শনিবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০২৪

বরেন্দ্র ও প্রাগজ্যোতিষপুরের তেতুলিয়া - নবম পর্ব

 নুরুল্লাহ মাসুম


নবম পর্ব

১৯৯৭ সালে কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ নাজমুল হকের প্রচেষ্টায় পাথর জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৮ সালে সরকার রকস মিউজিয়াম-এর জন্য একটি দ্বিতল ভবন নির্মাণ করে। উল্লেখ্য, এটি বাংলাদেশের একমাত্র পাথরের জাদুঘর। জাদুঘরে পঞ্চগড় জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক ও লোকজ সংগ্রহ রয়েছে ১,০০০ এরও বেশি। জাদুঘরের দুটি গ্যালারি রয়েছে। ভবনের ভেতরের গ্যালারিতে রয়েছে বিভিন্ন আকৃতি, রং ও বৈশিষ্ট্যের আগ্নেয়শীলা, পাললিক শীলা ও নুড়ি পাথর, সিলিকা নুড়ি ও সিলিকা বালি, হলুদ ও গাঢ় হলুদ বালি, খনিজবালি, সাদা মাটি, তরঙ্গায়িত চ্যাপ্টা পাথর, লাইমস্টোন, পলি ও কুমোর মাটি এবং কঠিন শীলা। এখানে বহু বছরের পুরনো ইমারতের ইট, পোড়ামাটির মূর্তিও রয়েছে। একটি শাল গাছ দিয়ে তৈরি ২২ ফুট দৈর্ঘ্যের ৩০০ বছর পুরনো দুইটি নৌকাও রয়েছে। ভবনের বাইরে রয়েছে বেশ কিছু বড় বড় পাথর। জাদুঘরের ভেতরের গ্যালারিতে একটি জাতিতাত্ত্বিক সংগ্রহশালাও আছে, যেখানে রয়েছে এ অঞ্চলের  আদিবাসীদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র। আছে তিনশ’ থেকে দুই হাজার বছরের পুরনো ইমারতের ইট-পাথরের মূর্তি এবং পোড়ামাটির নকশা। এছাড়াও রয়েছে এ অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যবহৃত কাচিয়া, কাত্তি, ফুতি, খরম, টপুনি, তাড়ি, ঘোট, কিয়া, সিঁদুর দানি। রয়েছে কালনাগ, মনসার পিতলের মূর্তি, বিষহরির মূর্তি, বিষ্ণু-গণেশের মূর্তি, ধাতবপাত্র, প্রদীপ, পঞ্চপ্রদীপ, কুঠি (কাঁশ দিয়ে তৈরি), টার শিকিয়া, ভশ্মীভূত পিঁপড়ার বাসা, হুলির গানে ব্যবহৃত ঢোল, হিন্দু আদিবাসীদের ব্যবহৃত বিয়ের ডালা, প্রবাল পাথর, একতারা, পাথরের সেতুতে ব্যবহৃত আয়ুধ, সাকামচুকি (সাঁওতালদের ব্যবহৃত বিড়ি বিশেষ), তীর-ধনুক, মোঘল সৈনিকদের ব্যবহৃত তরবারি, পাথরের বাটি, জীবজন্তু ও ফুলের নকশা উৎকীর্ণ বাঁশের বেড়া, রাজমহল পাহারের কালো পাথর, বিভিন্ন প্রাচীন মুদ্রাসহ দুর্লভ সব সংগ্রহ।এছাড়া হাজার বছরের পুরনো চুক্তিনামা, মোগল সাম্রাজ্য ও ব্রিটিশ শাসনামলের রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রা সংরক্ষিত আছে। পাথরের ওপরে লেখা চীন-নেপালি লিপির মুদ্রণ রয়েছ। বারো রকমের রঙিন বালু এই মিউজিয়ামকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। জাদুঘর দেখার জন্য ১০ টাকা মূল্যের টিকিট কাটতে হয়, যা কি না নেয়া হয়েছ জাদুঘর পরিদর্শ শেষে।

 

কলেজ চত্তরে, রকস মিউজিয়ামের সামনে একটি ফলক অন্য সকলের মতোই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যেখানে লেখা রয়েছে পঞ্চগড় জেলার প্রথম চা বাগান। ফলকের পেছনেই ছোট্ট পরিসরে কয়েকটি চা গাছের সমন্বয়ে ছোট্ট একটি চা বাগান। এপ্রসঙ্গে ফলকে উৎকীর্ণ তথ্য হচ্ছে, রকস মিউজিয়াম স্থাপনের সময় জেলা প্রশাসকের দেয়া প্রস্তাব মেনে নিয়ে কলেজ অধ্যক্ষ নিজ উদ্যোগে চা গাছের চারা সংগ্রহ করে কি ভাবে সমতলে চা গাছের চাস করলেন। ১৯৯৭ সালের ৫ মে সেই জেলা প্রশাসক এই চা বাগানের উদ্বোধন করেন। এর পর থেকেই পঞ্চগড় ও পরে ঠাকুরগাঁর সমতলে চা বাগান বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়।
সময় হাতে খুব কম, এখনো দেখার অনেক কিছু বাকী। তবে 
তোমধ্যে বুঝে গেছি, সবগুলো স্থান দর্শন করা সম্ভব হবে না এবারের যাত্রায়। এবার আমরা দুপুরের খাবারের জন্য হাজির হই শহরের রহমানিয়া হোটেলে, দুপুর গড়িয়ে বেলা তখন তিনটা। খাবার বর্ণনা দেবার মতো কোন বিষয় নয়, তবে যাদের খাবারের মেনূ্তে বিশেষ নির্দশনা থাকে তাদের জন্য বাইরে খাওয়ার বিষয়টা খুব কষ্টসাধ্য হয়ে থাকে- এটা মেনে নিয়েই ভ্রমনে বের হতে হয়।
মহিউদ্দীন ভাই আগে থেকে ঠিক করেছিলেন পঞ্চগড় সুগার মিল দেখাবেন। সেমতে আমরা সেখানে হাজির হলে অফিস সময় অতিক্রম হয়ে যাওয়ায় আমরা সুগার মিলের ভেতরে যেতে পারিনি। বলে রাখা দরকার, একন চিনি উৎপাদন মৌসুম নয়, মিলের যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষ হচ্ছে, ইক্ষু ম্যসুম শুরু হলেই চিনি উৎপাদনের মৌসুম শুরু হবে। তাই ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসতে হলো। তবে আশার আলো জেগে রইলো, পরদিন সকালে ঠাকুরগায় চিনি কল দেখার সুযোগ পাবো অফিস টাইমের মধ্যেই।
এ পর্যায়ে পঞ্চগড় শহরের কিছু কিছু এলাকা দেখে, বিশেষত পঞ্চগড় রেলওয়ে স্টেশন, যেটি বেশ পরিচ্ছন্ন সেটি দেখা হলো। বর্তমানে পঞ্চগড় রেল স্টেশনের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম- সংক্ষেপে বীমুসিই। এরপরে পঞ্চগড় জেলার সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউনিয়নে প্রবেশ মুখের ফলকের সামনে নেমে ধাক্কা মারতে কয়েকজন নেমে গেলেন। আমি ছবি তুললাম। ইউনিয়নের নামকরণের কারণে এখানে আগত অনেকেই এই ফলকটাকে একবার ধাক্কা মেরে যায় বলে জেনেছি এবং কিছু ছবিও দেখেছি। কেবল আনন্দ করার জন্যই এমনটি করে থাকে পর্যটকরা। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, ঠাকুরগাঁ, পঞ্চগড় সহ দপুরো দেশে এমন কিছু এলাকা ও প্রতিষ্ঠানের এমনকিছু নাম আছে যা সকলের কাছে সমানভাবে গ্রহনযোগ্য নয়, কোনকোনটা তো শুদ্ধ বাংলায় অশ্লিলতার পর্যায়ভুক্ত। কোন কোন ক্ষেত্রে এগুলো পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হলেও অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে এর আক্ষরিক অর্থ মন্দ না হওয়ায় স্থানীয় বাধার মুখে তা পরিবর্তন করা যায়নি বলে জেনেছি।
ধাক্কা মেরে বা ধাক্কা খেয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হলো পরবর্তী গন্তব্য টাঙ্গন ব্যারেজ। টাঙ্গন ব্যারেজ ঠাকুরগাঁ সদর উপজেলার রুহিয়ার রাজাগাঁ ইউনিয়ন পরিষদের চাপাতি গ্রামে অবস্থিত। টাঙ্গন নদী বাংলাদেশ-ভারতের মধ্য দিয়ে সমানভাবে প্রবাহিত। এটি একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। নদীটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। টাঙ্গন পুনর্ভবা নদীর একটি উপনদী। দুদেশের পানি ভাগাভাগি নিয়ন্ত্রণে নির্মাণ করা হয়েছে টাঙ্গন ব্যারেজ। এটি ১৯৮৪-১৯৮৫ সালে শুরু হয়ে ১৯৯২-১৯৯৩ সালে শেষ হয়। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য, এলাকার আমন মৌসুমে সেচ সুবিধা প্রদান। প্রকল্প আওতাভুক্ত জমি ৬০৭০ হেক্টর ও সেচ যোগ্য জমি ৪৪৫০ হেক্টর। ব্যারেজের পানি নির্গমন ক্ষমতা প্রতি সেকেন্ডে ২৮৭ ঘনমিটার। বর্ষা মৌসুমে এই ব্যারেজ এলাকা ভ্রমণ পিপাসুদের দৃষ্টি কাড়ছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক ভিন্ন রূপ ছড়িয়ে আছে ব্যারেজ এলাকায়। অবশ্য শীতকালেও এক ভিন্ন রূপ পায় টাঙ্গন ব্যারেজ পর্যকটদের কাছে। প্রতিবছর শীতকালে পানি কমে গেলেও বর্ষাকালে টাঙ্গন পানিতে থৈ থৈ। ভরা মৌসুমে মৎস্য বিভাগের আওতায় টাঙ্গন নদীর ওপর নির্মিত টাঙ্গন ব্যারেজের প্লাবন ভূমিতে সরকারিভাবে মাছ অবমুক্ত করা হয়। তিন মাস পর ব্যারেজের গেট খুলে দিলে এখানে শুরু হয় পাঁচ দিনব্যাপী মাছধরার উৎসব। পঞ্চগড়, দিনাজপুর নীলফামারীসহ দেশের বিভিন্ন জেলার মাছ শিকারিরা এখানে এসে তাবু গেঁড়ে, কেউ কলাগাছের ভেলায় আবার কেউ নৌকা করে বিস্তীর্ণ এলাকায় মাছ শিকার করেন। এতে প্রতিদিন এখানে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়। কাঞ্চনজঙ্ঘায় সকালের কাঁচা রোদে চকচক করা অপরূপ সৌন্দর্য দেখা যায় টাঙ্গন ব্যারেজের ওপর থেকে।

চলবে 

সোমবার, ২২ জানুয়ারী, ২০২৪

বরেন্দ্র ও প্রাগজ্যোতিষপুরের তেতুলিয়া - অষ্টম পর্ব

নুরুল্লাহ মাসুম 


অষ্টম পর্ব

চা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। সমতলের চা চাষের পথিকৃত জেলা পঞ্চগড়। ২০০০ সালে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষুদ্র পর্যায়ে সমতলের চা শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর সমতল ভূমিতে চা চাষ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। এক সময়ের পতিত গোচারণ ভূমি এখন সবুজ পাতায় ভরে গেছে। পঞ্চগড়ের চা ইতোমধ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারসহ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করেছে। পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে চা চাষে নীরব বিপ্লব সাধিত হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের চা মানচিত্রে উত্তরাঞ্চলের সমতলের চা দেশের দ্বিতীয় চা উৎপাদনকারী অঞ্চল হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।

আমরা আনন্দ ধারার ভেতরটা ঘুরে-ফিরে দেখলাম বেশ সময় নিয়ে। এখানে পর্যটকদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে, তবে তা বেশ ব্যয়বহুল এবং সাধারণ যোগাযোগ সহজসাধ্য নয় বলে এখানে সাধারণ পর্যটকদের আনাগোনা খুব কম। কেবল দেখার জন্যই এখানে পর্যটকরা এসে থাকেন। তবে কর্পোরেট লেভেলের যে কোন আয়োজনের জন্য স্থানটি চমৎকার।

পরের গন্তব্য পঞ্চগড়ের অন্যতম গড় ভিতরগড় এবং সেখানেই আরেকটি দর্শনীয় স্থান মহারাজার দিঘী। সমতলের চা বাগান অতিক্রম করে প্রথমে চাইলি বা চাওয়াই নদী ও পরে শালমারা খাল অতিক্রম করে এগিয়ে চললাম ভিতরগড়ের সন্ধানে। এর সন্ধান পেতে আমাদের অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে। যদিও জেনেছি, অবসরপ্রাপ্ত সচিব সুহেল আহমেদ চৌধুরী, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ এন. এম. হাবিবুল্লাহ এবং শাহনাজ হুসনে জাহানের নেতৃত্বে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ভিতরগড় সংরক্ষণ সমিতি গঠিত হয়। সমিতি ভিতরগড় দুর্গ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে এবং ভিতরগড়ে উৎখনন এবং উৎখননে প্রাপ্ত প্রত্ননিদর্শনের সংরক্ষণের বিষয়েও এই সমিতি সক্রিয় রয়েছে। তবু স্থানীয় লোকজন এটির সন্ধান দিতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে।

ভিতরগড় পঞ্চগড় জেলার সদর থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তরে সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নে অবস্থিত মধ্যযুগের একটি দুর্গ নগরী। আয়তন ২৫ বর্গ কিলোমিটার। ইঙ্গ-আইরিশ সরকারী কর্মকর্তা রবার্ট মন্টগোমারি মার্টিন কর্তৃক লিখিত দ্য হিস্ট্ররী, এন্টিকুইটিস, টপোগ্রাফি এণ্ড স্ট্যাটিসটিকস অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া গ্রন্থটির ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ৩য় খণ্ডে সর্বপ্রথম ভিতরগড় দুর্গের উল্লেখ দেখা যায়। ভিতরগড় দূর্গের অভ্যন্তরে ২২ প্রত্নস্থল চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানা যায়। দুর্গটি কয়েকটি স্তরে চারটি আবেষ্টনী দেওয়াল দিয়ে বিভক্ত ছিলো এবং এর উত্তর দিকের দেওয়াল এবং পূর্ব-পশ্চিম দেওয়ালের বেশীরভাগ অংশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের  জলপাইগুড়ি জেলায় পড়েছে। ১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে বুকানন হ্যামিল্টন ভিতরগড় পরিদর্শন শেষে লিখেছিলেন যে, ভিতরগড় নগরীটি চারটি আভ্যন্তরীক গড়ের সমবায়ে গঠিত। গড়গুলির একটি অপরটির অভ্যন্তরভাগে অবস্থিত। রাজার প্রাসাদ অবস্থিত ছিল সবচেয়ে ভিতরের গড়ে। সবচেয়ে ভিতরের এবং মধ্যবর্তী নগরীর উপবিভাগ ছিল। প্রতিটি নগরী সুইচ্চ দুর্গপ্রাচীর ও সুবৃহৎ পরিখা দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল যার প্রস্থ প্রায় ৫০ ফুট এবং গভীরতা ১০ থেকে ১৫ ফুট। দুর্গর প্রাচীর মাটি ও ইটের মিশ্রণে তৈরী ছিল। দুর্গ নগরীটি কয়েকটি ক্ষুদ্র নগরীতে বিভক্ত ছিল। পূর্ববাহুর সবচেয়ে বাইরের নগরীতে নিম্নবর্গীয় মানুষজন বসবাস করতো।ধারণা করা হয়, দুর্গটি নির্মাণ করেছেন কামরূপ রাজ্যের  মহারাজা পৃথু। মতান্তরে মহারাজা পৃথু ছিলেন জলপেশ্বর রাজ্যের রাজা এবং এটি ছিল তার রাজধানী। ১২০৬ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি এবং ১২২৬ সালে সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবনের সাথে তিনি যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। কথিত আছে, মহারাজা পৃথু রাজা পরিবার-পরিজন ও ধনরত্ন-সহ কীচক নামক এক নিম্ন শ্রেণীর দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়ে তাদের সংস্পর্শে ধর্ম নাশের ভয়ে উক্ত দিঘীতে আত্মহনন করেন; এর কোন সঠিক সময় ও তারিখ জানা যায় না। অনেক পরে  ১২৫৭ সালে সুলতান মুঘিসউদ্দীন কামরূপ রাজ্য আক্রমণ করলে ভিতরগড় সুলতানী শাসনে চলে যায়। ১৪৫৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ভিতরগড় অঞ্চলটি কামরূপ রাজ্যের হোসেন শাহ শাসন করেছেন। এছাড়াও এ অঞ্চলটি কোন এক একসময়  গৌড় ও প্রাগজ্যোতিষপুরের অংশ ছিলো বলে মনে করা হয়। ২০০৯ সালে  ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৬ আগস্ট ২০১৬ তারিখে বাংলাদেশের সহযোগী অধ্যাপক প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. শাহনাজ হুসনে জাহান লীনার তত্ত্বাবধানে বেশ কয়েকবার খননকাজ পরিচালনা করাহয়।  তবে বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে এবং কোন প্রকার কর্মযজ্ঞ দেখা গেল না। আমরা দেখতে পেলাম গড়ের পুরো এলাকাজুড়ে চা-বাগান করা হয়েছে। এও দেখলাম, যত্রতত্র পুরাতন ইটের ছড়াছড়ি। সরকারি উদ্যোগে ইতিহাসের অস্তিত্ব সামনে আনা সম্ভব বলে আমরা মনে করি। এতকরে আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস যেমন সামনে চলে আসবে, তেমনি পর্যটনখাত লাভবান হবে।

একবুক কষ্ট নিয়ে ফিরে এলাম ভিতরগড় থেকে। এবারের গন্তব্য মহারাজার দিঘী। ধারণা করা হয়, ভিতরগড় দূর্গের নিকটবর্তী এই দিঘী মহারাজা পৃথু বা তার অধস্তন কোন রাজা খনন করিয়েছিলেন। দ্বাদশ শতকের প্রথম ভাগে তিনি কামরূপ রাজ্যের শাসক ছিলেন। বর্তমানে পঞ্চগড় সদর উপজেলাধীন অমরখানা ইউনিয়নে ভিতরগড়ের অতি নিকটেই অবস্থিত মহারাজার । পাড়সহ এর আয়তন প্রায় ৮০০ × ৪০০ গজ। পানি অতি স্বচ্ছ। একদা এ দিঘীতে রয়েছে মোট ১০টি ঘাট থাকলেও এখন সেগুলোর অবস্থা ভালো নয় । প্রতি বছর বাংলা নববর্ষে উক্ত দিঘীর পাড়ে মেলা বসে। উক্ত মেলায় কখনো কখনো ভারতীয় লোকেদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এই বিশাল দিঘীর চারপাশে রয়েছে অনেক গাছগাছালির সবুজের কারুকার্য, স্নিগ্ধ সমীরণ, সৌম্য শান্ত পরিবেশ যা এখনো সবার কাছে বিরল মনে হয়। মূলত ২০১৮ সালে সরকারি উদ্যোগে দিঘূর চারিধারে বনায়ন কার্যক্রম চালু করা হয়। এখানে স্থানীয় উদ্যোগে কিছু লোকজন নৌকায় দিঘী পরিভ্রমণের ব্যবস্থা করেছে অথ্যের বিনিময়ে। জেলা প্রশাসন এখানে দুটি ফলক টানিয়ে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে, যার একটিতে দিঘী সম্পর্কে কিছু তথ্য অন্যটিতে বনায়ন কার্যক্রম উদ্বোধনের দিন-তারিখ উৎকীর্ণ রয়েছে।প্রতিদিন এখানে দর্শনার্থীর ভীর থাকলেও নির্মিত গণ-শৌচাগারটি ব্যবহারযোগ্য নয় বিধায় বিশেষত নারী পর্যটকদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এখানে আমাদের দলের সদস্যরা স্থানীয়ভাবে তৈরি কিছু খাবারের স্বাদ গ্রহণ করে।
দুপুর একটা পর্যন্ত দিঘী ও দিঘীর পাড়ে সময় কাটিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হলো পঞ্চগড় প্রেসক্লাবের উদ্দেশ্যে। সেখানে অপেক্ষামান সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের সাথে দেখা করতে হবে। প্রেসক্লাবের সম্পাদক বিপ্লব বারংবার যোগাযোগ করছেন। বিপ্লব জেবুবনেসা হেলেনের বন্ধু এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আমার সাথে যুক্ত রয়েছেন জানলাম।  বেলা দেড়টার দিকে প্রেসক্লাবে পৌঁছে একটু অবাকই হলাম। ১০/১২জন সাংবাদিক নেতা সেখানে উপস্থিত, অপেক্সা করছেন আমাদের জন্য। সংক্ষিপত্ সময়ে তাদের সাথে আরাম হলো। পেশাগত ও ব্যক্তিগত আলোচনাই ছিল মুখ্য। মহিউদ্দীন ভাই পঞ্চগড়ে কাজ করেছেন বহু বছর, তাই তিনি সেখান পরিচিত এক মুখ। হৃদ্যতাপূর্ণ আলোচনার মধ্য দিয়ে আমাদের প্রেসক্লাব পরিদর্শন শেষ হলে এগিয়ে চললাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সরকারি মহিলা করেজ প্রাঙ্গনে স্থাপিত রকস মিউজিয়াম দেখতে। দুজন সাংবাদিক আমাদের সঙ্গ দিলেন।

রবিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৪

বরেন্দ্র ও প্রাগজ্যোতিষপুরের তেতুলিয়া - সপ্তম পর্ব

 নুরুল্লাহ মাসুম


সপ্তম পর্ব


তেতুলিয়া ডাক বাংলো থেকে ফেরার পেথ দেখে নিলাম, স্থানীয় ভাষায় কথিত শিলিগুড়ি পয়েন্ট। মূলত এটি মহানন্দা নদীর তীরে একটি ভিউ পয়েন্ট, যেখান থেকে অদূরে মহানন্দা নদীর উপর একটি সেতু দেখা যায়, যা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ বিভাগের উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুর মহাকুমা ও জলপাইগুড়ি বিভাগের দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহাকুমার মধ্যে সংযোগ সাধন করেছে। এই পয়েন্টেও নদীর মাঝ বরারব ভারত বাংলাদেশ সীমানা। এখান থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া দেখা যায়। এখানে নদী পুরোটাই ভারতের অংশ, তবে কিছুটা উত্তরে এগুলো সীমান্ত নদীর মাঝ বরাবর। এখানেই দেখা মেলে বিশেষ ধরণের বাঁশ, মোটা ধরণের এবং হালকা হলুদ রঙের এই বাঁশ অন্য এলাকায় দেখা যায় না। আরেকটা কথা জানিয়ে রাখা ভালো, তেতুলিয়া থেকে বাংলা বান্ধা পর্যন্ত দশ কিলোমিটারেরও বেশী দীর্ঘ (অবশ্যই একেবারে সরল রৈখিক নয়) মহানন্দা নদীটাই মূলত ভারত বাংলাদেশ সীমানা নির্ধারণ করেছে। এমনটা খুব একটা দেখা যায় না, যেমনটি দেখা যায়না সীমান্তে বাংলাদেশের সড়ক, এখানে দশ কিলোমিটার দীর্ঘ সোজা সড়ক নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশ ভারত সীমান্তের বাংলাদেশ অংশে। সে বিষয়ে পরে বলা যাবে।

তেতুলিয়া সম্পর্কে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরো সময়টাই তেতুলিয়া ছিল মুক্তাঞ্চল; এই উপজেলায় পাক হানাদার বাহিনী কখনো পা রাখতে পারেনি। এর পেছনের কারণ জানা গেল, ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত মুক্ত ছিল পঞ্চগড় জেলা। ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা পঞ্চগড় দখলে নেয়। এ দিনে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে না পেরে উত্তরের দিকে পেছাতে থাকেন। শেষমেশ মাগুরমারী এলাকায় আশ্রয় নেয়ার আগে তেঁতুলিয়ায় পাক হানাদার বাহিনীকে প্রবেশ করতে না দেয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা পঞ্চগড়-তেতুলিয়া মহাসড়কের অমরখানা এলাকার চাওয়াই নদীর ব্রিজ (অমরখানা ব্রিজ) ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় তেঁতুলিয়া পাক হানাদার বাহিনীর আগ্রাসনমুক্ত থাকে। এ কারণে ওই সময় তেঁতুলিয়া হয়ে ওঠে স্বাধীন বাংলাদেশের মডেল। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসই মুক্তাঞ্চল হিসেবে এই ৭৪ বর্গমাইলের মানুষের জীবনযাত্রা ছিল স্বাভাবিক। বিয়ে, খতনা, আকিকাসহ সব ধরনণের সামাজিক অনুষ্ঠান পালন করেছে এখানকার মানুষ। নিরুপদ্রব হওয়ায় তেঁতুলিয়া যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক কর্মকাণ্ডের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়। এখান থেকে উত্তরাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালনাসহ রিক্রুটিং, প্রশিক্ষণ, অস্ত্রের জোগান দেওয়া ইত্যাদি কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। জানা যায়, তেঁতুলিয়া ৬ নম্বর সেক্টরের অধীন ৬/ক সাব-সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল। ওই সময় এখানে প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী এসেছেন এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজখবর নিয়েছেন। তেঁতুলিয়া থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করতেন সেক্টর কমান্ডার উইং কমান্ডার মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার (এম কে বাশার), সাব-সেক্টর কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীন, ক্যাপ্টেন নজরুল হক, ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার, লেফটেনেন্ট মাসুদ ও লেফটেনেন্ট মতিন। এম কে বাশার স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধান পদে নিযুক্ত হয়েছিলন। ১৯৭৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর এক বিমান দুর্ঘটনার তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সাব-সেক্টর কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীনও বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান হয়েছিলেন ১৯৭৭ সালের ৯ ডিসেম্বর। আরো জানা যায, ৬ নম্বর সেক্টরের প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হতো তেতুলিয়া ডাকবাংলো। সেক্টরের কমান্ডার খাদেমুল বাশার ডাকবাংলোর একটি কক্ষে থাকতেন। অন্য কক্ষটি ছিল মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান ও অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন আবুল মনসুরের জন্য। এ ডাকবাংলোয় যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক কর্মকাণ্ডের সিদ্ধান্ত হয়। তেঁতুলিয়ার খুব কাছেই ছিল ভারতের জলপাইগুড়ি দার্জিলিং। মুক্তি মিত্র বাহিনীর জন্য তাই তেঁতুলিয়া ছিল খুবই সুবিধাজনক একটি স্থান। ইতোমধ্যে তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোর পাশেই স্বাধীনতার তীর্থ তেতুলিয়া শিরোনামে মুক্তাঞ্চলের একটি  স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে, যাতে কবি শামসুর রাহমানের স্বাধীনতা তুমি কবিতাটির কিছু অংশ উৎকীর্ণ রয়েছে; যদিও এটির যত্ন-আত্মি খুব একটা নেই। এছাড়াও, যে সেতু ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে তেতুলিয়াকে মুক্তাঞ্চল রাখা সম্ভব হয়েছিলো সেই অমরখানার চাওয়াই নদীর (অমরখানা ব্রিজ) পাশে স্বাধীনতার মুক্তাঞ্চল নামে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।
তেতুলিয়া ডাক বাংলো এবং পিকনিক কর্নারের পাশে নির্মান করা হয়েছে বেরং কমপ্লেক্স। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত) প্রকল্পের আওতায় তেতুলিয়া সদর ইউনিয়নের আন্ত সীমান্ত নদী বেরং এর নামানুসারে এই কমপ্লেক্সটি নির্মিত হয়েছে সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির মানুষদের সহায়তার জন্য, যারা সীমান্তবর্তী দর্জিপাড়ায় বসবাস করে। এই কমপ্লেক্সে দুটি কটেজ ও একটি কিমিউনিটি ডাইনিং হল রয়েছে, যা পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। উপজেলা প্রশাসন এটির তদারকি করে থাকে।
তেতুলিয়া ডাক বাংলো এলাকায় আমাদের অবস্থান শেষে তেতুলিয়া বাজারের একটি রেস্টুরেন্টে সকালের নাশতা পর্ব শেষ করে পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু হয়। যেখানটায় আমরা নাশতা করি, শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি বড় তেতুল গাছ তেতুলিয়ার নামকরণের সার্থকতা বহন করে চলেছে। শুনেছি এমন অসখ্য তেতুলগাছ ছিল শহরে, রাস্তা নির্মান-সহ উন্নয়নের প্রয়োজনে গাছগুলো কেটে ফেলা হলেও এ গাছটিকে যত্ন করেছে রেখেছে স্থানীয় প্রশাসন ও পৌরসভা কর্তৃপক্ষ। পথিমধ্যে শহরের একপ্রান্তে অবস্থিত তেতুলিয়া সার্বজনীন শিব মন্দির দর্শন করি। ১৯১১ সালে নির্মিত শিব মন্দিরটি ১৯৯৭ সালে পুনিনর্মান করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উনিশ শতকের প্রথম দিকে তেতুলিয়া অঞ্চল পর্যায়ক্রমে শাসিত হয়েছে প্রাগ জ্যোতিষ, কামরূপ, কামতা, কুচ বিহার ও গৌর রাজ্যের রাজা, বাদশাহ, সুবাদার এবং বৈকুণ্ঠপুর অঙ্গ রাজ্যের দেশীয় রাজা ও ভূস্বামীদের কাছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকের মধ্যে রাজা শালিবাহন, রাজা পৃথু এবং রাজা জল্লেশ পঞ্চগড়ের তেতুলিয়া উপজেলার শালবাহান ও জেলার ভেতরগড় এলাকায় রাজ্য ও সমৃদ্ধ অঞ্চল গড়ে তুলেছিলেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।
পরবর্তী গন্তব্য দেশের সর্বউত্তরে অবস্থিত বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট। শহর ছেড়ে আমাদের যাত্রা চলে প্রায় ৬০ ডিগ্রি সরল রৈখিক কোনে নির্মিত সুন্দর, মসৃন রাস্তা ধরে। আগেই বলেছি, ভাররতের সীমানা ঘেষে প্রায় সর্বত্রই  রাস্তা থাকলেও বাংলাদেশের অন্য কোন সীমান্তে সীমানা ঘেঁষে এমন কোন রাস্তা আমার নজরে আসেনি এটি ছাড়া। ডাক বাংলো থেকে ১৬ কিলোমিটার রাস্তার পুরো সময়টা জুড়ে হাতের বামে ভারতীয় সীমান্ত। সীমান্তের ওপারে পুরো এলাকাটাই ভারতের পশ্চিম বঙ্গের দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহাকুমার অন্তর্ভুক্ত। সাবলিল গতিতে পথ চলার সময় প্রায় সব জায়গা থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘার চূঁড়া দেখতে পাচ্ছিলাম। এমন কি বাংলা বান্ধা পৌঁছেও আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘার চূঁড়া দেখতে পেয়েছি। আকাশে মেঘ বা কুয়াশা থাকলে এমন দৃশ্য চোখে পড়বে না। প্রায় আধা ঘন্টার মতো পথ চলে আমরা পৌঁছে গেলাম বাংলা বান্ধা গিরো পয়েন্টে। এখানেই বাংলাদেশের সীমানা শেষ এবং ভারতের সীমানা শুরু। আমরা বিজিবি চেকপোস্টের সামনে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে জিরো পয়েন্ট গেলাম, নো-ম্যানস ল্যান্ডে অবাধ বিচরণ করে ছবি তোলার কাজ সারলো সকলেই। আমরা ছাড়াও আরে বেশ কয়েকজন পর্যটক সেখানে উপস্থিত ছিলেন, ছিলো কয়েকজন তরুন, যারা কাছা-কাছি কোথাও থেকে এসেছে ইজিবাইকে করে। জিরো পয়েন্ট থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘার চূঁড়ার দেখা মেলে, তবে পরিরসরটা এখানে কম- বেশ কিছু বড় বড় গাছ-গাছালি থাকার কারণে। সীমান্তের ভারতীয় অংশে বিশাল গেইট রয়েছ, যা আমাদের সীমানায় নেই। আমরা প্রায় স্বাধীন ভাবে নো-ম্যানস ল্যান্ডে বিচরণ করলাম প্রায় ঘন্টাখানেক সময়।
১৯৯৭ সালে বাংলা বান্ধা স্থল বন্দর চালু হয় এবং ২০১০ সালে এখানে ইংরেজি জিরো আকৃতির একটি স্থাপনা  নির্মান করা হয় কঙ্ক্রিট দিয়ে, যা টাইলস দিয়ে মোড়ানো। এই স্থল বন্দর থেকে ভারতের শিলিগুড়ি শহরের দূরত্ব মাত্র ৭ কিলোমিটার। এই বন্দর দিয়ে নেপাল ও ভুটানেও যাওয়া যায়। জিরো পয়েন্টের চারিধারের মনোমুগ্ধকর সবুজ পরবেশ যে কারো মন কাড়বে নিঃসন্দেহে।
আরেকটা কথা জানাতেই হয়। জিরো পয়েন্টে প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার বিজিবি ও বিএসএফ-এর সম্মিলিত রিট্রিট প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। ১৯১৮ সালের এপ্রিল মাসে এই প্যারেডর শুরু। রিট্রিট প্যারেড হচ্ছে দিন শেষে যুদ্ধ বিরতির একটি আনুষ্ঠানিকতা, যা ১৭ শতকের ইংল্যান্ডে রাজা দ্বিতীয় জেমসের আমলে এটি প্রথম চালু হয় বলে ধরণা করা হয়। এই প্যারেডের মধ্য দিয়ে দিনশেষে তাদের দুর্গে কাছাকাছি টহল ইউনিটগুলিকে প্রত্যাহার করা হতো। এটি একটি শতাব্দীর পুরানো সামরিক ঐতিহ্য। যখন সৈন্যরা যুদ্ধ বন্ধ করে, তাদের অস্ত্র খাপবদ্ধ করে এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাদের প্রত্যাহার করা হয়। রিট্রিটের শব্দে সূর্যাস্তের সময় সৈনিকরা ক্যাম্পে ফিরে আসে। এ সময় নিজ নিজ দেশের পতাকা নামানো হয়। তখনকার দিনে এই অনুষ্ঠান শেষে সন্ধ্যায় বন্দুক থেকে এক রাউন্ড গুলিও চালানো হতো বলে জানা যায়। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তে এখন আর গুলি চালনা হয় কি না, তা জানা যায় নি; আমরা এমন অুষ্ঠানের স্বাক্ষীও হতে পারি নি।
জিরোপয়েন্ট ভ্রশণ শেষে আমাদের যাত্রা শুরু হলো সমতলের চা বাগান দেখার উদ্দেশ্য। যে পথে গিয়েছিলাম সে পথেই ফিরে এলাম প্রায় অর্ধকটা পথ, তারপর তীরনই হাট বাজারে এসে বামের পথ ধরে চলা শুরু হয়। প্রায় চল্লিশ মিনিট পথ চলার পরে আমরা পৌঁছলাম কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেটের প্রবেশ তোরণে। আসার পথেই গাড়িতে বসেই দেখা মিললো সমতলের চা বাগান। কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেটের প্রবেশ তোড়ন আহামরি কিছু নয়, তবো সেখানে পরচয় দিয়ে ভেতরে এগুতে হলো। এখানে সুপার স্টোর মিনা বাজারের একটি আউটলেট রয়েছ। আরো  সামনেই আনন্দ ধারা নামে এস্টেটের অনিন্দ্য সুন্দর রিসোর্ট। এখানেই রয়েছ ডাহুক নামের একটা নদী, প্রশস্থে বেশী চওড়া নয়, তবু বহতা নদী সেটি। 
চলবে

