চিফ স্কাউট হিসেবে রাষ্ট্রপতি এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ
নুরুল্লাহ মাসুম
একজন স্কাউট বলতেই পারে, জন্মের পর থেকে জেনে এসেছি
দেশের রাষ্ট্রপতি চিফ স্কাউট;
এ
নিয়ে হাইকোর্টে রিট কেন? প্রশ্নটা
যুক্তিসঙ্গ এবং সত্যও বটে। প্রশ্নটা
হলো- কোন আইনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি দেশের চিফ স্কাউট হলেন এবং এ দায়িত্ব
প্রদান/গ্রহণ করে রাষ্ট্রপতি সম্মানিত হলেন না কি তাঁর দফতরকে অসম্মানিত করা হলো? বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি
সম্পর্কে দেশের সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে:
৪৮। (১) বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকিবেন, যিনি আইন অনুযায়ী
সংসদ-সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত হইবেন।
(২) রাষ্ট্রপ্রধানরূপে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সকল ব্যক্তির
ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করিবেন এবং এই সংবিধান ও অন্য কোন আইনের দ্বারা তাঁহাকে প্রদত্ত
ও তাঁহার উপর অর্পিত সকল ক্ষমতা প্রয়োগ ও কর্তব্য পালন করিবেন।
(৩) এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল
প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র
ব্যতীত রাষ্টপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী
কার্য করিবেন:
তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী
রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোন পরামর্শদান করিয়াছেন কি না এবং করিয়া থাকিলে কি পরামর্শ দান
করিয়াছেন, কোন
আদালত সেই সম্পর্কে কোন প্রশ্নের তদন্ত করিতে পারিবেন না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যিনি দেশের “রাষ্ট্রের অন্য সকল
ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করিবেন”
তাঁকে
কোন আইন বলে বাংলাদেশ স্কাউটস এর মত একটি বেসরকারী সংগঠনের প্রধান হিসেবে মনোনীত
করা হয়? সংবিধান
বলছে “এই
সংবিধান ও অন্য কোন আইনের দ্বারা তাঁহাকে প্রদত্ত ও তাঁহার উপর অর্পিত সকল ক্ষমতা প্রয়োগ ও কর্তব্য পালন
করিবেন।” অথচ বাংলাদেশ স্কাউটস এর মত একটি বেসরকারী সংগঠন নিজস্ব ‘গঠন ও নিয়ম’ দ্বারা কি ভাবে মহামান্য রাষ্ট্রপতির
দায়িত্ব বন্টন করে? বলা
বাহুল্য, বাংলাদেশ
স্কাউটস এর ‘গঠন ও
নিয়ম’ দেশের কোন আইন নয়, বরং নিজস্ব গঠনতন্ত্র মাত্র।
যদিও দীর্ঘ দিন ধরে এই ধারা চলে আসছে
এবং সকলে প্রায় আত্মস্থ করে ফেলেছেন যে, রাষ্ট্রপতি পদাধিকার বলে দেশের ‘চিফ স্কাউট’
হয়ে
থাকেন; তবু
এটা ভেবে দেখার সময় এসেছে সংবিধান অনুসারে একটি বেসরকারী সংগঠনের প্রধান হিসেবে
দায়িত্ব পাল করাটা রাষ্ট্রপতির জন্য সম্মানজনক কি না? তাছাড়া বাংলাদেশ স্কাউটস
এর ‘গঠন ও
নিয়ম’ দিয়ে
রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব বন্টন করা যায় কি না? বাংলাদেশ স্কাউটস এর ‘গঠন ও নিয়ম’
এর
২৬ ধারা দিকে একটু নজর দেয়া যাক:
২৬। চীফ স্কাউট
(ক) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদাধিকারবলে
বাংলাদেশের চীফ স্কাউট। তিনি
বাংলাদেশের স্কাউট আন্দোলনের প্রেরণা ও উদ্দীপনার মূল উৎস। চীফ স্কাউট ইচ্ছা করলে এর যে কোন সভা
এবং অনুষ্ঠানে যোগদান করতে পারবেন।
(খ) যে কোন স্থানে ও সময়ে তিনি জাতীয় কাউন্সিলের সভা ডাকতে এবং
সেই সভায় সভাপতিত্ব করতে পারবেন।
(গ) জাতীয় কাউন্সিলের সাধারণ সভা তিনি মূলতবী অথবা স্থগিত ঘোষনা
করেত পারবেন।
(ঘ) ‘গঠন ও
নিয়ম’ এর
বিধি মোতাবেক স্কাউট সংগঠন সম্পর্কে তাঁর সিদ্দান্তই চূড়ান্ত বিবেচিত হবে।
(ঙ) জাতীয় কাউন্সিলের সুপারিশক্রমে তিনি তাঁর স্বাক্ষরিত সনদপত্র দ্বারা
প্রধান জাতীয় কমিশনার নিয়োগ করবেন।
