও সে সময়ে তাদের সমাবেশে গিয়ে সমর্থন জানায়হেফাজত ১৩ দফা দাবী নিয়ে ৫ মের কর্মসূচী ঘোষণা করেযে ১৩টি দফা তাদের রয়েছে, সকলেই তা ইসলামী বললেও তাদের সেই দাবীগুলোর মধ্যে যুদ্ধাপরাধ বা মানবতা বিরোধী অপরাধের বিষয়ে কোন কথা না থাকায়, ¯^ভাবতই প্রশ্ন থেকে যায়, তারা কি জামায়াতের বি-টিম হিসেবে মাঠে নেমেছে? কোন কোন মিডিয়া খবর দেয়, হেফাজতের অনেক নেতাই এক সময়ে জামায়াতের ছাত্র ফ্রন্ট শিবিরের সক্রিয় নেতা বা কর্মী ছিলেনএক পর্যায়ে সাধারণের মনেও প্রশ্ন জাগে আসলেই কি হেফাজত ইসলাম প্রতিষ্ঠায় মাঠে নেমেছে, না কি জামায়াতের কর্মসূচী বাস্তবায়নে সহায়ক ভমিকা পালন করছে?
বাস্তবতার নীরিখে হেফাজতের ১৩ দফা দাবী বর্তমান সরকার কেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও মানতে পারতো না বলেই প্রতীয়মান হয়বিশেষত নারীর ক্ষমতায়নের বিরোধিতার বিষয়টি সামনে  চলে আসেনারী সংগঠনগুলো ভীষণভাবে এর প্রতিবাদ জানায়অন্যদিকে হেফাজত যেহেতু শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা দিয়েই তাদের উপস্থিতি দেশব্যাপী তুলে ধরে, গণজাগরণ মঞ্চও হেফাজত ঠেকাবার কথা বলে সংগঠিত হয় নতুন করে- নবোদ্যমে
এমনি এক অচলাবস্থার মধ্য দিয়ে যখন দেশ চলছে, ঠিক সে সময়ে ঘটে দেশের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়- সাভারের রানা প্লাজা নামের একটি নয় তলা ভবন ধসের ঘটনাদেশর সবচেয়ে বড় এ দুর্ঘটনায় সকল স্তরের মানুষ এগিয়ে আসে উদ্ধার কার্যেবহুদিন বাদে দেশ দেখতে পায়, দলমত নির্বিশেষে সকলের সহমর্মিতাসাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান- সকলেই সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় মানবতার সেবায়ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় ¯^াচ্ছাসেবী উদ্ধাকারীদের কথা বাংলাদেশ মনে রাখবে বহুদিন¯^চ্ছাসেবী উদ্ধারকারীদের জীবনদানও হয়ে থাকবে চির উজ্জলদুর্ঘটনার দিনে চলছিল বিএনপি তথা ১৮ দলীয় বিরোধী জোটের হরতালদেরিতে হলেও সেদিন তারা ঐ এলাকায় হরতাল শিথিল করে; যদিবা সকলেই আশা করেছিল সারা দেশে হরতাল প্রত্যাহার করা হবেপরে উদ্ধার কাজ সুষ্ঠুভাবে চালানোর স্বার্থে বিএনপির হরতাল প্রত্যাহারে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিএনপি জনগণের কাছে বাহবা পায়আমরাও তাদের সাধুবাদ জানাইতেমনি পরিস্থিতিতে হেফাজত বলে সাভারের দুর্ঘটনা আল্লাহর গজবএবং ৫ মের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচী বহাল রাখে- এই না হলে ইসলাম কায়েম করা যায়! এই না হলে ইসলামী সংগঠন!
