সোমবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৩

বরেন্দ্র ও প্রাগজ্যোতিষপুরের তেতুলিয়া - পঞ্চম পর্ব

 নুরুল্লাহ মাসুম


পঞ্চম পর্ব

ঠাকুরগাঁ ভ্রমণ পরিকল্পনা যখন চূড়ান্ত হয়েছিলো, তখন বাংলাদেশ এক্স-ক্যাডেটস এসোসিয়েশন- বেকার কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচির ও কেন্দ্রীয় মুখপাত্র মাহাবুব আলম এবং সচিব (সদস্য) এ. কে. এম. আনোয়ারুল ইসলাম উত্তমকে বিষয়টা জানিয়ে বলেছিলাম, সুযোগ ও সম্ভব হলে ঠাকুরগাঁ ইউনিটের বেকা সদস্যদের সাথে দেখা করতে চাই। তারা দুজনেই আমায় আশ্বস্ত করে এবং সেমতেই বেকা ঠাকুরগাঁ ইউনিটের সেক্রাটারি স্বপন আমার সাথে যোগাযোগ করে শহরের একটা রেস্টুরেন্টের ঠিকানা দেয়। সন্ধ্যা ৭টায় সময় থাকলেও একটি অনকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জেরে ২০/২৫ মিনিট পরে সেখা উপস্থিত হয়ে ‍বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ি। আমার ধারণা ছিলো ২/৪ জন এক্স-ক্যাডেটের সাথে বসে কথা-বার্তা বলবো। কিন্ত সেখানে দেখলাম ২৫ জন বেকা সদস্য মিলিত হয়েছেন আমাকে সম্ভাষণ জানানোর জন্য! আমার উপস্থিতির কারণে তারা সেখানে স্বল্প নোটিশে রীতিমতো একটি মিলন মেলার আয়োজন করে ফেলেছে- ফরমাল সভা বলা যায়।

দীর্ঘ সময় ধরে নানাবিধ বিষয়ে আলোচনা হলো তাদের সাথে। এর মধ্যে সীমিত সামর্থের মধ্যে তারা কিভাবে প্রতিকুল অবস্থায় করোনাকালে সেবা প্রদান করেছে, তাও জানলাম। এটাই তো বেকার সফলতা! বেশ সুন্দর একটা সন্ধ্যা কাটালাম বেকার সদস্যদের সাথে- প্রাণবন্ত আলোচনার মধ্য দিয়ে। পরে চমৎকার আপ্যায়নের ব্যবস্থাও রেখেছিলো তারা। আমার মতো একজন সাধারণ বেকা সদস্যের সম্মানে এমন একটা বড় আয়োজনের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ ঠাকুরগাঁ বেকা কমিটির সকল সদস্যকে এবং মিলন মেলায় উপস্থিত সকল সদস্যকে। সম্মিলিত কর্মকান্ডের মধ্য দিয়েই বেকা আরো সামনে এগিয়ে যাবে স্বীয় সেবামূলক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে-এটাই প্রত্যাশা।  ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই বেকা কেন্দ্রী যুগ্ম মহাসচিব মাহাবুব ও সচিব (সদস্য) আনোয়ার উত্তমকে- এমন একটা মিলনমেলা আয়োজনের ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য।

রাতে দলের সকল সদস্যকে জানিয়ে দেয়া হলো পরদিন সকালের ভ্রমণ পরিকল্পনার কথা। সে মতে সকলকে রাত সাড়ে তিনটার মধ্যে প্রস্তুত থাকতে বলা হলো। ২৫ অক্টোবর সকাল চারটায় আমাদের যাত্রা শুরু হলো পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে। সাড়ে তিনটার মধ্যর সকলে যেমন তৈরি হয়েছিলেন, তেমনি আমাদের চালক সবুজও যথাসময়ে উপস্থিত হয়েছিল। ঠাকুরগাঁ শহর ছেড়ে আমাদের বাহন ছুটে চলেছে পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে। ফাঁকা রাস্তা। বাইরে হেমন্তের হিমেল হাওয়া শীতের আগমনী বার্তা জানান দিচ্ছে। মনে হচ্ছিল আমাদের গাড়িটা দৈত্যের মতো ছুটে চলেছে ঠাকুরগাঁ পঞ্চগড় হাইওয়ে ধরে। তখনো অন্ধকার কাটে নি। তাই বাইরের সবুজ প্রকৃতি তখনো নিকষ-কালোয় আবৃত। ধীরে ধীরে আকাশ পরিস্কার হচ্ছে, সবুজের প্রকৃতি স্বীয় বর্ণে ফিরে আসছে; কারো চোখে ঘুম নেই- সকলের চিন্তায় তখন সূর্যোদয়ের সময়ে দূরের হিমালয় পর্বতশ্রেণীর দ্বিতীয় উচ্চতম ও সবচেয়ে সুন্দর চূড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা অবলোকন করার সুযোগ নেয়া। এটাও সকলে জানে, আকাশ যদি আমাদের পক্ষে না থাকে তবে এত পরিশ্রম করে এত দূরে এসেও সে সুযোগটা হারাতে হবে। তবে আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, প্রকৃতি আমাদের সাথে বৈরীতা করবে না, যদিও কুয়াশা থাকলেও আমাদের সুযোগ-হারা হতে পারে।

