শনিবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০২৪

বরেন্দ্র ও প্রাগজ্যোতিষপুরের তেতুলিয়া - নবম পর্ব

 নুরুল্লাহ মাসুম


নবম পর্ব

১৯৯৭ সালে কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ নাজমুল হকের প্রচেষ্টায় পাথর জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৮ সালে সরকার রকস মিউজিয়াম-এর জন্য একটি দ্বিতল ভবন নির্মাণ করে। উল্লেখ্য, এটি বাংলাদেশের একমাত্র পাথরের জাদুঘর। জাদুঘরে পঞ্চগড় জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক ও লোকজ সংগ্রহ রয়েছে ১,০০০ এরও বেশি। জাদুঘরের দুটি গ্যালারি রয়েছে। ভবনের ভেতরের গ্যালারিতে রয়েছে বিভিন্ন আকৃতি, রং ও বৈশিষ্ট্যের আগ্নেয়শীলা, পাললিক শীলা ও নুড়ি পাথর, সিলিকা নুড়ি ও সিলিকা বালি, হলুদ ও গাঢ় হলুদ বালি, খনিজবালি, সাদা মাটি, তরঙ্গায়িত চ্যাপ্টা পাথর, লাইমস্টোন, পলি ও কুমোর মাটি এবং কঠিন শীলা। এখানে বহু বছরের পুরনো ইমারতের ইট, পোড়ামাটির মূর্তিও রয়েছে। একটি শাল গাছ দিয়ে তৈরি ২২ ফুট দৈর্ঘ্যের ৩০০ বছর পুরনো দুইটি নৌকাও রয়েছে। ভবনের বাইরে রয়েছে বেশ কিছু বড় বড় পাথর। জাদুঘরের ভেতরের গ্যালারিতে একটি জাতিতাত্ত্বিক সংগ্রহশালাও আছে, যেখানে রয়েছে এ অঞ্চলের  আদিবাসীদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র। আছে তিনশ’ থেকে দুই হাজার বছরের পুরনো ইমারতের ইট-পাথরের মূর্তি এবং পোড়ামাটির নকশা। এছাড়াও রয়েছে এ অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যবহৃত কাচিয়া, কাত্তি, ফুতি, খরম, টপুনি, তাড়ি, ঘোট, কিয়া, সিঁদুর দানি। রয়েছে কালনাগ, মনসার পিতলের মূর্তি, বিষহরির মূর্তি, বিষ্ণু-গণেশের মূর্তি, ধাতবপাত্র, প্রদীপ, পঞ্চপ্রদীপ, কুঠি (কাঁশ দিয়ে তৈরি), টার শিকিয়া, ভশ্মীভূত পিঁপড়ার বাসা, হুলির গানে ব্যবহৃত ঢোল, হিন্দু আদিবাসীদের ব্যবহৃত বিয়ের ডালা, প্রবাল পাথর, একতারা, পাথরের সেতুতে ব্যবহৃত আয়ুধ, সাকামচুকি (সাঁওতালদের ব্যবহৃত বিড়ি বিশেষ), তীর-ধনুক, মোঘল সৈনিকদের ব্যবহৃত তরবারি, পাথরের বাটি, জীবজন্তু ও ফুলের নকশা উৎকীর্ণ বাঁশের বেড়া, রাজমহল পাহারের কালো পাথর, বিভিন্ন প্রাচীন মুদ্রাসহ দুর্লভ সব সংগ্রহ।এছাড়া হাজার বছরের পুরনো চুক্তিনামা, মোগল সাম্রাজ্য ও ব্রিটিশ শাসনামলের রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রা সংরক্ষিত আছে। পাথরের ওপরে লেখা চীন-নেপালি লিপির মুদ্রণ রয়েছ। বারো রকমের রঙিন বালু এই মিউজিয়ামকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। জাদুঘর দেখার জন্য ১০ টাকা মূল্যের টিকিট কাটতে হয়, যা কি না নেয়া হয়েছ জাদুঘর পরিদর্শ শেষে।

 