নির্ধারিত দিনে হেফাজতের ঢাকা অবরোধ ঠিকভাবেই চলছিলহঠা করেই তারা শাপলা চত্ত¡রে সমাবেশের ঘোষণা দেয় এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগ তাদের অনুমতিও দেয় সকলকে অবাক করে দিয়েএটাই হয়ে ওঠে কালসমাবেশ শুরু থেকেই দফায় দফায় সংঘর্ষ ঘটে পুলিশের সাথে এবং তারা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ দখলের প্রচেষ্টা চালায়, যদিও তা সফল হয়নি
ঢাকা অবরোধ শেষে শাপলা চত্ত¡রের সমাবেশ থেকে হেফাজতিদের যুদ্ধাপরাধ বা মানবতা বিরোধী অপরাধীদের মুক্তির দাবী সম্বলিত স্লোগান তাদের অবস্থানকে পরিস্কার করে দেয়পুলিশের ভাষ্যমতে হেফাজতের সমাবেশ বিকেল পাঁচটার মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তারা সেখানে অবস্থান করতে থাকে এবং তাদের ১৩ দফা না মানা পর্যন্ত শাপলা চত্ত্বর ছাড়বে না বলে ঘোষণা দেয়বিকেল নাগাদ হেফাজতের সমাবেশ হয়ে ওঠে ধংসাত্মকআগুন দেয়া হয় বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে, এমনকি তাদের আগুনের হাত থেকে রেহাই পায়নি পবিত্র কোরআন শরীফওবায়তুল মোকাররমে অবস্থিত বহু ইসলামী বইয়ের দোকানে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় হাজার হাজার কোরআন শরীফ ও অন্যান্য ইসলামী বইফুটপাতের হাজারো হকারের দোকান পুড়ে মাটিতে মিশে যায়রেহাই পায়নি ব্যাংকের এটিএম বুথগুলোওপুলিশ তাদের সরে যেতে বললেও তারা সে আদেশ মানেনিফলে গভীর রাতে সরকারের নির্দেশে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি যৌথ অভিযান চালিয়ে তাদের শাপলা চত্ত¡ থেকে বিতারিত করেপরদিন সকালে দেখা যায় মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার ধংসযজ্ঞক্ষতির পরিমান নিয়ে নানান মিডিয়াতে নানান কথা বলা হয়েও প্রকৃত ক্ষতির পরিমান জানতে আরো সময় লাগবে
ইসলাম শান্তির ধর্মসেই ইসলামের নামে হেফাজতের ধংসাত্মক কার্যক্রম কারো পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয়দেশের জন্য এ জাতীয় কার্যক্রম মোটেও কল্যাণকর নয়হেফাজতের মহাসচিব পুলিশ হেফাজতে আছেন, ক্রমেই জানা যাবে তাদের মাঠে নামার প্রকৃত উদ্দেশ্যহেফাজত যে বিএপি-জামায়াতের পক্ষে কাজ করছিল তা বোঝা যায় হেফাজত নেতা বাবুনগরীর বক্তব্যেপুলিশের কাছে তার স্বীকারোক্তির কথা সকল মিডিয়া প্রচার করেছে
এমনিতে সাভার দুর্ঘটনার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ স্বীয় অবস্থান ধরে রাখার সংকটে রয়েছেএর ওপর হরতাল-অবরোধ নানাবিধ কারণে দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের অবস্থাও ক্রমে অবনতি ঘটছেআমাদের প্রশ্ন, এমনি ক্ষয়-ক্ষতির মধ্য দিয়ে আরেকটি নির্বাচন শেষে মহাজোট, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি বা জাতীয় পার্টি- যেই দলই ক্ষমতায় আসুক, তারা কি পারবে দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে? পরিস্কার উত্তর হচ্ছে- নাতখন তারা জনগণের মাথার ওপর ট্যাক্সের বোঝা বাড়িয়ে দেশ চালাতে চাইবেন; যা হবে জনগণের জন্য কঠিন এক শাস্তি
অব্যাহত অচলাবস্থা যে কোন দেশের জন্যই সুখকর নয়যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় আরোহনের প্রচেষ্টা প্রতিটি রাজনৈতিক দলের জন্যই ক্ষতিকারকদেশের অর্থনীতি যদি ভেঙ্গে পড়ে, ক্ষমতায় গিয়ে তারা কি করবে? প্রধান দলগুলো নেতৃস্থানীয় যারা রয়েছেন, তারা কি এটা বোঝেন না? না বোঝার কথাতো নয়তবে কি দেশের আপামর জনসাধারণ ধরে  নেবে বা ভাববে, তারা জেনে হোক বা না জেনে হোক- ভিন্ন কোন দেশ বা এজেন্সীর এজেন্ডা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছেন? নইলে একের পর এক দেশের জন্য ক্ষতিকর কর্মকান্ডে তারা সম্পৃক্ত হচ্ছেন কেন? এমন কার্যকলাপ পরিচালনা করছেন কেন, যা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না?