ঠাকুরগাঁ থেকে পঞ্চগড় সদর হয়ে তেতুলিয়া পৌঁছতে প্রায় দুই ঘন্টা লাগার কথা থাকলেও, প্রথমত রাস্তা একেবারে ফাঁকা থাকায় এবং আমাদের চালক দক্ষ ও অভিজ্ঞ হওয়ায় আমরা দেড় ঘন্টায় পৌঁছে যাই গন্তব্যে, অর্থাৎ তেতুলিয়া ডাক বাংলোয়- ঘড়িতে তখন সময় সকাল ৫টা ৩৭ মিনিট। 


পথিমধ্যে পঞ্চগড় থেকে তেতুলিয়া মহাসড়কটিকে বলা হয় এশিয়ান হাইওয়ে- ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কটি দেশের অন্যান্য সড়ক থেকে দেখতে একটু ভিন্ন রকমের, এর নান্দনিক সৌন্দের্য্যের কারণে। বেশ পরিচ্ছন্ন সড়কটি। তেতুলিয়া ডাক বাংলো এলাকায় পৌঁছানোর পর, তখনো সূর্য ওঠার কিছু সময় বাকী। ইতোমধ্যে সেখানে বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়েছেন- উদ্দেশ্য আমাদের মতোই। এর বাইরেও কয়েকজনকে পেলাম, যারা প্রতিদিন এই এলাকায় মর্নিং ওয়াক করে থাকেন। মহিউদ্দীন ভাই পেয়ে গেলেন তার চাকুরীকালীন একজনকে যিনি এখনো অবসর নেন নাই। তার সাথেও আলাপ হলো।

চলবে

শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৩

বরেন্দ্র ও প্রাগজ্যোতিষপুরের তেতুলিয়া - দ্বিতীয় পর্ব

নুরুল্লাহ মাসুম

দ্বিতীয় পর্ব

 দুপুর ১২টায় আমাদের ভ্রমণ কার্যক্রম শুরু হয়। আমাদের পাইলট সবুজ হেলেনের শ্বশুর বাড়ি গাজীপুরের বাসিন্দা হলেও তার বসবাস ঠাকুরগাঁয়ে। সাবলিল গতিতে সে আমাদের দুই দিন সেবা দিয়েছে হাসিমুখে। পরিবর্তিত সূচি অনুসারে আমাদের প্রথম গন্তব্য মোহিনী তাজ। প্রায় চল্লিশ মিনিট চলার পরে আমরা পৌঁছলাম গন্তব্যে। পথে সকলেই উপভোগ করেছে হেমন্তের দুপুর ও অপরাহ্ণের বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য। গাড়ির ভেতরে থেকেই ছবি তোলা ও ভিডিও করা এবং মোহিনী তাজ সম্পর্কে মহিউদ্দীন ভাইয়ের বর্ণনা শুনতে শুনতে পথ-পরিক্রম শেষ হলো।

