ফিলস্তিনীদের কাছের বন্ধু বাংলাদেশের
মানুষ
বাংলাদেশের আপামর জনতা ফিলিস্তিনীদের
খুব কাছের বন্ধু। প্রায় চার হাজার মাইল দূরে অবস্থান করেও
জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের হাতে নির্মমভাবে নির্যাতিত ফিলিস্তিনী জনগণের পাশেই
রয়েছে তারা সবসময়; এমনটি
ফিলিস্তিনের প্রতিবেশীদের কাছেও পাওয়া যায় না- এমনি কথা বলছিলেন ঢাকাস্থ ফিলিস্তিন
দূতাবাসের উপ-মিশন প্রধান ইউসুফ রমাদান। ৫
আগস্ট মঙ্গলবার সকালে ফিলিস্তিন দূতাবাসে তাঁর সাথে সাপ্তাহিক শারদীয়ার কথা হচ্ছিল। আলাপকালে গাজায় ইসরায়েলী হামলার কারণে
নিহত ও আহতদের প্রতি সমবেদনা জানাতে দূতাবাসে আগত সকল বাঙালির প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা
জানিয়ে ইউসুফ রমাদান বলেন,
বাংলাদেশের
জনগণের সাথে ফিলিস্তিনী জনগণের রয়েছে আত্মার সম্পর্ক। প্রসঙ্গক্রমে তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ
করেন ফিলিস্তিনরে প্রথম প্রেসিডেন্ট ও পিএলও’র প্রতষ্ঠিাতা প্রয়াত ইয়াসির আরাফাতকে। তিনি বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ সফর করেন। বাংলাদেশের স্থপতি ও বাঙালির জাতির জনক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ইয়াসির আরাফাতের যেমন গভীর সম্পর্ক ছিল, তেমনি ছিল প্রেসিডেন্ট
জিয়াউর রহমানের সাথে। ইউসুফ
রমাদান স্মৃতিচারণ করে বলেন,
ইয়াসির
আরাফাত প্রায়শই শেখ হাসিনাকে নিজের কন্যা পরিচয় দিতেন, যেমনটি দিতেন বেনজীর
ভুট্টোকে। তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর
রহমানের শাসনামলেই বাংলাদেশ সরকার ঢাকায় ফিলিস্তিন দূতাবাসের বর্তমান জায়গাটি
বিনামূল্যে বরাদ্দ দিয়েছিলেন।
গাজা, ফিলিস্তিন স্বশাসিত কর্তৃপক্ষের অধীন একটি এলাকা, যেখানে ফিলিস্তিনীদের
বসবাস। অন্য একটি অঞ্চল রয়েছে পশ্চিম তীর-
সেখানেই রয়েছে মুসলমান, খৃষ্টান
ও ইহুদী- তিন ধর্মের পবিত্রস্থান- জেরুজালেম। শুরু থেকেই পশ্চিম তীরে শাসন করছে পিএলও’র সবচেয়ে বড় সংগঠন আল
ফাত্তাহ। অন্যদিকে গাজায় প্রাধান্য রয়েছে হামাসের। সম্প্রতি আল ফাত্তাহ ও হামাসের মধ্যে সমঝোতার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনে
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কোয়ালিশন সরকার। এতেই
ইসরায়েল নাখোশ। সম্মিলিত ফিলিস্তিনকে মোকাবেলার জন্য
নানা অজুহাতে ইসরায়েলসহ পশ্চিমা বিশ্ব হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত
করতে সচেষ্ট। ইসরায়েল হামাসকে দমনসহ অন্যান্য নানা
অজুহাতে গাজায় হামলা চালাচ্ছে;
যদিও
এই হামলায় সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে গাজার শিশু ও নারীসহ সাধারণ মানুষ। ইউসুফ রমাদান মনে করেন, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ যে
কারণেই হামলা করুক না কেন,
তাদের
মূল লক্ষ্য হচ্ছে ফিলিস্তিনী অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় ইহুদী বসতি বাড়ানো। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, বাইবেলে ২৫০ বারেরও বেশী
উল্লেখ করা ‘ফিলিস্তিন’ নামটির মূল হিব্রæ উচ্চারণ হচ্ছে ‘ফিলিসিট’- যেটি ইংরেজীতে ‘ফিলিস্তিয়া’ হিসেবে অনূদিত হয়েছে। তবে ল্যাটিন উচ্চারণ ‘প্যালেস্টাইন’ খুব বেশী সমাদৃত হয়ে আসছে। আরবীতেও ‘ফিলিস্তিন’
উচ্চারিত
হয়। এই ‘ফিলিস্তিন’
এলাকার
রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস, সে
ভিন্ন প্রসঙ্গ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে জাতিসংঘের
ছত্রচ্ছায়ায় বৃটিশরা সারা বিশ্বের ইহুদীদের একত্রিত করে ‘ইসরায়েল’ নামে এক অদ্ভুত রাষ্ট্রের
পত্তন ঘটায় ১৯৪৮ সালে। মূলত
খৃষ্টান ও মুসলমান অধ্যুষিত ফিলিস্তিন এলাকায় গড়ে ওঠে এক ইহুদী রাষ্ট্র, যা কিনা আজো বহু মুসলিম
দেশ কর্তৃক স্বীকৃতি পায়নি। ইউসুফ
রমাদান এর ভাষায় ১৯৪৮ সালের আগে ফিলিস্তিন ভূ-খন্ডে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১৫ শতাংশ ছিল খৃষ্টান, ৭ শতাংশ ছিল ইহুদী এবং ৭৮