কলেজ চত্তরে, রকস মিউজিয়ামের সামনে একটি ফলক অন্য সকলের মতোই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যেখানে লেখা রয়েছে পঞ্চগড় জেলার প্রথম চা বাগান। ফলকের পেছনেই ছোট্ট পরিসরে কয়েকটি চা গাছের সমন্বয়ে ছোট্ট একটি চা বাগান। এপ্রসঙ্গে ফলকে উৎকীর্ণ তথ্য হচ্ছে, রকস মিউজিয়াম স্থাপনের সময় জেলা প্রশাসকের দেয়া প্রস্তাব মেনে নিয়ে কলেজ অধ্যক্ষ নিজ উদ্যোগে চা গাছের চারা সংগ্রহ করে কি ভাবে সমতলে চা গাছের চাস করলেন। ১৯৯৭ সালের ৫ মে সেই জেলা প্রশাসক এই চা বাগানের উদ্বোধন করেন। এর পর থেকেই পঞ্চগড় ও পরে ঠাকুরগাঁর সমতলে চা বাগান বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়।
সময় হাতে খুব কম, এখনো দেখার অনেক কিছু বাকী। তবে 
তোমধ্যে বুঝে গেছি, সবগুলো স্থান দর্শন করা সম্ভব হবে না এবারের যাত্রায়। এবার আমরা দুপুরের খাবারের জন্য হাজির হই শহরের রহমানিয়া হোটেলে, দুপুর গড়িয়ে বেলা তখন তিনটা। খাবার বর্ণনা দেবার মতো কোন বিষয় নয়, তবে যাদের খাবারের মেনূ্তে বিশেষ নির্দশনা থাকে তাদের জন্য বাইরে খাওয়ার বিষয়টা খুব কষ্টসাধ্য হয়ে থাকে- এটা মেনে নিয়েই ভ্রমনে বের হতে হয়।
মহিউদ্দীন ভাই আগে থেকে ঠিক করেছিলেন পঞ্চগড় সুগার মিল দেখাবেন। সেমতে আমরা সেখানে হাজির হলে অফিস সময় অতিক্রম হয়ে যাওয়ায় আমরা সুগার মিলের ভেতরে যেতে পারিনি। বলে রাখা দরকার, একন চিনি উৎপাদন মৌসুম নয়, মিলের যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষ হচ্ছে, ইক্ষু ম্যসুম শুরু হলেই চিনি উৎপাদনের মৌসুম শুরু হবে। তাই ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসতে হলো। তবে আশার আলো জেগে রইলো, পরদিন সকালে ঠাকুরগায় চিনি কল দেখার সুযোগ পাবো অফিস টাইমের মধ্যেই।
এ পর্যায়ে পঞ্চগড় শহরের কিছু কিছু এলাকা দেখে, বিশেষত পঞ্চগড় রেলওয়ে স্টেশন, যেটি বেশ পরিচ্ছন্ন সেটি দেখা হলো। বর্তমানে পঞ্চগড় রেল স্টেশনের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম- সংক্ষেপে বীমুসিই। এরপরে পঞ্চগড় জেলার সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউনিয়নে প্রবেশ মুখের ফলকের সামনে নেমে ধাক্কা মারতে কয়েকজন নেমে গেলেন। আমি ছবি তুললাম। ইউনিয়নের নামকরণের কারণে এখানে আগত অনেকেই এই ফলকটাকে একবার ধাক্কা মেরে যায় বলে জেনেছি এবং কিছু ছবিও দেখেছি। কেবল আনন্দ করার জন্যই এমনটি করে থাকে পর্যটকরা। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, ঠাকুরগাঁ, পঞ্চগড় সহ দপুরো দেশে এমন কিছু এলাকা ও প্রতিষ্ঠানের এমনকিছু নাম আছে যা সকলের কাছে সমানভাবে গ্রহনযোগ্য নয়, কোনকোনটা তো শুদ্ধ বাংলায় অশ্লিলতার পর্যায়ভুক্ত। কোন কোন ক্ষেত্রে এগুলো পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হলেও অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে এর আক্ষরিক অর্থ মন্দ না হওয়ায় স্থানীয় বাধার মুখে তা পরিবর্তন করা যায়নি বলে জেনেছি।
ধাক্কা মেরে বা ধাক্কা খেয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হলো পরবর্তী গন্তব্য টাঙ্গন ব্যারেজ। টাঙ্গন ব্যারেজ ঠাকুরগাঁ সদর উপজেলার রুহিয়ার রাজাগাঁ ইউনিয়ন পরিষদের চাপাতি গ্রামে অবস্থিত। টাঙ্গন নদী বাংলাদেশ-ভারতের মধ্য দিয়ে সমানভাবে প্রবাহিত। এটি একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। নদীটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। টাঙ্গন পুনর্ভবা নদীর একটি উপনদী। দুদেশের পানি ভাগাভাগি নিয়ন্ত্রণে নির্মাণ করা হয়েছে টাঙ্গন ব্যারেজ। এটি ১৯৮৪-১৯৮৫ সালে শুরু হয়ে ১৯৯২-১৯৯৩ সালে শেষ হয়। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য, এলাকার আমন মৌসুমে সেচ সুবিধা প্রদান। প্রকল্প আওতাভুক্ত জমি ৬০৭০ হেক্টর ও সেচ যোগ্য জমি ৪৪৫০ হেক্টর। ব্যারেজের পানি নির্গমন ক্ষমতা প্রতি সেকেন্ডে ২৮৭ ঘনমিটার। বর্ষা মৌসুমে এই ব্যারেজ এলাকা ভ্রমণ পিপাসুদের দৃষ্টি কাড়ছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক ভিন্ন রূপ ছড়িয়ে আছে ব্যারেজ এলাকায়। অবশ্য শীতকালেও এক ভিন্ন রূপ পায় টাঙ্গন ব্যারেজ পর্যকটদের কাছে। প্রতিবছর শীতকালে পানি কমে গেলেও বর্ষাকালে টাঙ্গন পানিতে থৈ থৈ। ভরা মৌসুমে মৎস্য বিভাগের আওতায় টাঙ্গন নদীর ওপর নির্মিত টাঙ্গন ব্যারেজের প্লাবন ভূমিতে সরকারিভাবে মাছ অবমুক্ত করা হয়। তিন মাস পর ব্যারেজের গেট খুলে দিলে এখানে শুরু হয় পাঁচ দিনব্যাপী মাছধরার উৎসব। পঞ্চগড়, দিনাজপুর নীলফামারীসহ দেশের বিভিন্ন জেলার মাছ শিকারিরা এখানে এসে তাবু গেঁড়ে, কেউ কলাগাছের ভেলায় আবার কেউ নৌকা করে বিস্তীর্ণ এলাকায় মাছ শিকার করেন। এতে প্রতিদিন এখানে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়। কাঞ্চনজঙ্ঘায় সকালের কাঁচা রোদে চকচক করা অপরূপ সৌন্দর্য দেখা যায় টাঙ্গন ব্যারেজের ওপর থেকে।

চলবে