মোহিনী তাজ নামক স্থাপনাটি শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ঠাকুরগাঁ সদর উপজেলাধীন আখানগর ইউনিয়নের চতুরাখোড় মাধবীকুঞ্জ নামক স্থানে অবস্থিত। নিরিবিলি সবুজে ঘেরা মায়াবী পরিবেশে অবস্থিত স্থাপনাটির নির্মাত ডা. মো. ফিরোজ জামান জুয়েল; উৎসর্গ করেছেন স্ত্রী ডা. জেসমিন রহিম-এর নামে। ১২ বছর প্রতিক্ষার পর পিতা হওয়ায় নির্মাতা স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতার বহিপ্রকাশ এটি হিসাবে নির্মাণ করেছেন বলে জানা গেল। এটির নকশা প্রতিষ্ঠাতা নিজেই করেছেন। পৃথিবীর মৌলিক উপকরণ, মানুষের জীবন দর্শন, পারিবারিক ইতিহাস, ব্যক্তিগত স্মরণীয় ঘটনা, দৃষ্টি নন্দন নকশা ও কারুকার্য মিলিয়ে ২৪টি উপাদানের সমন্বয়ে তিনি এটি নির্মান করেছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ মোহানী তাজের প্রবেশ দ্বারের মূল ফটকে বর্ণিত আছে। স্ত্রীকে উৎসর্গ করা হয়েছে বলে স্থানীয় লোকেরা স্থাপনাটিকে তাজমহল নামে চেনে। মোহিনী তাজ মোট ১৩টি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি জানালা ও বাইরের কারুকাজগুলো লাল, হলুদ নীল রঙের সমন্বয় করা হয়েছে সূর্য, চাঁদ, তারার আদলে।

চিকিৎসক ফিরোজ জামান জুয়েল শুধু একজন চিকিৎসকই নয়, তিনি কবি, স্থপতি, প্রকৌশলী, ডিজাইনারও বটে। তার স্ত্রী জেসমিন রহিমও একজন চিকিৎসক। নিজের স্বপ্ন, পরিবারের প্রতি দায়িত্ব, নারী জাতির প্রতি শ্রদ্ধা ও স্ত্রীর প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসাকে উৎসাহ ও সাহস হিসেবে নিয়েই মোহিনী তাজ নির্মাণের কাজ শুরু করেন তিনি। তার দৃষ্টিনন্দন মোহিনী তাজকে নিয়ে তিনি লিখেছেন-

গগনবিদারী ভুবন রাজ,
মাধবীকুঞ্জে মোহিনী তাজ।
শিল্পশৈলী কারুকাজ,
দিগ্বিজয়ী মোহিনী তাজ।”

সময় কাটানোর জন্য ও দৃষ্টিনন্দন মোহিনী তাজ দেখার জন্য প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী ভিড় জমায়। আমাদের ভ্রমণের সময়ও বেশ কয়েকজন দর্শনার্থী সেখানে ছিলো। ভবনের নাম মোহিনী তাজ সম্পর্কে তার বক্তব্য এমন বলে জেনেছি- মোহিনী শব্দের অর্থ আকর্ষণীয়, মোহমীয়, আবেদনপূর্ণ ও মমতাময়ী। আর তাজ অর্থ সেরা, শীর্ষতম বা সর্বগুণে গুণান্বিত। মোহিনী তাজ স্ত্রী চিকিৎসক জেসমিন রহিমকে উৎসর্গ করলেও একই সাথে তার  পরিবারের নারীদের- মা, বোন ও অন্য নারীদের কথাও তিনি মনে রেখেছেন। তাই সার্বিক অর্থে সমগ্র নারীকুলের প্রতি সম্মান জানাতে এ নামকরণ করা হয় মোহিনী তাজ। মোহিনী তাজের ডিজাইন- পৃথিবীর ব্যাসার্ধ চার হাজার মাইলের অনুপাতে ৪০ ফুট ব্যাসার্ধে বৃত্তের উপর আঁকা হয়েছে এটি। পৃথিবীর নকশা, প্রণয়ন, বিন্যাস, সাজসজ্জা, সমন্বয় ও পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছেন তিনি। বৃত্তের মাঝে জল ও স্থলের মোটামুটি আনুপাতিকহারে মূল ভবনের চারপাশে জলকে দেখিয়েছেন নদীর আকারে। আর স্থলকে চিহ্নিত করেছি সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের ছায়ার আদলে। দুটি বলের ওপরে একটি মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলে পূর্ব থেকে পশ্চিমে যে ছায়া তৈরি হয় সেই ছায়ার আদলে কাটা হয়েছে ঘরের মেঝে। মোহিনী তাজের দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য চিকিৎসক জুয়েল এখানে ব্যবস্থা করেছেন কমিউনিটি সেন্টার, শিশুদের বিনোদন পার্ক ও পিকনিক স্পটের।

