শুক্রবার, ৫ জানুয়ারী, ২০২৪

বরেন্দ্র ও প্রাগজ্যোতিষপুরের তেতুলিয়া - ষষ্ঠ পর্ব

 নুরুল্লাহ মাসুম

ষষ্ঠ পর্ব

সকাল ৬টা ১০ মিনিটে সূর্যোদয় হওয়া কথা। তার আগেই দিগন্তে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া। এর আগে আমি দার্জিলিং-এর টাইগার হিল থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ রূপ দর্শণ করেছি। এবারে বাংলাদেশ থেকেই দেখছি সেটিকে। চারিদিকে গুঞ্চন, তারপরই নিরবতা পুরো এলাকা জুড়ে। সকলের দৃষ্টি উত্তর দিগন্তে- কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ার দিকে। সময় ক্রমে এগুতে থাকে, চূড়ার রঙও বদলাতে থাকে। হালকা লাল থেকে কমলা, তারও পরে আরো উজ্জল কমলা রঙ। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায় পাহাড়ের চূড়া। এটাই মূলত এর সৌন্দর্য। ছবি তোলার ধুম পড়ে যায়। আমি নিজে ভিডিও করা ছাড়াও প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কিছু সময়ের জন্য লাইভ ব্রডকাস্ট করি। এর আগে যতবারই দেখেছি, তখনতো আর মোবাইল আবিস্কার হয়নি, ফেসবুক তো কল্পনার বাইরের বিষয় ছিলো। এমন একটা সুযোগ নেবো না কেন! এ সুযোগ সকলেই নিতে থাকেন। আমরা সেখানে প্রায় দেড় ঘন্টা অবস্থান করি। যেখানে দাড়িয়ে দিগন্তে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা হয়, সেই ভিউ পয়েন্ট থেকে নিচে নামলেই মহানন্দা নদী, নদীর ওপারটাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি বিভাগের দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহাকুমার ফাঁসিদেওয়া ব্লকের অবস্থান। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি, এই ফাঁসিদেওয়া বলকের ঠিক উত্তরেই রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক পরিচিত নকশালবাড়ি এলাকা। এখান থেকেই শুরু হয়েছিলো ইতিহাসখ্যাত নকশালবাড়ি আন্দোলন, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরী, কানু সান্যাল ও জঙ্গল সাঁওতাল।


তেতুলিয়া ডাক বাঙলোর একটা ইতিহাস রয়েছ। জানা যায়, এই বাংলোটি নির্মান করেছিলেন কুচবিহার রাজ্যের মহারাজা, তার বাগান বাড়ি হিসেবে। প্রসঙ্গত তেতুলিয়া সম্পর্কে কিছু অজানা কথা জেনে নেয়া দরকার।

তেতুলিয়া’’ আমাদের দেশের সকলের নিকট এক নামে পরিচিত। জনশ্রুতি, প্রাচীন কালে এ এলাকায় প্রচুর তেতুল গাছ ছিল। তেতুল গাছের ছায়ায় বসে পথিকেরা বিশ্রাম নিত। এক সময়ে এখানে একজন বিশিষ্ট ইংরেজ বণিক বাস করত। তার বাবার নাম ছিল টিটু এবং তার বাসগৃহ ছিল একটি উঁচু টিলার উপর। সেখানে একটি তেতুল গাছ ছিল। কালক্রমে সেই ইংরেজ বণিকের বাবার নাম টিটু থেকে টেটু এবং তেঁতুলতলা হতে ‘‘লিয়া; অপভ্রংশ হতে হতে জনপদের নামকরণ হয় তেতুলিয়া। এখন আর তেতুল গাছের সমাহার নেই সেখানে, তবে তেতুলিয়া বাজারে এখনো প্রতীক হিসেবে একটি বড় তেতুল গাছের দেখা মেলে। স্থানীয় এক ভ্যান চালকের ভাষ্য অনুসারে এমন শত শত তেতুল গাছ ছিল শহরজুরে, সব গাছ কাটা হলেও এই একটি গাছ যত্ন করে রেখে দেয়া হয়েছে। তার কথায়, তেতুল গাছ থেকেই তেতুলিয়ার নামকরণ হয়েছে। আমরা সকাল সাড়ে ৭টার দিকে সেই তেতুল গাছের কাছেই একটি রেস্টুরেন্টে সকালের নাশতা সেড়ে নিলাম।