(চ) প্রধান জাতীয় কমিশনারের সুপারিশক্রমে তিনি নিজ স্বাক্ষরে জাতীয় কমিশনার এবং
আঞ্চলিক কমিশনারদের সনদ দেবেন।
(ছ) প্রধান জাতীয় কমিশনারের সুপারিশক্রমে তিনি প্রেসিডেন্ট’স স্কাউট ও প্রেসিডেন্ট’স রোভার স্কাউট অ্যাওয়ার্ড
অনুমোদন করবেন এবং তাতে স্বাক্ষর করবেন।
একই সাথে বর্ণিত ‘গঠন ও নিয়ম’ এর ৩ ধারার দিকে নজর
বুলিয়ে নেয়া যাক।
৩। আদর্শ
(ক) বাংলাদেশ স্কাউটস সরকার বা কোন সংস্তা, গোষ্ঠী ও ব্যক্তির
নিয়ন্ত্রণ-নিরপেক্ষ স্বেচ্ছাধর্মী একটি প্রতিষ্ঠান।
(খ) স্কাউট আন্দোলনের বিশ্ব সংস্থা (ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অব
দি স্কাউট মুভমেন্ট)-র সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের স্কাউটিং বিশ্ব স্কাউটিংয়ের আদর্শ
ও স্বীকৃত পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে।
(গ) এ প্রতিষ্টানের নীতি, ট্রেনিং ও প্রোগ্রাম অসাম্প্রদায়িক,
শ্রেণী
বৈষম্যহীন ও উদার ধর্মীয় চেতনার উপর গুরুত্ব দেবে।
(ঘ) এর সদস্যগণ স্কাউট পোশাক পরে কোন রাজনৈতিক সভা-সমিতি অথবা
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে নিয়োজিত কোন কাজে অংশগ্রঞণ করতে পারবে না।
(ঙ) এর সদস্যগণ কোন রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক, সরকারী, বেসরকারী মতবিরোধে কোন
পক্ষ সমর্থন করবে না।
এবার ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, স্কাউট সংগঠন নিজেই বলছে
সংগঠনটি সরকার নিয়ন্ত্রিত নয়,
অতএব
এটি একটি বেসরকারী সংগঠন অর্থাৎ এনজিও। একটি এনজিও যদি নিজ গঠনতন্ত্রে
রাষ্ট্রপতিকে তাদের প্রধান মনোনীত করে, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির মর্যাদা হানি হয় না বৃদ্ধি পায়? পক্ষান্তরে, যেভাবেই হোক পূর্বেকার সকল
রাষ্ট্রপতি ‘চীফ
স্কাউট’ হিসেবে
দায়িত্ব পালন করে থাকলেও বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৮(২) অনুচ্ছেদ মতে তাঁর পক্ষে ‘চিফ স্কাউট’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা
কি সম্ভব? বোধগম্য
নয়, কোন
কালে কোন কর্তাব্যক্তি বিষয়টি মহামান্য রাষ্ট্রপতির গোচরে এনেছিলেন কি না।
বাংলাদেশ স্কাউটস এর ‘গঠন ও নিয়ম’ এর ২৬ ধারার (ঙ), (চ) ও (ছ) উপধারা মতে ‘চিফ স্কাউট’ হিসেবে রাষ্ট্রপতি যখন
দায়িত্ব পালন করেন তখন কি সেই দায়িত্ব পালন বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের
পরিপন্থি হয়ে ওঠে না? বিষয়টি
আর বিস্তারিত আলোচনা না করলেও এটা আশাকরি সকলের কাছে পরিস্কার যে, বাংলাদেশ স্কাউটস এর
প্রধান জাতীয় কমিশনার যে কাজগুলো ‘চিফ
স্কাউট’কে
দিয়ে করিয়ে নিচ্ছেন, তা
দেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক।
একবার ভাবুন, রাষ্ট্রপতি সংবিধান
অনুসারে স্পিকারের কাছে (আগে প্রধান বিচারপতি শপথ পাঠ করাতেন) শপথ বাক্য পাঠ করেন। শপথ গ্রহণপূর্বক রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব
গ্রহণের পর তাঁকে আবারো শপথ নিতে হয় স্কাউটস এর প্রধান জাতীয় কমিশনারের কাছে- যিনি
একজন সরকারী কর্মকর্তা (শুরু থেকেই একজন সচিব এ দায়িত্ব পেয়ে আসছেন)। রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তিতে তারই
অধীনস্থ এক সরকারী কর্মকর্তা তাঁকে শপথ বাক্য পাঠ করানোর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতির
মর্যাদা হানি হয় না কি? লক্ষ্যনীয়, স্পিকার ও প্রধান বিচারপতি
দুটো পদই সাংবিদানিক পদ; পক্ষান্তেরে
স্কাউটস এর প্রধান জাতীয় কমিশনারের পদে যিনি আছেন বা ছিলেন, তিনি সরকারী কর্মকর্তা। বিষয়টি নিয়ে ভাবনা হয় বৈকি।
সঙ্গত কারণেই রিট পিটিশন দাখিল করলে
মহামান্য হাইকোর্ট এ বিষয়ে রুল জারি করেন।
আগামীতে: কেন সরকারী কর্মকর্তাগণ
পদাধিকারবলে স্কাউট সংগঠনের বিভিন্ন পদে থাকতে পারেন না............ চোখ রাখুন এই
পাতায়।