আমরা সেখানে প্রায় এক ঘন্টা সময় কাটিয়ে, তাজের প্রতিটি তলায় ঘুরে-ফিরে রওয়ানা দেই নেকমরদের উদ্দেশ্যে। আধা ঘন্টার মতো পথ চলে আমরা পৌঁছে যাই নেকমরদ। পথে যথারীতি প্রকৃতির অপর সৌন্দর্য উপভোগ আর গাল-পল্পে সময় কাটে আমাদের। এ অঞ্চলে দীর্ঘ দিনের কর্ম অভিজ্ঞতার আলোকে মহিউদ্দীন ভাই সবকিছু বর্ণনা করছিলেন পুরো ভ্রমণকালে।

ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার উত্তর পাশে প্রায় ৩৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে নেকমরদ ইউনিয়ন। নেকমরদ বাজারের পাশেই পীরশাহ সৈয়দ নাসিরউদ্দিন মাজার অবস্থিত। জানা যায় আগে এই এলাকার নাম ছিলো ভবানন্দপুর; তারও আগে এলাকাটির নাম ছিল করবর্তন। পীর সৈয়দ নাসিরউদ্দিন অত্যন্ত পরহেজগার থাকায় নেকমর্দান নামে পরিচিত ছিলেন যার অর্থ পূণ্যবান মহাপুরুষ। সুলতানি আমলে তার আগমন ঘটে বলে অনুমান করা হয়। ১৯১২ সালে প্রকাশিত এফ. ডাব্লিউ, স্ট্রং রচিত ইস্টার্ন বেঙ্গল গেজেটিয়ার- দিনাজপুর-এ প্রথম বারের মতো পীরশাহ নেকমরদ-এর নাম ও মাজারের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যদিও সেখানে তার সম্পর্কে বিস্তারিত কোন বিবরণ তিনি দিতে পারেন নি। নেকমরদ এলাকাটি প্রত্ন-উপকরণে সমৃদ্ধ। পীরশাহ নাসির উদ্দিন নেকমরদের মাজার প্রত্ন উপকরণের মাঝে প্রতিষ্ঠিত বলে কিংবদন্তির কাহিনী আরো জোরালো। এফ. ডাব্লিউ, স্ট্রং নেকমরদ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু না বলতে পারলেও কিংবদন্তি বলছে, হিন্দু রাজত্বের শেষ যুগে ভিমরাজ ও পিতরাজ নামে দুই ভাই এ অঞ্চলের শাসক ছিলেন। তাদের শাসনামলে প্রজা সাধারণ ছিল নির্যাতিত। অনাচার, দুর্নীতি আর অরাজকতায় মানুষ ছিল কোণঠাসা। অতিষ্ট মানুষ ভয়ে কিছু বলতে পারতো না দুঃশাসক ভিমরাজ ও পিতরাজের বিরুদ্ধে। এমন দুঃসময়ে শেখ নাসিরউদ্দিন নেকমরদের এ রাজ্যে প্রবেশ করেন। ভিমরাজ ও পিতরাজ কৌশলে তাকে বাধা দিলে তিনি অলৌকিক ক্ষমতাবলে সে বাধা ছিন্ন করেন। বিরক্ত হয়ে অত্যাচারি দুই ভাইকে অভিশাপ দিলে তারা ধংস হয়ে যায়। তাদের রাজধানীর ধ্বংসাবশের উপর নির্মিত হয় পীরশাহ নেকমরদের আস্তানা। বিধ্বস্ত রাজধানীর উপর শুরু হয় নতুন জনপদের যাত্রা। তার অলৌকিক ক্ষমতার অনেক কিংবদন্তি এলাকায় আজো প্রচলিত রয়েছ। তিনি পহেলা বৈশাখে ইন্তেকাল করেন, তবে কবে আগমন ও পরলোকগমন করেন তার কোন প্রকৃত তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রতিবছর তার সম্মানে বৈশাখ মাসে ওরস উদযাপন ও মেলা চলে। নেকমরদ ওরস মেলায় এক সময় এখানে হাতি, ঘোড়া, উট সহ প্রায় সব ধরনের জিনিস পত্র কেনা বেচা হতো বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এখনও প্রতি বছর ডিসেম্বরে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয় এবং এক মাস স্থায়ী থাকে। পীরশাহ নাসিরউদ্দিনের মাজারটি প্রায় ৮৫ বছর আগে নির্মিত হয়। এটি আগে কাঁচা থাকলেও বর্তমানে কারুকার্যে শোভা মন্ডিত করা হয়েছে। বর্তমানে নেকমরদ ইউনিয়ন ও ওরশ মেলা ওই এলাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে চলেছে। 

আমাদের পরের গন্তব্য রামরাই দিঘী।

রাণীশংকৈলে প্রাচীন ঐতিহ্যের এক নিদর্শন রামরাই দিঘী। ঠাকুরগাঁও জেলার সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম দিঘী । দিঘীর সঠিক কোনো ইতিহাস এখনো জানা যায় নি, কে বা কারা এটি খনন করেছিল, কবে খনন করেছিল। তবে এলাকাবাসীর ধারণা দিঘীটি পাঁচশ থেকে হাজার বছরের পুরাতন।একসময় এই দিঘী ছিল এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের পানীয় জলের চাহিদা পূরণের উৎস। এ দিঘীকে ঘিরে নানা লোককথা শোনা যায়। কোন এক সময়ে রামরাই দিঘীর নামকরণ করা হয় রানি সাগর। এটি উপজেলা সদর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দিঘীর চারপাশে প্রায় ১২০০-এর অধিক লিচু গাছ-সহ অন্যান্য গাছ লাগানো হয়েছে। দিঘীর চারিদিকের সবুজের বিশাল সমারোহ আর টলটলে জলরাশি মুগ্ধ করে দর্শনার্থীদের। 

 


 

এছাড়া বিভিন্ন পাখির কুজন রামরাই-এর সৌন্দর্যকে আরো অধিক আকর্ষণীয় করে তুলেছে। শীতের সময় হাজারো অতিথি পাখির দেখা মেলে এখানে। তাদের কিচির মিচির শব্দে পুরো এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। অনেকেই এলাকাটিকে পাখিরাজ্য বলে আখ্যায়িত করে থাকে। পুকুরটি ১৮.৩৪ একর সুউচ্চ পাড় ও ২৩.৮২ একর জলভাগসহ মোট ৪২.২০ একর বিশিষ্ট। রামরাই দিঘীটি বরেন্দ্র ভূমিতে প্রাচীন জলাশয়গুলির মধ্যে আয়তনে দ্বিতীয় বৃহত্তম। পুকুরটির দৈর্ঘ্য উত্তর দক্ষিণে ৯০০ মিটার ও প্রস্থ পূর্ব-পশ্চিমে ৪০০ মিটার। আমরা এখানে প্রায় আধা ঘন্টা অবস্থান করি। দিঘীর পাড়েই হোসেনগাও ইউনিয়ন পরিষদের অফিস। 

চলবে


রবিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২৩

পূর্ণিমা

নুরুল্লাহ মাসুম


পিতৃহারা পূর্ণিমা লালিত-পালিত হচ্ছিল তার একমাত্র ভাইয়ের সংসারে। ভাইটি তার থেকে বছর আটেকের বড়। পেশায় নৌকা-চালক, যাকে আমরা মাঝি বলে জানি। বিশাল দেহের অধিকারী বাহর আলী প্রমত্তা সন্ধ্যা নদীতে খেয়া পাড়াপাড়ের কাজ করে। বাবার আমলের একটা মাঝারি গোছের নৌকা তার একমাত্র সম্বল। খুব সকালে এক-গামলা পান্তা খেয়ে প্রায় মাইল দেড়েক পাঁয়ে হেঁটে নৌকার কাছে যায় এবং কাজে লাগে। বাহর আলীর নৌকা যখন ঘাটে সক্রিয় হয়, তখন বাজারের মসজিদে মুয়াজ্জিন আজান দেয়। দিনভর কাজ শেষে এশার নামাজের অনেক পরে বাহর আলী ঘরে ফেরে।

