নুরুল্লাহ মাসুম
সপ্তম পর্ব
তেতুলিয়া ডাক বাংলো থেকে
ফেরার পেথ দেখে নিলাম, স্থানীয় ভাষায় কথিত “শিলিগুড়ি পয়েন্ট”। মূলত এটি
মহানন্দা নদীর তীরে একটি ভিউ পয়েন্ট, যেখান থেকে অদূরে মহানন্দা নদীর উপর একটি
সেতু দেখা যায়, যা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ বিভাগের উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুর
মহাকুমা ও জলপাইগুড়ি বিভাগের দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহাকুমার মধ্যে সংযোগ সাধন
করেছে। এই পয়েন্টেও নদীর মাঝ বরারব ভারত বাংলাদেশ সীমানা। এখান থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘার
চূড়া দেখা যায়। এখানে নদী পুরোটাই ভারতের অংশ, তবে কিছুটা উত্তরে এগুলো সীমান্ত
নদীর মাঝ বরাবর। এখানেই দেখা মেলে বিশেষ ধরণের বাঁশ, মোটা ধরণের এবং হালকা হলুদ
রঙের এই বাঁশ অন্য এলাকায় দেখা যায় না। আরেকটা কথা জানিয়ে রাখা ভালো, তেতুলিয়া
থেকে বাংলা বান্ধা পর্যন্ত দশ কিলোমিটারেরও বেশী দীর্ঘ (অবশ্যই একেবারে সরল রৈখিক
নয়) মহানন্দা নদীটাই মূলত ভারত বাংলাদেশ সীমানা নির্ধারণ করেছে। এমনটা খুব একটা
দেখা যায় না, যেমনটি দেখা যায়না সীমান্তে বাংলাদেশের সড়ক, এখানে দশ কিলোমিটার
দীর্ঘ সোজা সড়ক নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশ ভারত সীমান্তের বাংলাদেশ অংশে। সে বিষয়ে
পরে বলা যাবে।
তেতুলিয়া সম্পর্কে
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরো সময়টাই
তেতুলিয়া ছিল মুক্তাঞ্চল; এই উপজেলায় পাক হানাদার বাহিনী কখনো পা রাখতে পারেনি। এর
পেছনের কারণ জানা গেল, ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল
পর্যন্ত মুক্ত ছিল পঞ্চগড় জেলা। ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা পঞ্চগড় দখলে নেয়। এ
দিনে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে না পেরে উত্তরের দিকে পেছাতে
থাকেন। শেষমেশ মাগুরমারী এলাকায় আশ্রয় নেয়ার আগে তেঁতুলিয়ায় পাক হানাদার বাহিনীকে
প্রবেশ করতে না দেয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা পঞ্চগড়-তেতুলিয়া মহাসড়কের অমরখানা
এলাকার চাওয়াই নদীর ব্রিজ (অমরখানা ব্রিজ) ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেন। ফলে
মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় তেঁতুলিয়া পাক হানাদার বাহিনীর আগ্রাসনমুক্ত থাকে। এ
কারণে ওই সময় তেঁতুলিয়া হয়ে ওঠে স্বাধীন বাংলাদেশের মডেল। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসই
মুক্তাঞ্চল হিসেবে এই ৭৪ বর্গমাইলের মানুষের জীবনযাত্রা ছিল স্বাভাবিক। বিয়ে,
খতনা, আকিকাসহ সব ধরনণের সামাজিক অনুষ্ঠান পালন করেছে এখানকার মানুষ। নিরুপদ্রব
হওয়ায় তেঁতুলিয়া যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক কর্মকাণ্ডের অভয়াশ্রমে
পরিণত হয়। এখান থেকে উত্তরাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালনাসহ
রিক্রুটিং, প্রশিক্ষণ, অস্ত্রের জোগান দেওয়া ইত্যাদি কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। জানা
যায়, তেঁতুলিয়া ৬ নম্বর সেক্টরের অধীন ৬/ক সাব-সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল। ওই সময়
এখানে প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন
আহমদ এবং অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম
কামরুজ্জামান ও প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী এসেছেন এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং
মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজখবর নিয়েছেন। তেঁতুলিয়া থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করতেন সেক্টর
কমান্ডার উইং কমান্ডার মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার (এম কে বাশার), সাব-সেক্টর কমান্ডার
স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীন, ক্যাপ্টেন নজরুল হক, ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার, লেফটেনেন্ট
মাসুদ ও লেফটেনেন্ট মতিন। এম কে বাশার স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর
প্রধান পদে নিযুক্ত হয়েছিলন। ১৯৭৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর এক বিমান দুর্ঘটনার তিনি
মৃত্যুবরণ করেন। সাব-সেক্টর কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীনও বাংলাদেশ বিমান
বাহিনী প্রধান হয়েছিলেন ১৯৭৭ সালের ৯ ডিসেম্বর। আরো জানা যায, ৬ নম্বর সেক্টরের
প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হতো তেতুলিয়া ডাকবাংলো। সেক্টরের কমান্ডার
খাদেমুল বাশার ডাকবাংলোর একটি কক্ষে থাকতেন। অন্য কক্ষটি ছিল মুজিবনগর অস্থায়ী
সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান ও
অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন আবুল মনসুরের জন্য। এ ডাকবাংলোয় যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের
গুরুত্বপূর্ণ অনেক কর্মকাণ্ডের সিদ্ধান্ত হয়। তেঁতুলিয়ার খুব কাছেই ছিল ভারতের জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং। মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর জন্য তাই তেঁতুলিয়া ছিল খুবই সুবিধাজনক একটি স্থান। ইতোমধ্যে তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোর পাশেই “
স্বাধীনতার তীর্থ তেতুলিয়া”
শিরোনামে মুক্তাঞ্চলের একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে, যাতে কবি শামসুর রাহমানের “
স্বাধীনতা তুমি”
কবিতাটির কিছু অংশ উৎকীর্ণ রয়েছে; যদিও এটির যত্ন-আত্মি খুব একটা নেই। এছাড়াও, যে সেতু ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে
তেতুলিয়াকে মুক্তাঞ্চল রাখা সম্ভব হয়েছিলো সেই অমরখানার চাওয়াই নদীর (অমরখানা
ব্রিজ) পাশে স্বাধীনতার মুক্তাঞ্চল নামে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। তেতুলিয়া ডাক বাংলো
এবং পিকনিক কর্নারের পাশে নির্মান করা হয়েছে “
বেরং কমপ্লেক্স”
।
প্রধানমন্ত্রীর “
বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম
ব্যতীত)”
প্রকল্পের আওতায় তেতুলিয়া সদর ইউনিয়নের আন্ত সীমান্ত নদী বেরং এর
নামানুসারে এই কমপ্লেক্সটি নির্মিত হয়েছে সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির মানুষদের
সহায়তার জন্য, যারা সীমান্তবর্তী দর্জিপাড়ায় বসবাস করে। এই কমপ্লেক্সে দুটি কটেজ ও
একটি কিমিউনিটি ডাইনিং হল রয়েছে, যা পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। উপজেলা প্রশাসন
এটির তদারকি করে থাকে।
তেতুলিয়া ডাক বাংলো
এলাকায় আমাদের অবস্থান শেষে তেতুলিয়া বাজারের একটি রেস্টুরেন্টে সকালের নাশতা পর্ব
শেষ করে পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু হয়। যেখানটায় আমরা নাশতা করি,
শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি বড় তেতুল গাছ তেতুলিয়ার নামকরণের সার্থকতা বহন করে চলেছে।
শুনেছি এমন অসখ্য তেতুলগাছ ছিল শহরে, রাস্তা নির্মান-সহ উন্নয়নের প্রয়োজনে গাছগুলো
কেটে ফেলা হলেও এ গাছটিকে যত্ন করেছে রেখেছে স্থানীয় প্রশাসন ও পৌরসভা কর্তৃপক্ষ।
পথিমধ্যে শহরের একপ্রান্তে অবস্থিত তেতুলিয়া সার্বজনীন শিব মন্দির দর্শন করি। ১৯১১
সালে নির্মিত শিব মন্দিরটি ১৯৯৭ সালে পুনিনর্মান করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উনিশ
শতকের প্রথম দিকে তেতুলিয়া অঞ্চল পর্যায়ক্রমে শাসিত হয়েছে প্রাগ জ্যোতিষ, কামরূপ,
কামতা, কুচ বিহার ও গৌর রাজ্যের রাজা, বাদশাহ, সুবাদার এবং বৈকুণ্ঠপুর অঙ্গ
রাজ্যের দেশীয় রাজা ও ভূস্বামীদের কাছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকের মধ্যে রাজা
শালিবাহন, রাজা পৃথু এবং রাজা জল্লেশ পঞ্চগড়ের তেতুলিয়া উপজেলার শালবাহান ও জেলার
ভেতরগড় এলাকায় রাজ্য ও সমৃদ্ধ অঞ্চল গড়ে তুলেছিলেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। পরবর্তী গন্তব্য
দেশের সর্বউত্তরে অবস্থিত বাংলাবান্ধা “
জিরো পয়েন্ট”
।
শহর ছেড়ে আমাদের যাত্রা চলে প্রায় ৬০ ডিগ্রি সরল রৈখিক কোনে নির্মিত সুন্দর, মসৃন
রাস্তা ধরে। আগেই বলেছি, ভাররতের সীমানা ঘেষে প্রায় সর্বত্রই রাস্তা থাকলেও বাংলাদেশের অন্য কোন সীমান্তে সীমানা
ঘেঁষে এমন কোন রাস্তা আমার নজরে আসেনি এটি ছাড়া। ডাক বাংলো থেকে ১৬ কিলোমিটার
রাস্তার পুরো সময়টা জুড়ে হাতের বামে ভারতীয় সীমান্ত। সীমান্তের ওপারে পুরো
এলাকাটাই ভারতের পশ্চিম বঙ্গের দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহাকুমার অন্তর্ভুক্ত।
সাবলিল গতিতে পথ চলার সময় প্রায় সব জায়গা থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘার চূঁড়া দেখতে
পাচ্ছিলাম। এমন কি বাংলা বান্ধা পৌঁছেও আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘার চূঁড়া দেখতে পেয়েছি।
আকাশে মেঘ বা কুয়াশা থাকলে এমন দৃশ্য চোখে পড়বে না। প্রায় আধা ঘন্টার মতো পথ চলে
আমরা পৌঁছে গেলাম বাংলা বান্ধা গিরো পয়েন্টে। এখানেই বাংলাদেশের সীমানা শেষ এবং