মুখে গণতন্ত্রের কথা বলবেন, কথায় কথায় পশ্চিমা গণতন্ত্রের উদাহরণ টানবেন; অথচ তাদের গণতন্ত্র চর্চার পথ অনুসরণ করবেন না, তাহলে গণতন্ত্র বাঁচবে কেমন করে? রাজিৈনতক দলগুলোর কাছে দেশের জনগণ কি আশা করতে পারেন না যে, তারা প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চা করে দেশের কথা ভাববেন! বিরোধী দলে থেকেও তো দেশ সোব করা যায়সরকারের কাছেও জনগণের প্রত্যাশা ক্ষমতায় গিয়ে যেন তার না ভাবেন, এ ক্ষমতা চিরদিনের জন্য তাদের হয়ে গেলজনগণ আপনাদের ক্ষমতায় বসায় পাঁচ বছরের জন্য; সুতরাং তাদের কথা ভাবুন, দেশের কথা ভাবুনতবেই হয়ত বাংলাদেশ অর্থনীতির ক্ষেত্রে কাগুজে বাঘ থেকে সত্যিকার অর্থে অর্থনীতিতে সফলতার মুখ দেখবে

শুক্রবার, ৩ মে, ২০১৩

শবের মিছিলে মে দিবস পালিত : মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি আর নয়


শবের মিছিলে মেদিবস পালিত: মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি আর নয়

 নুরুল্লাহ মাসুম


শ্রমিক শ্রেণীর দাবী আদায়ের দিন- মে দিবস এবারে পালিত শত শত শবের মিছিলের মধ্য দিয়ে১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে শিকাগো শহরের হে মার্কেটের সংগ্রামী শ্রমিকদের রক্তের বিনিময়ে মে দিবসের অর্জনআট ঘন্টা শ্রম দিবস এবং নানান দাবী নিয়ে শ্রমিকদের সেই সংগ্রামে ৮/১০ জন শ্রমিকের রক্তের বিনিময়ে যদি বিশ্বব্যাপী অর্জন হয় মে দিবস, তবে বাংলাদেশের সাভারের চার শতাধিক শ্রমিকের রক্তের বিনিমিয়ে কি অর্জন হওয়া উচিত? জানি, এর উত্তর পাওয়া যাবে নাতবু বলতে হয়, এতগুলো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণী, বিশেষত পোশাক শিল্পে নিয়েজিত লাখো শ্রমিক আদৌ কোন দাবী আদায় করতে পারবে কি না- এটাই আমাদের সামনে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্নকেবল মুনাফার লোভে আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এই শিল্পটি এখন সত্যিকার অর্থে হুমকির মুখেএমনিতে আমাদের দেশে শ্রমিকের শ্রমের দাম খুব সস্তাআর এ কারণেই উন্নত বিশ্ব আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকেএ সুযোগটা নেয় আমাদের শিল্প মালিকেরা- এবং এটাই স্বাভাবিক যে, মালিকপক্ষ চাইবে কত কম মূল্যে পণ্য উৎপাদন করে কতটা বেশী মুনাফা করতে পারেএ প্রতিযোগিতা মালিকদের মধ্যে চিরন্তন; ফলত শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত শোষিত হচ্ছে