বাবা মারা যাওয়ার বছর তিনেক আগে দুই বছরের বোন পূর্ণিমাকে রেখে মারা যায় বাহর আলীর মা। ছোট্ট বোনটাকে মানুষ করতে তার বাবাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। প্রথমদিকে বাহর আলীর ফুপু এসে বাড়িতে থাকতেন। এক বছর যেতে না যেতেই বাহর আলীর বাবা এস্কেন্দার আলীও পরপারে চলে গেলেন। ছোট্ট বোন পূর্ণিমাকে নিয়ে তখন বাহর আলীর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। ফুপু আরো বছরখানেক ওদের সাথে ছিলেন, তারপর তিনিও অনন্তলোকে যাত্রা করলেন। ফুপুর কোন ছেলে-মেয়ে না থাকায় শ্বশুর বাড়িতে যতটকু জমি-জমা ও নগদ সম্পত্তি পেয়েছিলেন, তা বাহর আলীর হাতে তুলে দিয়ে যান। তবে ফুপু বাড়ির লোকদের তালবাহানায় জমি-জমার কোন ভাগই বাহর আলী পায়নি।

পূর্ণিমা বাহার আলীর সাথেই ঘুমাতো। দিনের বেলায় প্রতিবেশীরা তাকে দেখে রাখতো। বাহর আলী রাতে যা রান্না করতো, সেটাই ছিলো সকাল ও দুপুরে ওদের দুজনের খাদ্য। রাতে আবার রান্না। মাঝে মধ্যে এ-ঘর ও-ঘর থেকে কিছু খাবার জুটতো পূর্ণিমার ভাগ্যে। পূর্ণিমা খুশী হতো। ফুপু মারা যাওয়ার পর ওদের এক পাড়াতুত চাচি মূলত পূর্ণিমাকে দিনভর দেখে রাখতো।

একাকী বাহর আলী ছোট্ট বোনটাকে লালন-পালন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল। পাড়া-প্রতিবেশীরা তখন মোক্ষম পরামর্শ দেয় ঘরে বউ আনার জন্য। বাস্তবে তাই ঘটে। বছর দুয়েক বাদে এক পৌষের শেষে বাহর আলীর ঘরে আসে নতুন বউ- দুটো গ্রাম বাদ দিয়ে কোন এক দরিদ্র পরিবারের মেয়ে নতুন বউটি। বিয়েতে কোন জাকজমক ছিলো না, থাকার কথাও নয়। তবু বাড়ির অন্যান্য গৃহস্তরা মিলে যা আয়োজন করে, তাতেই নতুন বউ তাহেরা বানু খুশী হয়; খুশী হয় বাহর আলীও। 

৫ বছর বয়স থেকেই পূর্ণিমার একাকী থাকার অভ্যাস হয়ে যায়। আরো বছর দুয়েক বাদে বাহর আলী ও তাহেরার ঘর আলো করে আসে একটি ছেলে- নাম রাখা হয় মজিবর। দেশ তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ণিমা ছোট থাকায় একপ্রকার নিশ্চিন্তে দিন কাটে বাহর আলীর। অন্যান্য ঘরের সোমত্ত মেয়েদর নিয়ে প্রতিটি পরিবার ছিল দুশ্চিন্তগ্রস্ত। কেউবা তাদের পাঠিয়ে দিয়েছিল দূর গাঁয়ের কোন নিকট বা দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে। সে সময়টাতে সকলে নানান ভাবনায় থাকলেও পূর্ণিমা দিন কাটিয়েছে হেসে-খেলে।

মজিবরকে নিয়ে ফুপু পূর্ণমার দিন কাটে বেশ। হেসে-খেলে দিন বয়ে যায়। দিন যত গড়ায় বিপদ তত সামনে এসে দাঁড়ায়। পূর্ণিমা দিনে দিনে গায়ে-গতরে ধাই-ধাই করে বেড়ে চলেছে। গায়ের রঙ ঠিক পূর্ণিমার চাঁদের মতই। ওর বাব-মায়ের দেয়া নামটা সার্থক হতে থাকে দিনে দিনে।

বন্যায় পুরো দেশ ডুবে আছে। সদ্য স্বাদীন দেশে তখন দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে। গ্রাম ছেড়ে সকলেই ছুটছে ছোট-বড় শহরের দিকে। কেউবা চালনা বন্দরে কাজের সন্ধানে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম হুহু করে বেড়ে চলেছে। বাড়ে না কেবল বাহর আলীর নৌকা পারাপারের তোলা। যুদ্ধের আগে থেকে চলে আসা দুই পয়সাতেই তাকে যাত্রী পারাপার করতে হয় দেড় মাইল চওড়া সন্ধ্যা নদী। সে যেমন-তেমন কাজ নয়। মাঘের শেষ থেকে শুরু করে শ্রাবণের শেষাবধী সন্ধ্যার যে প্রমত্তা রূপ, যে না দেখেছে তাকে বিশ্বাস করানো যাবে না। কঠোর হাতে বৈঠা ধরে অনায়াসে বাহর আলী পাড়ি দেয় সেই নদী। এলাকায় তার একটা নাম-ডাক রয়েছে দক্ষ মাঝি হিসেবে। নাম-ডাক যতই থাকুক, দিন শেষে ইজারাদারের পয়সা দিয়ে বাহর আলী যা হাতে পায়, তাতে সংসার চালানো কষ্ট হয়ে ওঠে।

