শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৩

বরেন্দ্র ও প্রাগজ্যোতিষপুরের তেতুলিয়া - দ্বিতীয় পর্ব

নুরুল্লাহ মাসুম

দ্বিতীয় পর্ব

 দুপুর ১২টায় আমাদের ভ্রমণ কার্যক্রম শুরু হয়। আমাদের পাইলট সবুজ হেলেনের শ্বশুর বাড়ি গাজীপুরের বাসিন্দা হলেও তার বসবাস ঠাকুরগাঁয়ে। সাবলিল গতিতে সে আমাদের দুই দিন সেবা দিয়েছে হাসিমুখে। পরিবর্তিত সূচি অনুসারে আমাদের প্রথম গন্তব্য মোহিনী তাজ। প্রায় চল্লিশ মিনিট চলার পরে আমরা পৌঁছলাম গন্তব্যে। পথে সকলেই উপভোগ করেছে হেমন্তের দুপুর ও অপরাহ্ণের বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য। গাড়ির ভেতরে থেকেই ছবি তোলা ও ভিডিও করা এবং মোহিনী তাজ সম্পর্কে মহিউদ্দীন ভাইয়ের বর্ণনা শুনতে শুনতে পথ-পরিক্রম শেষ হলো।

মোহিনী তাজ নামক স্থাপনাটি শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ঠাকুরগাঁ সদর উপজেলাধীন আখানগর ইউনিয়নের চতুরাখোড় মাধবীকুঞ্জ নামক স্থানে অবস্থিত। নিরিবিলি সবুজে ঘেরা মায়াবী পরিবেশে অবস্থিত স্থাপনাটির নির্মাত ডা. মো. ফিরোজ জামান জুয়েল; উৎসর্গ করেছেন স্ত্রী ডা. জেসমিন রহিম-এর নামে। ১২ বছর প্রতিক্ষার পর পিতা হওয়ায় নির্মাতা স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতার বহিপ্রকাশ এটি হিসাবে নির্মাণ করেছেন বলে জানা গেল। এটির নকশা প্রতিষ্ঠাতা নিজেই করেছেন। পৃথিবীর মৌলিক উপকরণ, মানুষের জীবন দর্শন, পারিবারিক ইতিহাস, ব্যক্তিগত স্মরণীয় ঘটনা, দৃষ্টি নন্দন নকশা ও কারুকার্য মিলিয়ে ২৪টি উপাদানের সমন্বয়ে তিনি এটি নির্মান করেছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ মোহানী তাজের প্রবেশ দ্বারের মূল ফটকে বর্ণিত আছে। স্ত্রীকে উৎসর্গ করা হয়েছে বলে স্থানীয় লোকেরা স্থাপনাটিকে তাজমহল নামে চেনে। মোহিনী তাজ মোট ১৩টি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি জানালা ও বাইরের কারুকাজগুলো লাল, হলুদ নীল রঙের সমন্বয় করা হয়েছে সূর্য, চাঁদ, তারার আদলে।

চিকিৎসক ফিরোজ জামান জুয়েল শুধু একজন চিকিৎসকই নয়, তিনি কবি, স্থপতি, প্রকৌশলী, ডিজাইনারও বটে। তার স্ত্রী জেসমিন রহিমও একজন চিকিৎসক। নিজের স্বপ্ন, পরিবারের প্রতি দায়িত্ব, নারী জাতির প্রতি শ্রদ্ধা ও স্ত্রীর প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসাকে উৎসাহ ও সাহস হিসেবে নিয়েই মোহিনী তাজ নির্মাণের কাজ শুরু করেন তিনি। তার দৃষ্টিনন্দন মোহিনী তাজকে নিয়ে তিনি লিখেছেন-

গগনবিদারী ভুবন রাজ,
মাধবীকুঞ্জে মোহিনী তাজ।
শিল্পশৈলী কারুকাজ,
দিগ্বিজয়ী মোহিনী তাজ।”

