বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০১৩

স্বপ্নের ভগ্নাংশ


কাঠ-ফাঁটা রোদের তীব্রতা নিয়ে পুরো দিনটা কাটে ফাহিমেরদহন যন্ত্রণা কেবল প্রকৃতির মাঝে নয় তার মনেও রয়েছে ভীষণ তৃষ্ণাদিনভর মতিঝিল পাড়ায় ঘুরে মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে রয়েছে তারসাধারণত সন্ধ্যার পর শাহবাগে ক্ষাণিকটা আড্ডা দিয়ে ঘরে ফেরার অভ্যেস বহুদিনের; ব্যতিক্রম হয়নি আজওতবে দহনের তীব্রতা আড্ডার সীমানা খাটো করে দেয়আড্ডার সাথীরা বেশীক্ষণ থাকতে চায়নি বলেই ফাহিমকে কিছু জলদি ফিরতে হয় নীড়েনীড়ে ফেরার আনন্দ যেমন আছে, রয়েছে তেমনি দুর্দশাওরীতিমত কুস্তি লড়ে চার-চাকার বাহনে নীড়ে ফিরতে গিয়ে নিয়ত গলদঘর্ম হতে হয় ফাহিমসহ বাহনের সকলকেইতবু ফিরতে তো হবেই
লিফটের তিনবাটনে পুশকরে একটু ঝিমিয়ে নেয় ফাহিমহ্যা, ওর নতুন নীড়ের রশিটানা লিফটএতটাই ভদ্র যে, কখনো দৌড়ায় না, হাঁটেও না; মনে হয় হামাগুড়ি দিয়ে চলেহামাগুড়ি দিয়ে কি ওপরে ওঠা যায়? তবু এক সময়ে উঠে যায় চার তলায় ওর নিজের নীড়ে
বৈদ্যুতিক পাখাটা পুরো দমে ছেড়ে দিয়ে কাপড় পরিবর্তন করতে গিয়ে বোঝে, ক্লান্তি কাকে বলে! খুব দ্রুততার সাথে গোসলপর্ব সম্পন্ন করতে এক রকম দৌড়ে গোসলখানায় প্রবেশ করে সেপ্রায় আধা ঘন্টা সেথায় কাটিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত শীতল করে ফিরে আসে শোবার ঘরেতখনই মনে হয় পেটে সাইক্লোন বয়ে যাচ্ছেহাভাতের মত রান্না ঘরে গিয়ে ফ্রিজ খোলে খাবার খোঁজেযা পায় তাই নিয়ে ওভেনে গরম করে খাবার টেবিলেফাহিমের একজন অতিথি কাজের বুয়া আছে, যে কিনা সপ্তাহে দুই এসে রান্না করে দিয়ে যায়, বাকী পাঁচ দিন ওভেনে গরম করে খায়এটা অবশ্য কেবল রাতের বেলায় প্রযোজ্য- দিনে খাবার পর্ব সারে পথে-ঘাটেনা, তার খাবারের কোন বাছ-বিচার নেই, সবখানেই সে খেয়ে অভ্যস্থ
গোগ্রাসে খাবার শেষ করে বুঝতে পারে তার অবস্থা সাইক্লোন শেষে প্রকৃতির মত বিব্ধস্ততাই বিলম্ব করার সময় তার মেলে নাআট শমিটার দৌড় শেষে দৌড়বিদ যেমন করে গন্তব্যে পৌঁছে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি করে সিডরের গতিতে খাওয়া পর্ব শেষ করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় ফাহিম
তখনি চোখের সামনে, মনের সেলুলয়েডে ভেসে ওঠে করবী আর মঞ্জুরীঅনেকের মাঝে হঠাৎ ওদের কথা কেন মনে হল, তা অবশ্য ফাহিম জানে নাদুজন দুই প্রান্তের- ভিন্ন মেরুর মানুষ; তবু ওরা দুজনেই তার কাছে খুব প্রিয়খেয়ালের বসে হাতে তুলে নেয় মোবাইল ফোনটা, লিখতে থাকে শর্ট মেসেজ যা এসএমএস নামে বহুল পরিচিতসে লেখে:
দিগন্ত ছেয়ে যায় কালো মেঘে
আঁধার নেমে আসে মনে
বাদলা দিনতো নয় আজ
তবু কেন চোখে বাদল নামে?”