অনিন্দ্য সুন্দর রূপের কারণে গ্রাম ছাপিয়ে গ্রামান্তরে পৌঁছে যায় পূর্ণিমার নাম। পূর্ণিমা এখন আর কেরানী বাড়ির পুকুরে গোছল করতে যেতে সাহস পায় না, ওর ভাবী ও চাচীরা ওকে একা যেতে দেয় না পুকুর ঘাটে। এলাকার বখাটেদের নজরে পড়ে পূর্ণিমা। অগত্যা সাব্যস্ত হয়, তাহেরা বিবি কেরানী বাড়ির পুকুর থেকে পানি এনে দেবে কলসী ভরে। হয়ও তাই। ঘরের পেছনে কলা-পাতার দেয়া ঘেরাটোপের মাঝে সেই এক কলস পানিতেই চলে পূর্ণিমার গোছল পর্ব। এ নিয়ে তার কষ্টের সীমা নেই। গ্রামের মেয়ে পুকুরে ডুবাবে, সাঁতার কাটবে- সে আর হয়ে ওঠে না। গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা দিয়ে দিনাতিপাত করে সে।

গ্রামের সকলের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। প্রতি রাতেই কোন না কোন বাড়িতে চুরির ঘটনা ঘটছে। দেশান্তরী হওয়ার কারণে প্রতিবেশী অনেক বাড়িতেই এখন মানুষজন কম, কোন কোন বাড়ি তো একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। বাজারে চালের আকাল। এখন বাহর আলীসহ অনেকেই দিনে দুবেলা আটার রুটি খায়। গলা দিয়ে কি নামে সেই রুটি? এরই মধ্যে আটার সাথে ধানের কুড়ো মেশানো পাওয়া গেছে। এ নিয়ে পঞ্চায়েতে নালিশ হলে বিচার-আচারের ঘটনাও ঘটেছে। রক্ষী বাহিনী আর লাল বাহিনীও মাঠে নেমেছ এসব কর্মকান্ড সামাল দিতে।

পূর্ণিমা আর অমাবশ্যার পালাবদলে আমাদের আলোচ্য পূর্ণিমা আরো বড় হতে থাকে। মনের কষ্ট আর খাবারের অনটন তার গতরের শ্রীবৃদ্ধিতে তেমন একটা প্রভাব ফেলে না। পূর্ণিমাকে এখন আর বাড়ির বাইরে ধারে-কাছের কোন খোলা যায়গায় দেখা যায় না। তবে দুষ্টু ছেলেরা ওৎ পেতে থাকে কখন সে কলাপতার ঘেরাটোপে গোছল করে আজানু লম্বা চুল শুকানোর জন্য বাড়ি উঠানের পশ্চিম কোনায় এসে বসবে, একটা জলচৌকি পেতে। বলাই বাহুল্য, বাহর আলীর অভাবের সংসারে পূর্ণিমার ভাগ্যে কোনকালেই চুলে দেবার মতো সুগন্ধি তেল জোটেনি। তবু, সে কি সুন্দর ঘন ও দীর্ঘ-কালোকেশী সেই পূর্ণিমা। এটা শুকানোর জন্য সে প্রতিদিন বাধ্য হয়েই উঠানের পশ্চিম কোনায় জলচৌকিতে বসতে হতো। পূর্ণিমা কেরানী বাড়ির মেয়েদর মুখে শুনেছে- চুল শুকানোর জন্য না কি কি এটা যন্ত্র আছে! ব্যবহার করবে কি, কোন কালে চোখেই দেখেনি সে। শুধু পূর্ণিমা কেন, কেরানী বাড়ির সকলেই কি তা দেখেছে? ওরা যখন বড় বোন হালিমার শ্বশুর বাড়ি চানপুর যায়, সেখানে দেখেছে কয়েকজনে। শহর বলে কথা। পূর্ণিমা শহর তো দূরের কথা, সন্ধ্যা নদীর পার হয়ে ওপাড়ে যায়নি কোনকালে। যাবার মতো ভাগ্য কি তার হবে কখনো? শুনেছে, ওপাড়ে বায়োস্কোপ আছে। বড় একটা লম্বা ঘরের ভেতরে আলো নিভিয়ে দিয়ে বই দেখায়- কি সুন্দর সুন্দর কাহিনী। শুদ্ধ ভাষায় না কি বলে সিনেমা হল, দেখায় সিনেমা।