সময় কাটানোর জন্য ও দৃষ্টিনন্দন মোহিনী তাজ দেখার জন্য প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী ভিড় জমায়। আমাদের ভ্রমণের সময়ও বেশ কয়েকজন দর্শনার্থী সেখানে ছিলো। ভবনের নাম মোহিনী তাজ সম্পর্কে তার বক্তব্য এমন বলে জেনেছি- মোহিনী শব্দের অর্থ আকর্ষণীয়, মোহমীয়, আবেদনপূর্ণ ও মমতাময়ী। আর তাজ অর্থ সেরা, শীর্ষতম বা সর্বগুণে গুণান্বিত। মোহিনী তাজ স্ত্রী চিকিৎসক জেসমিন রহিমকে উৎসর্গ করলেও একই সাথে তার  পরিবারের নারীদের- মা, বোন ও অন্য নারীদের কথাও তিনি মনে রেখেছেন। তাই সার্বিক অর্থে সমগ্র নারীকুলের প্রতি সম্মান জানাতে এ নামকরণ করা হয় মোহিনী তাজ। মোহিনী তাজের ডিজাইন- পৃথিবীর ব্যাসার্ধ চার হাজার মাইলের অনুপাতে ৪০ ফুট ব্যাসার্ধে বৃত্তের উপর আঁকা হয়েছে এটি। পৃথিবীর নকশা, প্রণয়ন, বিন্যাস, সাজসজ্জা, সমন্বয় ও পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছেন তিনি। বৃত্তের মাঝে জল ও স্থলের মোটামুটি আনুপাতিকহারে মূল ভবনের চারপাশে জলকে দেখিয়েছেন নদীর আকারে। আর স্থলকে চিহ্নিত করেছি সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের ছায়ার আদলে। দুটি বলের ওপরে একটি মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলে পূর্ব থেকে পশ্চিমে যে ছায়া তৈরি হয় সেই ছায়ার আদলে কাটা হয়েছে ঘরের মেঝে। মোহিনী তাজের দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য চিকিৎসক জুয়েল এখানে ব্যবস্থা করেছেন কমিউনিটি সেন্টার, শিশুদের বিনোদন পার্ক ও পিকনিক স্পটের।

আমরা সেখানে প্রায় এক ঘন্টা সময় কাটিয়ে, তাজের প্রতিটি তলায় ঘুরে-ফিরে রওয়ানা দেই নেকমরদের উদ্দেশ্যে। আধা ঘন্টার মতো পথ চলে আমরা পৌঁছে যাই নেকমরদ। পথে যথারীতি প্রকৃতির অপর সৌন্দর্য উপভোগ আর গাল-পল্পে সময় কাটে আমাদের। এ অঞ্চলে দীর্ঘ দিনের কর্ম অভিজ্ঞতার আলোকে মহিউদ্দীন ভাই সবকিছু বর্ণনা করছিলেন পুরো ভ্রমণকালে।

ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার উত্তর পাশে প্রায় ৩৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে নেকমরদ ইউনিয়ন। নেকমরদ বাজারের পাশেই পীরশাহ সৈয়দ নাসিরউদ্দিন মাজার অবস্থিত। জানা যায় আগে এই এলাকার নাম ছিলো ভবানন্দপুর; তারও আগে এলাকাটির নাম ছিল করবর্তন। পীর সৈয়দ নাসিরউদ্দিন অত্যন্ত পরহেজগার থাকায় নেকমর্দান নামে পরিচিত ছিলেন যার অর্থ পূণ্যবান মহাপুরুষ। সুলতানি আমলে তার আগমন ঘটে বলে অনুমান করা হয়। ১৯১২ সালে প্রকাশিত এফ. ডাব্লিউ, স্ট্রং রচিত ইস্টার্ন বেঙ্গল গেজেটিয়ার- দিনাজপুর-এ প্রথম বারের মতো পীরশাহ নেকমরদ-এর নাম ও মাজারের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যদিও সেখানে তার সম্পর্কে বিস্তারিত কোন বিবরণ তিনি দিতে পারেন নি। নেকমরদ এলাকাটি প্রত্ন-উপকরণে সমৃদ্ধ। পীরশাহ নাসির উদ্দিন নেকমরদের মাজার প্রত্ন উপকরণের মাঝে প্রতিষ্ঠিত বলে কিংবদন্তির কাহিনী আরো জোরালো। এফ. ডাব্লিউ, স্ট্রং নেকমরদ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু না বলতে পারলেও কিংবদন্তি বলছে, হিন্দু রাজত্বের শেষ যুগে ভিমরাজ ও পিতরাজ নামে দুই ভাই এ অঞ্চলের শাসক ছিলেন। তাদের শাসনামলে প্রজা সাধারণ ছিল নির্যাতিত। অনাচার, দুর্নীতি আর অরাজকতায় মানুষ ছিল কোণঠাসা। অতিষ্ট মানুষ ভয়ে কিছু বলতে পারতো না দুঃশাসক ভিমরাজ ও পিতরাজের বিরুদ্ধে। এমন দুঃসময়ে শেখ নাসিরউদ্দিন নেকমরদের এ রাজ্যে প্রবেশ করেন। ভিমরাজ ও পিতরাজ কৌশলে তাকে বাধা দিলে তিনি অলৌকিক ক্ষমতাবলে সে বাধা ছিন্ন করেন। বিরক্ত হয়ে অত্যাচারি দুই ভাইকে অভিশাপ দিলে তারা ধংস হয়ে যায়। তাদের রাজধানীর ধ্বংসাবশের উপর নির্মিত হয় পীরশাহ নেকমরদের আস্তানা। বিধ্বস্ত রাজধানীর উপর শুরু হয় নতুন জনপদের যাত্রা। তার অলৌকিক ক্ষমতার অনেক কিংবদন্তি এলাকায় আজো প্রচলিত রয়েছ। তিনি পহেলা বৈশাখে ইন্তেকাল করেন, তবে কবে আগমন ও পরলোকগমন করেন তার কোন প্রকৃত তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রতিবছর তার সম্মানে বৈশাখ মাসে ওরস উদযাপন ও মেলা চলে। নেকমরদ ওরস মেলায় এক সময় এখানে হাতি, ঘোড়া, উট সহ প্রায় সব ধরনের জিনিস পত্র কেনা বেচা হতো বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এখনও প্রতি বছর ডিসেম্বরে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয় এবং এক মাস স্থায়ী থাকে। পীরশাহ নাসিরউদ্দিনের মাজারটি প্রায় ৮৫ বছর আগে নির্মিত হয়। এটি আগে কাঁচা থাকলেও বর্তমানে কারুকার্যে শোভা মন্ডিত করা হয়েছে। বর্তমানে নেকমরদ ইউনিয়ন ও ওরশ মেলা ওই এলাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে চলেছে। 

আমাদের পরের গন্তব্য রামরাই দিঘী।

রাণীশংকৈলে প্রাচীন ঐতিহ্যের এক নিদর্শন রামরাই দিঘী। ঠাকুরগাঁও জেলার সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম দিঘী । দিঘীর সঠিক কোনো ইতিহাস এখনো জানা যায় নি, কে বা কারা এটি খনন করেছিল, কবে খনন করেছিল। তবে এলাকাবাসীর ধারণা দিঘীটি পাঁচশ থেকে হাজার বছরের পুরাতন।একসময় এই দিঘী ছিল এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের পানীয় জলের চাহিদা পূরণের উৎস। এ দিঘীকে ঘিরে নানা লোককথা শোনা যায়। কোন এক সময়ে রামরাই দিঘীর নামকরণ করা হয় রানি সাগর। এটি উপজেলা সদর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দিঘীর চারপাশে প্রায় ১২০০-এর অধিক লিচু গাছ-সহ অন্যান্য গাছ লাগানো হয়েছে। দিঘীর চারিদিকের সবুজের বিশাল সমারোহ আর টলটলে জলরাশি মুগ্ধ করে দর্শনার্থীদের। 

 


 

এছাড়া বিভিন্ন পাখির কুজন রামরাই-এর সৌন্দর্যকে আরো অধিক আকর্ষণীয় করে তুলেছে। শীতের সময় হাজারো অতিথি পাখির দেখা মেলে এখানে। তাদের কিচির মিচির শব্দে পুরো এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। অনেকেই এলাকাটিকে পাখিরাজ্য বলে আখ্যায়িত করে থাকে। পুকুরটি ১৮.৩৪ একর সুউচ্চ পাড় ও ২৩.৮২ একর জলভাগসহ মোট ৪২.২০ একর বিশিষ্ট। রামরাই দিঘীটি বরেন্দ্র ভূমিতে প্রাচীন জলাশয়গুলির মধ্যে আয়তনে দ্বিতীয় বৃহত্তম। পুকুরটির দৈর্ঘ্য উত্তর দক্ষিণে ৯০০ মিটার ও প্রস্থ পূর্ব-পশ্চিমে ৪০০ মিটার। আমরা এখানে প্রায় আধা ঘন্টা অবস্থান করি। দিঘীর পাড়েই হোসেনগাও ইউনিয়ন পরিষদের অফিস। 

চলবে