লেখা হয়ে গেলে করবী আর মঞ্জীরর নম্বরে পাঠিয়ে দেয়এরপর আর কিছু মনে নেই; ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায় ফাহিম ক্লান্ত দেহ-মন নিয়ে
***    ***   ***   ***
শান্ত গাঁয়ের শান্ত নদী, নদী না বলে খাল বলাই ভালসেই খালে তীর ঘেঁসে ছোট্ট একখানি গাওগাঁয়ের মাঝামাঝি একটি বাড়ী, গ্রামের বাড়ী যেমনটি হয়উঁচু মাটির ভিটেয় কাঠের খুটিতে দাড়িয়ে আছে চার-চালা ঘরমূল ভিত্তিতে মূল ঘরের ওপরে টিনের ছাউনি, চারদিকে চার-চারটি বারান্দা; ওগুলোর ছাউনি গোল পাতারনাম গোলপাতাহলেও পাতাগুলো মোটেও গোলনয়সুন্দরবনের অন্যতম অর্থ উপার্জনকারী এই গোলপাতা হচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের নিরাপদ আশ্রয়স্থলগোলপাতার আড়ালে থেকেই টাইগার বাহাদুর শিকার খোঁজে এবং শিকার করে থাকেসেই গোলপাতা মনুষ্যালয়ে এসে মানুষের আশ্রয়ের অন্যতম উপাদান হয়ে ওঠে- কি অদ্ভুত এই দেশ!
মূল আবাসনের একটু দূরে আরেকটি দো-চালা ঘর, এটির ছাউনি শুধুই গোলপাতার; এখানে রান্নার কাজটি হয়মা-বোনেরা একরকম দিনভর এখানেই পড়ে থাকেনরান্নাঘরের পাশ দিয়ে হালকা সুরকী বিছানো সরু রাস্তা সোজা চলে গেছে খালের ধারেএখানে রয়েছে শান বাঁধানো ঘাটঘাটটিকে ঘিরে খালে মাঝে বাঁশের খুটি দিয়ে তৈরী করা হয়েছে প্রাইভেট এরিয়া; যাতে করে বৌ-ঝিরা ঘাটে গেলে নদীপথের অন্য কারো চোখে না পড়েদেয়াল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সুপারী গাছের বাঁকলসহ পাতাপ্রতি বছর অবশ্য এটি নতুন করে দিতে হয়, বদলাতে হয়এ ঘাটেই মা-বোনেরা, অন্য বাড়ীর বৌ-ঝিরা পর্যন্ত গোসল করে থাকে, কেউ কেউ  ঘাটকে কেন্দ্র করে সাঁতারও কাটে
ফাহিম যখন ঘাটের কাছে পৌঁছায়, হাতে ছোট্ট একটি ট্যাভেল ব্যাগ নিয়ে; মা তখন ঘাটে বাসন-কোস ধোঁয়ার কাজ করছেনকত্ত বছর পরে ফাহিম সেখানে, মনে করতে চেষ্টা করে- বছর তিরিশ বছর তো হবেইমা এখনো নিজ হাতে ঘাটে কাজ করছে দেখে কষ্ট লাগে তারফাহিমকে দেখে মা বলেন:
- ঘরে লবন নেইরে, বাজার থেকে লবন এনে দিবি বাবা?
ফাহিমের মাথায় বাজ পড়েএতকিছু থাকতে মা লবন সংকটের কথা বললেন কেনসে আরো অবাক হয় যখন মা আবারো বলেন:
- বেশী লাগবে না, একপোয়া আনলেই হবেলবনের যা দাম বেড়েছে!
- কত হয়েছে মা?
- বলিস না, একসের লবন এখন ৬৪০ টাকায় বিক্রি হয়, তাইতো এত অভাবলবন ছাড়া কি একবেলা খাবার চলে?