আমাদের সমাজেই কেবল নয়, বিশ্বের বহু দেশে বিশেষত অনুন্নত দেশগুলোয় নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় কম মজুরী পেয়ে থাকেতবু, আমাদের দেশে অবহেলিত নারী সমাজ পোশাক শিল্পের হাত ধরে স্বাবলম্বীী হবার একটা পথ খুঁজে পিয়েছিলমালিক পক্ষের নানান অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেও নারী শ্রমিকরা নিজ নিজ পরিবারে যেমন স্বাবলম্বীতার ক্ষুদ্র স্তম্ভ হয়ে উঠছিল, তেমনি দেশে অর্জিত হচ্ছে মূল্যবান বৈদেশীক মুদ্রাঅথচ, যাদের দিয়ে এ মুনাফা অর্জন হচ্ছে, সেই শ্রমিক শ্রেণীর উন্নয়নে মালিক পক্ষকে তেমন একটা উৎসাহী দেখা যায় নালাখো বেকারের দেশে শ্রমিকের যেহেতু অভাব নেই, তাই মালিক পক্ষ সেই সুযোগটাই নিয়ে নিচ্ছেখেসারত দিতে হয় স্মার্ট গার্মেন্টস, তাজরীন গার্মেন্টস এবং সবশেষে রানা প্লাজার পাঁচটি গার্মেন্টেস এর শ্রমিকদের- নিজের জীবন দিয়ে
দুর্ঘটনা বলা যায় কি রানা প্লাজা ধসের ঘটনাকে? ভবনে ফাটল দেখে প্রকৌশলী যখন বুয়েট থেকে বিশেষজ্ঞ এনে পরীক্ষার কথা বলেন, তখন ভবন মালিক ক্ষমতার দাপটে বলেন, দু একটা পিলারে ফাটল ধরলে কিছু হয় নাবেতন-ভাতার ভয় দেখিয়ে, মেরে-পিটিয়ে যখন গার্মেন্ট মালিকরা শ্রমিকদের কাজে যেতে- মৃত্যু কপে ঢুকতে বাধ্য করেন; তখন তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হওয়া উচিতঅথচ মিডিয়ার বদৌলতে জানা গেছে, ভবন মালিক ও গার্মেন্টস মালিকদের বিরুদ্ধে এ ঘটনায় মামরা হয়েছে দুর্ঘটনা জনিতফলে মৃত শ্রমিক ও তাদের পরিবারের ন্যায্য বিচার পাওয়া আশা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেলভবন নির্মানের অনুমোদন নিয়ে গেল সপ্তাহে লিখেছিলাম, পৌরসভা বা রাজউক- কে দায়িত্ব নেবে এই মর্মান্তি দুর্ঘটনার? সাভার উপজেলার প্রদান নির্বাহী ইউএনও কি একজন সিভিল সার্ভেন্ট হয়ে (প্রকৌশলী নন) কি করে ভবন নিরপাদ বলে সার্টিফাই করেন? সাভার পৌরসভার মেয়র কি দায়িত্ব অবহেলা করেননি? রাজউক কর্তৃপক্ষও কি দায়িত্ব অবহেলা করেননি? তবু মন্দের ভাল, আই-ওয়াশ হোক বা অন্য কিছু হোক- যে কারণেই হোক বৃহস্পতিবার সাভার পৌর মেয়র বরখাস্ত হয়েছেন, প্রত্যাহৃত হয়েছেন সাভারের ইউএনও; গ্রেফতার হয়েছেন সাভার পৌরসবার দুই প্রকৌশলী এবং সবশেষে ভবনের ডিজাইন করেছেন যে প্রকৌশলী, তিনিও গ্রেফতার হয়েছেনপ্রশ্ন, সাভারের পৌর মেয়র কেন গ্রেফতার হলেন না? ইউএনওকে কেবলি প্রত্যাহার করে কি কোন লাভ হলো? তারা কি আইনের উর্ধে কেউ?