ভারতের সীমানা শুরু। আমরা বিজিবি চেকপোস্টের সামনে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে জিরো
পয়েন্ট গেলাম, নো-ম্যানস ল্যান্ডে অবাধ বিচরণ করে ছবি তোলার কাজ সারলো সকলেই। আমরা
ছাড়াও আরে বেশ কয়েকজন পর্যটক সেখানে উপস্থিত ছিলেন, ছিলো কয়েকজন তরুন, যারা
কাছা-কাছি কোথাও থেকে এসেছে ইজিবাইকে করে। জিরো পয়েন্ট থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘার চূঁড়ার
দেখা মেলে, তবে পরিরসরটা এখানে কম- বেশ কিছু বড় বড় গাছ-গাছালি থাকার কারণে।
সীমান্তের ভারতীয় অংশে বিশাল গেইট রয়েছ, যা আমাদের সীমানায় নেই। আমরা প্রায়
স্বাধীন ভাবে নো-ম্যানস ল্যান্ডে বিচরণ করলাম প্রায় ঘন্টাখানেক সময়। ১৯৯৭ সালে বাংলা
বান্ধা স্থল বন্দর চালু হয় এবং ২০১০ সালে এখানে ইংরেজি ‘
জিরো’
আকৃতির একটি স্থাপনা নির্মান করা হয়
কঙ্ক্রিট দিয়ে, যা টাইলস দিয়ে মোড়ানো। এই স্থল বন্দর থেকে ভারতের শিলিগুড়ি শহরের
দূরত্ব মাত্র ৭ কিলোমিটার। এই বন্দর দিয়ে নেপাল ও ভুটানেও যাওয়া যায়। জিরো
পয়েন্টের চারিধারের মনোমুগ্ধকর সবুজ পরবেশ যে কারো মন কাড়বে নিঃসন্দেহে। আরেকটা কথা জানাতেই
হয়। জিরো পয়েন্টে প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার বিজিবি ও বিএসএফ-এর সম্মিলিত রিট্রিট
প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। ১৯১৮ সালের এপ্রিল মাসে এই প্যারেডর শুরু। রিট্রিট
প্যারেড হচ্ছে দিন শেষে যুদ্ধ বিরতির একটি আনুষ্ঠানিকতা, যা ১৭ শতকের ইংল্যান্ডে
রাজা দ্বিতীয় জেমসের আমলে এটি প্রথম চালু হয় বলে ধরণা করা হয়। এই প্যারেডের মধ্য
দিয়ে দিনশেষে তাদের দুর্গে কাছাকাছি টহল ইউনিটগুলিকে প্রত্যাহার করা হতো। এটি একটি
শতাব্দীর পুরানো সামরিক ঐতিহ্য। যখন সৈন্যরা যুদ্ধ বন্ধ করে, তাদের অস্ত্র খাপবদ্ধ
করে এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাদের প্রত্যাহার করা হয়। রিট্রিটের শব্দে সূর্যাস্তের
সময় সৈনিকরা ক্যাম্পে ফিরে আসে। এ সময় নিজ নিজ দেশের পতাকা নামানো হয়। তখনকার
দিনে এই অনুষ্ঠান শেষে সন্ধ্যায় বন্দুক থেকে এক রাউন্ড গুলিও চালানো হতো বলে জানা
যায়। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তে এখন আর গুলি চালনা হয় কি না, তা জানা যায় নি;
আমরা এমন অুষ্ঠানের স্বাক্ষীও হতে পারি নি।
জিরোপয়েন্ট
ভ্রশণ শেষে আমাদের যাত্রা শুরু হলো সমতলের চা বাগান দেখার উদ্দেশ্য। যে পথে
গিয়েছিলাম সে পথেই ফিরে এলাম প্রায় অর্ধকটা পথ, তারপর তীরনই হাট বাজারে এসে বামের
পথ ধরে চলা শুরু হয়। প্রায় চল্লিশ মিনিট পথ চলার পরে আমরা পৌঁছলাম কাজী এন্ড কাজী
টি এস্টেটের প্রবেশ তোরণে। আসার পথেই গাড়িতে বসেই দেখা মিললো সমতলের চা বাগান। কাজী
এন্ড কাজী টি এস্টেটের প্রবেশ তোড়ন আহামরি কিছু নয়, তবো সেখানে পরচয় দিয়ে ভেতরে এগুতে
হলো। এখানে সুপার স্টোর মিনা বাজারের একটি আউটলেট রয়েছ। আরো সামনেই আনন্দ ধারা নামে এস্টেটের অনিন্দ্য
সুন্দর রিসোর্ট। এখানেই রয়েছ ডাহুক নামের একটা নদী, প্রশস্থে বেশী চওড়া নয়, তবু
বহতা নদী সেটি। চলবে