তেতুলিয়া ১৮৬০ সাল থেক ১৮৬৯ সাল পর্যন্ত রংপুর জেলার একটি মহাকুমা ছিল। শিল্প, বাণিজ্য ও নদী বন্দর হিসেবে তেতুলিয়া ছিল সুবিখ্যাত। এটি ছিল মারোয়ারিদের একটি প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র। মহানন্দা নদী দিয়ে আসা যাওয়া করত মহাজনী নৌকা। এখানে বাণিজ্য মেলা বসত।  তখন তেতুলিয়া শহরের গুরুত্ব ছিল অনেক। ফলে তেতুলিয়ায় গড়ে উঠে বেশ কিছু চমৎকার পাকা বাড়ী, মন্দির ও একটি ঘোড় দৌড়ের মাঠ। একই সময়ে ম্যালেরিয়া এবং কালা জ্বরে এখানে ব্যাপক প্রাণহাণী ঘটলে শহর হিসেবে গড়ে ওঠা তেতুলিয়া বন্দর নগরটি হয়ে পরে অস্বাস্থ্যকর এবং জনশূন্য। ১৮৭০ সালের ১ এপ্রিল এক গেজেট নোটিফিকেশন এর মাধ্যমে তেতুলিয়া মহুকুমার সকল ক্ষমতা বিলুপ্ত করে চূড়ান্তভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয় জলপাইগুড়ি জেলার কালেক্টরের হাতে। ফলে বিলুপ্ত হয় তেতুলিয়ার প্রশাসনিক ক্ষমতা। অনেক পরে ১৯১৩ সালে তেতুলিয়ায় আবার স্থাপিত হয় একটি পূর্ণাঙ্গ পুলিশ স্টেশন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের আগ পর্যন্ত  এটি ছিল জলপাইগুড়ি জেলার অবিচ্ছিন্ন গুরত্বপুর্ণ অংশ। ১৯৪৭ সালের ১৮ আগস্ট স্যার রেডক্লিপ ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অন্য ৪টি থানার সংগে তেতুলিয়াকে পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুরের সাথে যুক্ত করে দেন ।


ডাক বাংলো সংলগ্ন জায়গায় উপজেলা প্রশাসন গড়ে তুলেছে একটি দৃষ্টি নন্দন পিকনিক কর্নার। এখানে স্থাপন করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস খচিত ঐতিহাসিক ৭ মার্চ চত্বর, ৭ বীরশ্রেষ্ঠের প্রতিকৃতি, শিশুদের চিত্ত বিনোদনের জন্য বসার বেঞ্চ ও দোলনা। ঝরণা, ফোয়ারা, পিকনিক কর্ণারের গেট, হিমালয়-কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহনীয় রূপ দর্শনে সুদৃশ্য ওয়াচ টাওয়ার, অভ্যন্তরীণ এবং চারপাশে এইচবিবি রাস্তা ও গাইড ওয়াল তৈরি, কমিউনিটি হলরুম এবং কমপ্লেক্স, নতুন ডাইনিং রুম নির্মাণ করা হয়েছে। উপজেলা পরিষদ চত্বরকে আধুনিকায়ন করতে স্থাপন করা হয়েছে স্ট্রিট লাইট, বাউন্ডারি ওয়াল ও সিসি ক্যামেরা। তারও পাশে বনবিভাগে নির্মিত হয়েছে ইকোপার্ক। চিড়িয়াখানার আদলে এই ইকোপার্কে আনা হচ্ছে হাতি, হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণী। এতেও যুক্ত হচ্ছে পর্যটনের নতুনমাত্রা। এর সাথে এখানকার সবুজ চা, পাথর, হস্তশিল্প পর্যটনে আলাদা মাত্রা যুক্ত করেছে। এছাড়াও উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে চৌরাস্তা বাজারটিতে পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন নির্মাণ, পার্কিং এরিয়া নির্মাণ, সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য বৃক্ষরোপন, বসার জন্য বেঞ্চ, ওয়াকওয়ে, উন্মুক্ত মঞ্চ, বঙ্গবন্ধুর তর্জনী, মাল্টিপারপাস হাট শেড ও সিসি রোড নির্মাণ ও জাতীয় মহাসড়কে (এশিয়ান হাইওয়ে) বাইপাস রোডে স্থাপিত হয়েছে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্মরণীসহ বিভিন্ন ভাস্কর্য, ফলক নির্মাণের মাধ্যমে পর্যটন শিল্প আধুনিকায়নে রূপান্তরিত হয়েছে।


পর্যটকরা ডাকবাংলোর পিকনিক কর্ণারে দাঁড়িয়ে হিমালয়-কাঞ্চনজঙ্ঘা, মহানন্দা নদী, শ্রমিকদের পাথর উত্তোলন, ওপারে সীমানা প্রতিবেশী ভারতের কাটাতারের বেড়া, সার্চলাইট, চা বাগানসহ নানান কিছু দেখতে পান।


চলবে