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, যখন মিডিয়া প্রকাশ করে দিল, রানা প্লাজার মালিক রানা ক্ষমতাশীন দলের যুব সংগঠনের প্রভাবশালী নেতা এবং সে বিষয়ে শত শত বিলবোর্ড ও ফেস্টুন দেখা গেছে আমিন বাজার থেকে শুরু করে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত- অর্থাৎ সাভার উপজেলায় অবস্থি প্রতিটি বড় বড় রাস্তার ধারেসেখানে সংসদে দাড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বলছেন রানা যুবলীগের কেউ নয়অবাক হতে হয়, ক্ষমতাশীন দলে অপরাধী থাকবে না- এমন হলফ দেয়া যায় নাযদি থাকে তাদের উপযুক্ত বিচার হবে- শাস্তি পাবেকেন প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতাকে এ নিয়ে সত্যের অপলাপ করতে হবেবরং তিনি বলতে পারতেন, রানা যুবলীগের সদস্য বা নেতা হলেও তাকে গ্রেফতার করে আইনে সোপর্দ করা হবেযদিও শেষ পর্যন্ত রানাকে গ্রেফতার করা হয়েছে- এজন্য ধন্যবাদতবে দায়েরকৃত মামলাটি তাকে শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে আনার কটকৌশল কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়ভবন ধস নিয়ে ¯^রাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্ত্য নিয়ে সমালোচানর ঝড়ের জবাবে তিনি আরো শক্ত হয়ে বললেন, তিনি এমন কোন কথা বলেননি, মিডিয়ার চাল এটাবিবিসির মত আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম কেন এমন চাল চালবেন তার বিরুদ্ধে? বিষয়টা এমন, আমাদের নেতারা যখন কোন কথা বলে ফেঁসে যাচ্ছেন বলে মনে করেন, তখনি বিষয়টি মিডিয়ার ঘারে চাপিয়ে দিয়ে মনে  মনে ¯^স্তি পান।  আমরা কি পারবো এমনতরো ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে!
এবার শ্রমিকদের নিয়ে কিছু বরতে হয়শ্রমিকরা বরাবরই শোষিত; তবু অবাক লাগে যখন কোন কারণে তারা বিক্ষোভ করে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কারণ হয়ে ওঠেনক্ষতি করেন সার্বিক অর্থে দেশেরতাহলে বলতে হয়, তারাও রাজনৈতিক দলের দাবার গুটি হয়ে যাচ্ছেনআমরা আশা করবো- যে প্রতিষ্ঠান আপনার খোরাক জোগায়, সেটি রক্ষা করুন; রাভ আপনার-আমার-দেশের, সকলেরমালিকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে লজ্জা ও ঘৃণায় মনটা বিষিয়ে ওঠেসাভারের ধংসস্তুপের মাঝে যখন নতুন জীবনের আগমন ঘটে, তখন জানতে ইচ্ছে করে, সেই অন্ত¯^ত্তা মা, কেন সরকারী নিয়মানুসারে ছয় মাস বা চার মাস আগে থেকে মাতৃত্বকালীন ছুটি পেলেন না? মালিকদের কাছে জানতে ইচ্ছে হয়, আপনাদের ঘরে কোন নারী কি মাতৃত্ব লাভ করেননি? তাদের জন্য আপনারা কত কিছুই না করেন? তবে, যে শ্রমিক মা আপনার জন্য, দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে আপনাদের সহায়ক, তার মাতৃত্বের জন্য সামান্য প্রস্তুতিটুকুও কি নিতে দেবন না? এখন যদি বলি আপনাদের জন্য কেবল ঐ শ্রমিক মা হত্যার অভিযোগ আনা নয়, অনাগত এক ভবিষ্যত সন্তানের হত্যার অভিযোগে আপনারা অভিযুক্ত- কি উত্তর দেবেন আপনারা? মনুষ্যত্ব বলে একটা কথা এখনো রয়েছেবিষয়টি ভেবে দেখবেন
গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন, কেবল সংগঠন নয়- শক্তিশালী একটা সংস্থা, বিজিএমইএ; প্রতি বছর আপনারা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে নিজেদের নির্বাচন সম্পন্ন করেন, ক্ষমতায় যাবার জন্যআপনারা কি কখনো ভেবেছেন শ্রমিকদের কল্যএণর কথাআপনাদের কি কোন টিম আছে যারা দেখবে শ্রমিকদের অধিকার সঠিকভাবে না হলেও ন্যুনতম সংরক্ষিত হচ্ছে? আপনারা আছেন কেবল মুনাফার দিকে চেয়ে- মানবতা বা মনুষ্যত্ব আপনাদের কাছে কাগুজে শবদ্ মাত্রএকটিবার ভাবুন, যদি এমন কোন দিন আসে, আপনারা কাজ করাবার জন্য কোন শ্রমিক পাবেন না, যেহেতু আপনার শ্রম আইন মানেন নাহাসবেন আমার কথা শুনে; হতেওতো পারে এমনি দিন ঘণিয়ে আসছেতাছাড়া, ন্যুনতম শ্রমিক অধিকার না থাকার কারণে যদি আন্তর্জাতিক বাজার হারান, তখন কি করবেন আপনার? দেশতো বৈদেশিক মুদ্রা হারাবেই, আপনারা কি করবেন- এত মূল্যবান মেশিনারী দিয়ে? বিজিএমইএ-র কাছে জানতে ইচ্ছে করে, দেশে কতজন শ্রমিক গার্মেন্ট শিল্পে কাজ করেন, এমন কোন তথ্য আপনাদের কাছে কি আছে? যদি থাকতো, তাহলে জুরাইন কবরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে শেষ ঠিকানা হতো না ৩২ জন শ্রমিকেরতাছাড়া এ জাতীয় ডাটাবেস দক্ষ শ্রমশক্তি খুঁজে পেতেও সহায়ক হবেএখনো সময় আছে, শ্রমিকদের নিয়ে ভাবুন- এতে আপনাদেরই উপকার হবেবেঁচে যাবে খেটে খাওয়া মানুষগুলোও
ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে দেখেছি, শুনেছি কোন কোন গার্মেন্টস মালিক সরকারী বাধ্যবাধকতা থাকায় শ্রমিকদের জন্য গ্রæপ ইন্স্যুরেন্স করে থাকেন, তবে তা সর্বনিম্ন সংখ্যা দিয়েঅর্থাৎ ২০ জন শ্রমিক থাকলে গ্রæপ ইন্স্যুরেন্স করার বাধ্যবাধকতা তারা ঠিকই পালন করেন ঐ ২০ জন দিয়ে; যদিও সেখানে কর্মরত শ্রমিক শত শত, কোথাওবো হাজার হাজারআশা করবো, সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর বিষয়টি তদন্ত করে দেখবে
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সংসদের বিরোধী দলীয় নেতাসহ অনেকেই আহতদের দেখতে গেছেন, বিরোধী দল উদ্ধারকার্য পরিচালনার সুবিধার জন্য ২ মার্চ আহুত হরতাল প্রত্যাহার করেছেন; সবই ভাল লক্ষণঅন্যদিকে সাভার ট্র্যাজিডিকে সরকারের উপর আল্লøাহর গজব বলে মন্তব্য করে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মাঈনুদ্দীন রুহী বলেছেন, সরকার আল্লøাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেতারই পরিণামে এ গজবতাদের কাছে জানতে চাই, আপনার যখন শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আপামর তরুন-যুবককে নাস্তিক বলে আখ্যায়িত করেন, আপনি কি দেখেছেন, ঐ নাস্তিকেরাই সাভারে আহতদের জন্য সবার আগে রক্ত সংগ্রহ করতে শুরু করেছিল? তারা উদ্ধার কাজেও যোগদান করেছিল? মানবতার কাজটি কি আপনাদের ইসরাম সমর্থন করে না? মুসলিম ছাড়া অন্যরা কি আল্লাহর বান্দা নয়? ইসলাম কি বলে, আর আপনার কি বলেন? যতটা জেনেছি-শিখেছি, একজন মুসলমান অন্য একজন মুসলমানকে নাস্তি বলতে পারে নাতাছাড়া ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটাও ইসলাম সমর্থন করে নাকি বলবেন আপনারা? মানবতার সেবায়, মানবতার পথে আসুন, আমরা জানি দুনিয়ার সকল ধর্ম মানবতার কথা বলে, কেবল উগ্র ধর্মান্ধ মানুষগুলো সেটা মানে না; তাইতো মানবতার এতটা অধপতন