শতাংশ ছিল মুসলমান। বৃটেন
ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভের পর প্রায়
সাত লক্ষ মুসলমান দেশত্যাগে বাধ্য হয় এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে আরব ও ইসরায়েল
যুদ্ধের কারণে বহু মুসলমান মৃত্যুবরণ করে এবং তার চেয়েও বেশী মুসলমান দেশত্যাগে
বাধ্য হয়। ফলে মূল ফিলিস্তিন ভূ-খন্ডে মুসলমান জনসংখ্যা
ক্রমাগত কমে আসতে থাকে। জাতিসংঘের
দেয়া সীমা অতিক্রম করে ইসরায়েল তাদের জনবসতি বাড়ানোর প্রক্রিয়া অব্যহত রাখে এবং
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইহুদীদের নিয়ে এসে পুনর্বাসিত করে মুসলমানদের নিজভূমি
ফিলিস্তিনে।
সর্বশেষ ২০১৪ সালে মুসলমানদের পবিত্র সিয়াম সাধনার
মাসে ইসরায়েল আবারো হামলা চালায় গাজায়, হামাসকে শিক্ষা দেবার নামে; ফলাফল সহস্রাধিক নিরীহ নারী ও শিশুর নির্মম মৃত্যু। পুরো বিশ্বকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, মানবতাবদীদের অবাক করা
নীরবতার মধ্য দিয়ে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ ক্রমাগত মানবতা বিরোধী অপরাধ করে চলেছে
ফিলিস্তিনে। বিশ্বব্যাপী শান্তিপ্রিয় মানুষ প্রতিবাদ
করে চলেছে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে। বাংলাদেশও
এর ব্যতিক্রম নয়। ইউসুফ
রমাদান জানান, তাদের
এমন দুর্দিনে বহু বাংলাদেশী দূতাবাসে উপস্থিত হয়ে সমবেদনা জানানোসহ তাদের সাধ্যমত
নানান রকম সহায়তা প্রদান করেছেন। বাংলাদেশ
সরকারও ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়েছে। সাবেক
প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া নিজে দূতাবাসে উপস্থিত হয়ে সমবেদনা জানিয়ে একাত্মতা
প্রকাশ করে গেছেন এবং অর্থসহয়তাও দিয়েছেন। ইউসুফ
রমাদান বাংলাদেশ সরকার ও সকল বাঙালির প্রতি এই সহমর্মিতার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। প্রসঙ্গত তিনি বলেন, বাংলাদেশে যে দলই সরকারে
থাকুক না কেন, ফিলিস্তিনিরা
বাংলাদেশের সহমর্মিতা পেয়েছে সবমসময়।
ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানো যাক, ভ‚মধ্যসাগর বিধৌত
ফিলিস্তিনের প্রায় ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমির ৭৬ শতাংশ দখল করে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইসরায়েল রাষ্ট্র। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের ১৯৪ নম্বর
সিদ্ধান্ত মোকাবেক ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল নামক দু’টি রাষ্ট্র ঘোষণার ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে
ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, we agreed to establish the State of
Palestine on only 22% of
the territory of historical Palestine- on all the Palestinian Territory
occupied by Israel in 1967.
পশ্চিম
তীর ও গাজা নিয়ে গঠিত ফিলিস্তিনের সেই ২২
শতাংশ জায়গাও ইহুদী বসতি স্থাপনের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের সংখ্যা সংকুচিত করার
প্রয়াস চলছে। ফিলিস্তিনীদের দাবী, স্বাধীন ফিলিস্তিন হবে
ইহুদী, খৃষ্টান
ও মুসলমানদের সম্মিলিত নিরপেক্ষ এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। পক্ষান্তরে ইসরয়েল চাইছে দেশটি হবে একটি
ইহুদী রাষ্ট্র।
তারা
জাতিসংঘের দেয়া সীমানা চুক্তিও মানতে চাইছে না। এমনি সময়ে দুর্ভাগ্যজনক হলেও
ফিলিস্তিনীদের পাশে নেই আরব রাষ্ট্রগুলো। মুসলিম
বিশ্বের বৃহৎ
সংস্থা ওআইসি কেন সরব নয় ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে? জাতিসংঘ এমন অবস্থায় বরাবরের মত বিবৃতি
দিয়ে ক্ষান্ত রয়েছে। বিশ্বের
সকল শান্তিপ্রিয় মানুষেরমত বাংলাদেশর জনগণও চায় ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক, ফিলিস্তিনের মুসলমানরা নিজ
দেশে শান্তিতে বসবাস করার সুযোগ পাক।
০৭-০৮-২০১৪
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন