নুরুল্লাহ মাসুম
চা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। সমতলের চা চাষের পথিকৃত জেলা
পঞ্চগড়। ২০০০ সালে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষুদ্র পর্যায়ে সমতলের চা শিল্পের
যাত্রা শুরু হয়। দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর সমতল ভূমিতে চা চাষ দেশের অর্থনৈতিক
উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। এক সময়ের পতিত গোচারণ ভূমি এখন সবুজ পাতায় ভরে
গেছে। পঞ্চগড়ের চা ইতোমধ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারসহ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করেছে।
পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে চা চাষে নীরব বিপ্লব সাধিত হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের
চা মানচিত্রে উত্তরাঞ্চলের সমতলের চা দেশের দ্বিতীয় চা উৎপাদনকারী অঞ্চল হিসেবে স্থান
করে নিয়েছে।
আমরা আনন্দ ধারার ভেতরটা ঘুরে-ফিরে দেখলাম বেশ সময় নিয়ে। এখানে পর্যটকদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে, তবে তা বেশ ব্যয়বহুল এবং সাধারণ যোগাযোগ সহজসাধ্য নয় বলে এখানে সাধারণ পর্যটকদের আনাগোনা খুব কম। কেবল দেখার জন্যই এখানে পর্যটকরা এসে থাকেন। তবে কর্পোরেট লেভেলের যে কোন আয়োজনের জন্য স্থানটি চমৎকার।
পরের গন্তব্য পঞ্চগড়ের অন্যতম গড় ভিতরগড় এবং সেখানেই আরেকটি দর্শনীয় স্থান
মহারাজার দিঘী। সমতলের চা বাগান অতিক্রম করে প্রথমে চাইলি বা চাওয়াই নদী ও পরে শালমারা
খাল অতিক্রম করে এগিয়ে চললাম ভিতরগড়ের সন্ধানে। এর সন্ধান পেতে আমাদের অনেক কাঠ-খড়
পোড়াতে হয়েছে। যদিও জেনেছি, অবসরপ্রাপ্ত সচিব সুহেল
আহমেদ চৌধুরী, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ এন. এম. হাবিবুল্লাহ এবং শাহনাজ হুসনে জাহানের নেতৃত্বে
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ভিতরগড় সংরক্ষণ সমিতি গঠিত হয়। সমিতি ভিতরগড় দুর্গ সম্পর্কে জনসচেতনতা
বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে এবং ভিতরগড়ে উৎখনন এবং উৎখননে প্রাপ্ত প্রত্ননিদর্শনের সংরক্ষণের
বিষয়েও এই সমিতি সক্রিয় রয়েছে। তবু স্থানীয় লোকজন এটির সন্ধান দিতে বারবার
ব্যর্থ হয়েছে।
ভিতরগড় পঞ্চগড় জেলার সদর
থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তরে সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নে অবস্থিত মধ্যযুগের একটি দুর্গ
নগরী। আয়তন ২৫ বর্গ কিলোমিটার। ইঙ্গ-আইরিশ সরকারী কর্মকর্তা রবার্ট মন্টগোমারি মার্টিন
কর্তৃক লিখিত দ্য হিস্ট্ররী, এন্টিকুইটিস,
টপোগ্রাফি এণ্ড স্ট্যাটিসটিকস অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া গ্রন্থটির ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে
প্রকাশিত ৩য় খণ্ডে সর্বপ্রথম ভিতরগড় দুর্গের উল্লেখ দেখা যায়। ভিতরগড় দূর্গের অভ্যন্তরে
২২ প্রত্নস্থল চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানা যায়। দুর্গটি কয়েকটি স্তরে চারটি
আবেষ্টনী দেওয়াল দিয়ে বিভক্ত ছিলো এবং এর উত্তর দিকের দেওয়াল এবং পূর্ব-পশ্চিম দেওয়ালের
বেশীরভাগ অংশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলায় পড়েছে। ১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে বুকানন
হ্যামিল্টন ভিতরগড় পরিদর্শন শেষে লিখেছিলেন যে, “ভিতরগড় নগরীটি চারটি আভ্যন্তরীক
গড়ের সমবায়ে গঠিত। গড়গুলির একটি অপরটির অভ্যন্তরভাগে অবস্থিত। রাজার প্রাসাদ অবস্থিত
ছিল সবচেয়ে ভিতরের গড়ে। সবচেয়ে ভিতরের এবং মধ্যবর্তী নগরীর উপবিভাগ ছিল। প্রতিটি
নগরী সুইচ্চ দুর্গপ্রাচীর ও সুবৃহৎ পরিখা দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল যার প্রস্থ প্রায়
৫০ ফুট এবং গভীরতা ১০ থেকে ১৫ ফুট। দুর্গর প্রাচীর মাটি ও ইটের মিশ্রণে তৈরী ছিল। দুর্গ
নগরীটি কয়েকটি ক্ষুদ্র নগরীতে বিভক্ত ছিল। পূর্ববাহুর সবচেয়ে বাইরের নগরীতে নিম্নবর্গীয়
মানুষজন বসবাস করতো।” ধারণা
করা হয়, দুর্গটি নির্মাণ করেছেন কামরূপ রাজ্যের মহারাজা পৃথু। মতান্তরে মহারাজা
পৃথু ছিলেন জলপেশ্বর রাজ্যের রাজা এবং এটি ছিল তার রাজধানী। ১২০৬ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন
মহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি এবং ১২২৬ সালে সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবনের সাথে তিনি যুদ্ধে
জয়লাভ করেছিলেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। কথিত আছে, মহারাজা পৃথু রাজা পরিবার-পরিজন
ও ধনরত্ন-সহ ‘কীচক’ নামক এক নিম্ন শ্রেণীর দ্বারা
আক্রমণের শিকার হয়ে তাদের সংস্পর্শে ধর্ম নাশের ভয়ে উক্ত দিঘীতে আত্মহনন করেন; এর কোন
সঠিক সময় ও তারিখ জানা যায় না। অনেক পরে ১২৫৭
সালে সুলতান মুঘিসউদ্দীন কামরূপ রাজ্য আক্রমণ করলে ভিতরগড় সুলতানী শাসনে চলে
যায়। ১৪৫৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ভিতরগড় অঞ্চলটি কামরূপ রাজ্যের হোসেন শাহ শাসন
করেছেন। এছাড়াও এ অঞ্চলটি কোন এক একসময় গৌড় ও প্রাগজ্যোতিষপুরের অংশ
ছিলো বলে মনে করা হয়। ২০০৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৬ আগস্ট ২০১৬ তারিখে বাংলাদেশের সহযোগী অধ্যাপক প্রত্নতত্ত্ববিদ
ড. শাহনাজ হুসনে জাহান লীনার তত্ত্বাবধানে বেশ কয়েকবার খননকাজ পরিচালনা করাহয়। তবে বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে এবং কোন
প্রকার কর্মযজ্ঞ দেখা গেল না। আমরা দেখতে পেলাম গড়ের পুরো এলাকাজুড়ে চা-বাগান করা হয়েছে।
এও দেখলাম, যত্রতত্র পুরাতন ইটের ছড়াছড়ি। সরকারি উদ্যোগে ইতিহাসের অস্তিত্ব সামনে আনা
সম্ভব বলে আমরা মনে করি। এতকরে আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস যেমন সামনে চলে আসবে, তেমনি পর্যটনখাত
লাভবান হবে।