কচু-ঘেচু গাডি (ওল কচু) আর কচুর বই (লতি) দিয়ে যখন ওদের দিন কোন রকমে কেটে যাচ্ছিল, তখন পূর্ণিমার বিয়ের প্রস্তাব আসে পাশের গ্রামের মাঝি-বাড়ির বড় ছেলের জন্য। ছেলেটির নামও মজিবর। মাঝি বাড়ি ছেলে হলেও সদরে একটা কলেজের দপ্তরী সে। মাসে মাসে মায়না পায় পঁচিশ টাকা। বাহর আলী রাজী হয়ে যায়। আদরের বোনটার যেমন একটা গতি হবে, তেমনি তার নিজের দায়িত্বও কমবে। তছাড়া ওদের বাড়িতে চাকরী করা কোন ছেলে নেই, তাই জানে না, চাকরি করা ছেলেরা কেমন হয়। গায়ে-গতরে কতটা শক্তিশালী হয়! তবে এটুকু জেনেছ- ওদের বাড়িতে খাওয়ার কষ্ট নেই।

বাহর আলী চেষ্টা করে বোনটার বিয়েতে সাধ্যমত ধুমধাম করার। জনা বিশেক লোক দাওয়াত করে খাইয়েছে। জামাইকে একটা কেমি ঘড়ি দিয়েছ। কথা দিয়েছে একটা সাইকেল দেবে- যাতে তার কলেজে যেতে সুবিধা হয়। এজন্য তার জমানো সবগুলো টাকা খরচ হবে জেনে তার বউ বাধা দিয়েছিলো, বাহার আলী শোনেনি। একটা বোন, কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে; তার জন্য খরচ করবে না তো কার জন্য করবে!

এখন আর গ্রামের ছেলেরা কেরানী বাড়ির পুকুরের আড়ালে থেকে পূর্ণমার অনিন্দ্য সুন্দর কালো-দীর্ঘ কেশ দেখার জন্য আড্ডা জমায় না লুকিয়ে। বহু বছর হয়ে গেছে পূর্ণিমাও ভাইয়ের বাড়িতে আসে না। সকলে ভাবে, পূর্ণিমা তার নিজের সংসারে ভালই আছে।

কুড়ি বছর হয়ে গেল, পূর্ণিমার কোন খবর জানে না গ্রামের লোকজন। কেমন আছে সে? পূর্ণিমার কোলে কি তার থেকে ফুটফুটে সুন্দর সন্তান এসেছে? সে কি নিজের সুখে ভাইয়ে কথা, ভাবীর কথা, প্রতিবেশীদের কথা এমন কি তার ভাইয়ে ছেলে মজিবরের কথা ভুলে সুখের সংসার করছে?

প্রতি বছর চৈত্র-সংক্রান্তির মেলায় গ্রামে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসে ফাতু, সুরিয়া, মম, ফজিলা, নার্গিস, হাসি; সকলেই খেলার সাথী। এ সময়টাতে গ্রামজুড়ে যেন মেয়েদের মেলা বসে। এ বাড়ি ও-বাড়ি পড়ন্ত বিকেলে ওদের আড্ডা হয়, নিজ সংসারের গল্প, ছোটকালের গল্প- যেন স্মৃতি হাতড়ানোর প্রতিযোগিতা! সকলেই স্বামী সন্তানসহ এ সময়টাতে বেড়াতে আসে। কেবল পূর্ণিমার আর দেখা মেলে না চৈত্র-সংক্রান্তির মেলাতেও।


১৫ ২১১৭ আগস্ট ২০২৩

ইস্টার্ন প্লাজা, হাতিরপুল, ঢাকা।