মায়ের কথা শেষ হলে ফাহিম ঘরের দিকে পা বাড়ায়, ঘরে ফেরা হয় না তারবড় বোনটা সামনে এগিয়ে আসে; ওর থেকে দুবছরের বড় সেদেখতে এখনো তেমনি আছেশুধু চোখের নিচে একটু কালো দাগ- এই যাবোনটি তার হাতের ব্যাগটা নিয়ে ঘরে যায়, ফাহিম বাজারের দিকে পা বাড়ায়
***    ***   ***   ***
শিপইয়ার্ডের বিশাল এলাকার সামনে দিয়ে যেতে যেতে ফাহিমের মনে পড়ে পঁচিশ বছর আগের কথাএকসময়ে সে এখানে কাজ করতোসাথী ছিল অনেকে, আজ আর তেমন কারো সাথে যোগাযোগ নেইমাঝে মধ্যে মোবাইলে কথা হয় মাজহারের সাথেমাহজার এখন এখানকার সবচেয়ে বড় কর্তাএকবার ভাবে মাজহারের সাথে দেখা করবে সেতবে তার আগে সে যে কাজে এসেছে সেটা শেষ করতে চায় ফাহিমতাই মাজহারের অফিস ডান দিনে জানা সত্তে¡ও বাম দিকে রিক্সা ঘোরাতে বলে, চলে যায় নদীর ধারে- সেদিনের সেই ছোট্ট রেস্টুরেন্টের কাছে
সেখানে গিয়ে তাকে অবাক হতে হয়; কোথায় সেই রেস্টুরেন্ট, কোথায় তার মালিক কাম ম্যানেজার গোবিন্দ! ফাহিমের আজো মনে আছে, গোবিন্দের হাতে বানানো ছোট্ট ছোট্ট সিংগারা খেতে কত দূর থেকে মানুষ আসতো! প্রতিদিন বিকেলে ফাহিমরা দলবেধে সিংগারা খেতে বসতোসেখানে আজ ডিপার্টমেন্ট স্টোরসেটির সামনে দাঁড়িয়ে চোখে জল আসে তারখুঁজে বেড়ায় সেই তিরিশ বছর আগের স্মৃতিহঠাৎ করেই নজরে আসে দূরে একটি লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন পাটওয়ারী ও শহীদুল্লাহ সাহেবদ্রুত কাছে যায় সে; এগিয়ে আসেন পাটওয়ারী সাহেব; বুকে টেনে নেন ফাহিমকেকতদিন পরে দেখা তাদেরবড্ড ভাল মানুষ ছিলেন তিনি, একসাথে কাজ করতে গিয়ে ফাহিমকে তিনি বহুবার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন; ফাহিম তা ভোলেনিফাহিম অবাক হলো যখন জানতে পারলো- পাটওয়ারী সাহেব এখনও এখানে কাজ করছেন! এই বয়সে তিনি কাজ করছেন, শরীরটাও ঠিক আছে দেখে ফাহিমের মনে হলো কেবল ও নিজেই বুড়িয়ে গেছে- পাটওয়ারী সাহেব ননকথা হলো শহীদুল্লাহ সাহেবের সাথেও, তিনি পাটওয়ারী সাহেবের মত অতটা আন্তরিক হতে পারলেন না; কেবলি ভদ্রতা বজায় রাখার মত কিছু কথা হলোফাহিম ভেবে পায় না, কেন এমনটি হলোঅথচ, ফাহিম যখন এখানে কাজে যোগদান করেছিল, সে সময়ে এই শহীদুল্লাহ সাহেবের সাথেই তার এটাচমেন্ট ছিল, এক কথায় ফাহিমের ডাইরেক্ট বসছিলেন শহীদুল্লাহ সাহেবসেই বসতাকে সহজভাবে নিতে পারলো না কেন এতদিন পরে? শহীদুল্লাহ সাহেবও তেমন একটা বুড়িয়ে যাননি- বেশ শক্ত-সামর্থ বলেই মনে হলো তাকে
এমনি সময় বিউগলের সুর ভেসে এলো কানে; সকলে যে যেখানে ছিল, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল- ফাহিমওফাহিমের মনে আছে, প্রতিদিন সকাল আটটায় বিউগলের মুর্চ্ছনায় অফিসের কাজ শুরু হতোজাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হতো কেন্দ্রীয়ভাবেসে সময়ে সকলকে দাঁড়িয়ে যেতে হতো নিজ নিজ অবস্থানে- ঠিক যেন সামরিক বাহিনীর দৈনন্দিন কার্যক্রম শুরু হচ্ছে
বিউগলের মুর্চ্ছনা থেমে যাবার পর দ্রুততার সাথে পাটওয়ারী ও শহীদুল্লাহ সাহেব চলে গেলেন বিশাল গেট পেড়িয়ে ভেতরে নিজ কাজেবিদায় জানালেন হাত নেড়ে; ফাহিম ঠাঁয় দাড়িয়ে রইল ক্ষাণিক্ষণ বিমর্ষ বদনে
***    ***   ***   ***
গ্যারিসন অডিটোরিয়াম; সাধারণত সেনাদের বিনোদনের জন্য তৈরী হয়ে থাকে সেনাদের কর্মস্থল বা আবসস্থলের কাছাকাছিতেমনি এক গ্যারিসন অডিটোরিয়ামের সামনে অসংখ্য মানুষের ভীড়এত ভীরের মাঝে কাউকে খুঁজতেই ফাহিমের এখানটায় আগমনতবে সাধারণ ভীড়ের চেয়ে একটু বেশী জনসমাগম দেখে তার কাছে অবকা লাগেএদিক ওদিক তাকিয়ে বেশী জনসমাগমের কারণ বুঝতে চেষ্টা করেতখনি মাসুদের ডাকে থমকে দাড়ায় সেমাসুদ; এক সময়ে তাদের অফিসের বহুতল ভবনের নিরপত্তা কর্মী ছিল সেমাসুম সামনে এসে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করে বেশ ভদ্রতার সাথেবেশ অমায়িক ছেলে মাসুদফাহিমও তাকে বেশ পছন্দ করতোহঠাৎ করেই একদিন জানলো, মাসুদ চাকরী ছেড়ে দিয়েছেকোথায় গেছে তা খোঁজার সময় যেমন হয়নি, দরকারও মনে করেনিশরতের এই স্নিগ্ধ বিকেলে গ্যারিসন অডিটোরিয়ামের সামনে মাসুদকে দেখতে পাবে তা সে ভাবেনি
জানলো, মাসুদ চাকরী ছেড়ে দিয়ে নৌ-বাহিনীতে নাবিক হিসেবে যোগ দিয়েছিল; এখন এই বেইজেই তার পোস্টিংসাথে একটি মেয়ে- নাম ফিরোজা; তার মনটা বিমর্ষমনে হলো মাসুদ তাকে সান্তনা দিচ্ছেজানা গেল- ফিরোজা নাবিক হিসেবে যোগদানের জন্য রাইনে দাড়িয়েছিল, নির্বাচিত হয়নি; তাই মনটা খারাপ- কষ্টও আছেঅভাবের সংসারে তার একটা চাকরী অতীব প্রয়োজনদেখতে বেশ সুন্দর, না গায়ের রঙ নয়, শৃংখলা রক্ষা বাহিনীর সদস্য হতে যেমনটি দরকার, তেমন শারীরিক গঠন তারগায়ের রঙটা বাদ দিলে যে কোন পুরুষের মনের নারী হবার যোগ্য সেলেখা-পড়া তেমন নেই বলেই নাবিক হবার জন্য তার এই আকুতিনিয়মিত বেতন আর সমাজের চোখে ভাল একটা অবস্থান- ফিরোজা চাইতেই পারেহয়নি, তার আশার পরণ হয়নি বলেই মনের দুঃখটা তাতেিয় উঠেছেমাসুদের সাথে ফহিমও ফিরোজাকে বোঝাতে চায়, এবার হয়নি তাতে কি? আবারো চেষ্টা করো; হয়ে যেতে পারেসাধ মেটে না যার, তাকে শান্তা দিয়ে কুব বেশী একটা লাভ হয় না, ফাহিম তা জানে; তাই বেশী কথা বলে নামাসুম ভালই আছে মনে হলো নতুন চাকুরীতেফিরোজা তার কে- তা জানতে চায় না ফাহিম
মাসুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজ কাজে এগোয় ফাহিমপেছন থেকে কেউ একজন দৌড়ে তার কাছে আসছে বুঝতে পেরে দাড়ায় ফাহিমএকটি মেয়ে ফিরোজার থেকে কিছুটা পরিস্কার গায়ের রঙ, তবে ততটা লম্বা নয়এসে সালাম দেয় ফাহিমকেনিজের পরিচয় দিয়ে বলে, আমি তুলি, ফিরোজার ছোট বোনআজকে তার চাকরী হয়েছে নাবিক হিসেবেউচ্চমাদ্যমিক পাশ করেছে সে; চাকরীটা হওয়ায় সে বেজায় খুশী; তবে মনটা খারাপ ফিরোজার চাকরী না হওয়ায়বয়সের কারণে আগামীতে নাবিক হওয়ার আর কোন সুযোগ থাকবে না ফিরোজারতুলি নিজের অনেক কথা বলে ফাহিমের কাছে দোয়া চাইলো এবং দ্রুততার সাথে বিদায় নিয়ে চলে গেলফাহিম অবাক হয়, তুলি কেন দৌড়ে এসে পরিচয় দিল আবার কেনইবা দ্রুত চলে গেলসব বিষয়ে কারণ খোঁজার অভ্যাস নেই ফাহিমের, তাই মিনিট খানেকের মধ্যে ফাহিমের হিসাবের খাতা থেকে তুলিও বিদায় নিলআবারো বীড়ের মধ্যে হারিয়ে যায় ফাহিম; তাকে সামনে এগুতে হবে। খুজতে হবে হাবিবকে
***    ***   ***   ***
ভাইয়ের চির বিদায়ের পর দাফন সম্পন্ন করে ফিরে আসছে সকলে; সকলের মন বিষন্নফাহিমের মনটা একটু বেশীই বিষন্ন! পরকালের ওপর বিশ্বাস থাকা বা না থাকা নিয়ে অনেকের বিশ্বাসের সাথে তার বিশ্বাসের ব্যবধান রয়েছেফলত মৃত ব্যক্তির শেষকৃত্যে ফাহিমের উপস্থিতি অনেকেই ভাল চোখে দেখেনিফাহিম সে বিষয় নিয়ে না ভাবলেও ওর মনটা খারাপ অন্য কারণেআজকে যে অবস্থানে ফাহিম, সেখানে আসার জন্য প্রয়াত ভাইটির অবদান রয়েছে বলেই ফাহিমের খুব খারাপ লাগছেআর কোনদির দেখা হবে না তাঁর সাথেকেবলি স্মৃতি হাতরে বেড়াতে হবে; মনের পর্দায় তাঁকে নানানভাবে আবিস্কার করা গেলেও বাস্তবে তাঁর কণ্ঠস্বর আর কোন দিন শোনা যাবে নাধমকের সুরে আর বলবেন না ফেলে দাও বলছিঅথবা আদরের সুরে এ কথাও আর শোনা যাবে না তাঁর কণ্ঠে কবিতা লিখে কি হবে, ছোট গল্প লেখ, তোমার গল্পের হাত বড্ড ভালদীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সিডরের গতিতে ফাহিমের নাসিকা থেকেঅবাক হয় সে, কতদিন সে তার ভাইয়ে সাক্ষাৎ পায়নিহাসপাতালের বিছানায় যখন আবারো দেখা হলো, ভাইটি তার রাগ বা অভিমান করেন নি; কেবলি জানতে চেয়েছিলেন- লেখালেখি কেমন চলছে তোমারকত্ত আদর মাখা কণ্ঠে সেই কথাগুলো উচ্চারিত হয়েছিল ভাইয়ের কণ্ঠে, ফাহিম পরিমাপ করতে পারে না
সেই ভাইকে মাটির নিজে শুইয়ে দিয়ে, চিরবিদায় জানিয়ে যখন সকলে ফিরে আসছে; ইচ্ছে করেই অন্যদের থেকে ফাহিম কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে পথ চলেসকলে ফিরে যেতে থাকে নিজ নিজ গন্তব্যেরাত তখন নয়টার কাছাকাছি; অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে অন্ধকার রাস্তার ওপরআকাশে চাঁদ নেই, নেই কোন মেঘের চিহ্নস্তব্ধ হয়ে গেছে বাতাসের গতি; ঠিক যেন ফাহিমের মতদ্রুত একটা সিগারেট মুখে তুলে আগুন ধরায়নাহ্, সিগারেটটাও তেতো লাগে তার কাছে; দুটান দিয়ে ফেলে দেয় সেএকটা অপরাধবোধ জাগে তার মনেসে কি তার ভাইয়ের সাথে অন্যায় করেছে? তার কি কোন দায়িত্ববোধ ছিল না ভাইয়ের প্রতি? সবাই যখন চলে যায়, ফাহিম ভাবে, ভাবীর সাথে দেখা করবে; কি বলে সান্তনা দেবে ভাবীকে? পুরো শরীর ঘেমে একাকার হয় তাররাস্তার ধারে অন্য কোন বাড়ীর পুকুরে গাছ ফেলে বানানো ঘাটে বসে মুখে পানি ছিটিয়ে শান্ত হবার ব্যর্থ চেষ্টা করে সে; শরীরও ঠান্ডা হয় না- মনতো নয়ই
***    ***   ***   ***
নদীর ধারে গিয়ে মাজহারের সাথে তার ঘটে যাওয়া বহু ঘটনার কথা মনে হয়প্রায় তিন যুগ হতে চললো ওদের বিচ্ছেদ; এরপর কত কিছু ঘটে গেলমাজহার জানে অনেক কিছুই, কথাও হয়- তবু সাক্ষাৎ হয় নাজীবন এমন কেন? প্রশ্নটা বারংবার নিজেকেই করেছে ফাহিমএকসাথে রাত জেগে ভিসিআর-এ নানান ধরণের ছবি দেখার একমাত্র স্বাক্ষী এই মাজহারএককালের প্রমত্তা ভৈরব নদীর তীরে কতদিন একসাথে কাটিয়েছে ফাহিম আর মাজহারবয়সে ওরা কাছাকাছিই হবেকেউ কারো বয়স জানতে চায়নি ওরামাজহারের সাইকেলে চড়ে চিত্রা তীরেও ওরা বেড়িয়েছে কতদিনচিত্রাবক্ষে পানসিতে করে ভেসে বেড়ানোর স্মৃতি ফাহিম আজো ভুলতে পারেনিনদীর ধারে এসে গোবিন্দের দেখা পায় সেগোবিন্দ ফাহিমকে চিনতে পারে নাঅনেক স্মৃতি সামনে নিয়ে এলেও গোবিন্দ কিছুই মনে করতে পারে নাগোবিন্দের বয়স বেড়েছেগোবিন্দদের বয়স বাড়ে, পাটওয়ারী বা শহীদুল্লাদের বয়স বাড়েনাহতাশ হলেও হাল ছাড়ে না ফাহিম; মাজহারের কথা বলে, মাজহারকে গোবিন্দ আজও চেনে, সে এখানকার মস্ত অফিসারতাকে না চিনলে চলে কি করে! বিদায় বেলা গোবিন্দ দুঃখ করে বলে:
- আপনাকে চিনতে বা মনে করতে পারছি না, মাফ করে দেবেন বাবুদিন আর বাঁচবো বলুন!
হাসিমুখে বিদায় নিয়ে একটা রিক্সা ডাকে ফাহিম, গন্তব্য দেয়ালের চারিধার ঘুরে মাজহারের অফিসগোবিন্দের ভাষায় সেখানেই এখানকার বড় বাবুর অফিস
***    ***   ***   ***
ঘুম ভেঙ্গে যায় ফাহিমেরবিছানার পাশেই ছোট্ট টেবিলে চায়ের মগে পিঁপড়ার সারিসময় দেখে - রাত ৪টা বেজে ১৭ মিনিটভীষণ তৃষ্ণা জাগেউঠে গিয়ে গলায় পানি ঢালেপিঁপড়ের দখলে থাকা চায়ের মগটা সিঙ্কে নিয়ে ধুয়ে ফেলতে গিয়ে মনে পড়ে, ঘুমাতে যাবার আগে নিজ হাতে চা তৈরী করেছিল, ক্লান্তিতে ঘুমপরী একটু জলদী এসে যাওয়ায় মগের চা মগেই থেকে যায়; খাওয়া হয়নিআবারো পানি গরম করতে দিয়ে বিছানায় ফিরে যায় সে, অভ্যাসবশত মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে দুদুটো মেসেজ জমে আছে ইনবক্সেচশমাটা চোখে লাগিয়ে মেসে দুটো পড়তে থাকে
মঞ্জুরী লিখেছে:
যখন প্রচন্ড খরতাপে তেঁতে ওঠে
বাতাস বাষ্প ধরে রাখার ক্ষমতা হারায়
তখন তো বাদল নেমে আসবেই
করবীর পাঠানো মেসেজটা এরকম:
অয়ময়ের চোখ বাদল
বদলে কি গেল ধরণীতল?”
দুজনের দুরকম মেসেজ- একই মেসেজের উত্তরেওদের ভাবনার ধরণ এবং চিন্তার ক্ষেত্র নিয়ে ভাবতে চায় ফাহিমহঠাৎ মনে হয়, উনানে চায়ের পানি ফুটছে
ক্ষাণিকবাদে চায়ের মগ নিয়ে আবারো বিছানায়এবার ভাবে, পিঁপড়েদের খোরাক হতে দেয়া যাবে নাতাই চায়ের মগ হাতে নিয়ে ব্যালকুনীতে গিয়ে বসে সেকৃষ্ণপক্ষের একদশী, শেষ রাতে খন্ডিত বাঁকা চাঁদ আকাশে- যাকে লাল রঙে রঞ্জিত করে দেশের কর্তারা বলছেন রেড ক্রিসেন্টচাঁদের বুড়ি নিশ্চয়ই ক্ষেপে আছেন- রূপালী চাঁদকে যখন রক্তে রঞ্জিতকরা হয়, তখন চাঁদের বুড়ি ক্ষেপবেনইবা না কেন? মাসের অন্তত পনেরটা দিন অমন স্নিগ্ধ রূপালী চাঁদ ততধিক স্নিগ্ধ আলোয় ভাসিয়ে রাখে পুরো পৃথিবী; অথচ ক্ষমতার দাপটে সেই চাঁদের স্নিগ্ধতা উপেক্ষা করে তাকে রেড ক্রিসেন্টমানে কি না রক্তিম চাঁদবলে! এনিয়ে ফাহিম আর বেশী ভাবতে চায় নাশেষ গ্রীষ্মের দহনের মাঝে নতুন আরেকটি দিনের ঊষালগ্নে প্রকৃতিকে তার কাছে বেশ ভাল লাগেতার মনে হয়, প্রকৃতি উদার হস্তে তাকে আহ্বান জানাচ্ছে:
আয় চলে আয় আমার মাঝে
তোকেই কেবল চাই রে বন্ধু
সকাল দুপুর বিকেল সাঁঝে
কেন তবে মাঝে এত বড় সিন্ধু!
পূর্বাকাশ ক্রমশ পরিস্কার হয়ে আসছেমৃদুমন্দ হাওয়ায় প্রকৃতি নাচতে শুরু করেছেফাহিমের মনটাও অজানা এক আনন্দে নেচে উঠতে চাইছেআর ঘন্টা কয়েক পরেই শুরু হবে দাবদাহের মাঝে আরো একটি দিনের পথচলা...... এ যেন নিরন্তর পথচলা, যা কোন শেষ নেইফাহিমের মনে হয়, এর চেয়ে বরং জীবনটা যদি হতো টুকরো টুকরো স্বপ্নে এক মহা সম্মিলন হত, যা কেবলি আনন্দ দেবে; কষ্ট দেবে না

ইস্টার্ন প্লাজা, ঢাকা
০৪২০১০ জুন ২০১৩