শুক্রবার, ৫ জানুয়ারী, ২০২৪

বরেন্দ্র ও প্রাগজ্যোতিষপুরের তেতুলিয়া - ষষ্ঠ পর্ব

 নুরুল্লাহ মাসুম

ষষ্ঠ পর্ব

সকাল ৬টা ১০ মিনিটে সূর্যোদয় হওয়া কথা। তার আগেই দিগন্তে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া। এর আগে আমি দার্জিলিং-এর টাইগার হিল থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ রূপ দর্শণ করেছি। এবারে বাংলাদেশ থেকেই দেখছি সেটিকে। চারিদিকে গুঞ্চন, তারপরই নিরবতা পুরো এলাকা জুড়ে। সকলের দৃষ্টি উত্তর দিগন্তে- কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ার দিকে। সময় ক্রমে এগুতে থাকে, চূড়ার রঙও বদলাতে থাকে। হালকা লাল থেকে কমলা, তারও পরে আরো উজ্জল কমলা রঙ। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায় পাহাড়ের চূড়া। এটাই মূলত এর সৌন্দর্য। ছবি তোলার ধুম পড়ে যায়। আমি নিজে ভিডিও করা ছাড়াও প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কিছু সময়ের জন্য লাইভ ব্রডকাস্ট করি। এর আগে যতবারই দেখেছি, তখনতো আর মোবাইল আবিস্কার হয়নি, ফেসবুক তো কল্পনার বাইরের বিষয় ছিলো। এমন একটা সুযোগ নেবো না কেন! এ সুযোগ সকলেই নিতে থাকেন। আমরা সেখানে প্রায় দেড় ঘন্টা অবস্থান করি। যেখানে দাড়িয়ে দিগন্তে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা হয়, সেই ভিউ পয়েন্ট থেকে নিচে নামলেই মহানন্দা নদী, নদীর ওপারটাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি বিভাগের দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহাকুমার ফাঁসিদেওয়া ব্লকের অবস্থান। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি, এই ফাঁসিদেওয়া বলকের ঠিক উত্তরেই রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক পরিচিত নকশালবাড়ি এলাকা। এখান থেকেই শুরু হয়েছিলো ইতিহাসখ্যাত নকশালবাড়ি আন্দোলন, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরী, কানু সান্যাল ও জঙ্গল সাঁওতাল।


তেতুলিয়া ডাক বাঙলোর একটা ইতিহাস রয়েছ। জানা যায়, এই বাংলোটি নির্মান করেছিলেন কুচবিহার রাজ্যের মহারাজা, তার বাগান বাড়ি হিসেবে। প্রসঙ্গত তেতুলিয়া সম্পর্কে কিছু অজানা কথা জেনে নেয়া দরকার।

তেতুলিয়া’’ আমাদের দেশের সকলের নিকট এক নামে পরিচিত। জনশ্রুতি, প্রাচীন কালে এ এলাকায় প্রচুর তেতুল গাছ ছিল। তেতুল গাছের ছায়ায় বসে পথিকেরা বিশ্রাম নিত। এক সময়ে এখানে একজন বিশিষ্ট ইংরেজ বণিক বাস করত। তার বাবার নাম ছিল টিটু এবং তার বাসগৃহ ছিল একটি উঁচু টিলার উপর। সেখানে একটি তেতুল গাছ ছিল। কালক্রমে সেই ইংরেজ বণিকের বাবার নাম টিটু থেকে টেটু এবং তেঁতুলতলা হতে ‘‘লিয়া; অপভ্রংশ হতে হতে জনপদের নামকরণ হয় তেতুলিয়া। এখন আর তেতুল গাছের সমাহার নেই সেখানে, তবে তেতুলিয়া বাজারে এখনো প্রতীক হিসেবে একটি বড় তেতুল গাছের দেখা মেলে। স্থানীয় এক ভ্যান চালকের ভাষ্য অনুসারে এমন শত শত তেতুল গাছ ছিল শহরজুরে, সব গাছ কাটা হলেও এই একটি গাছ যত্ন করে রেখে দেয়া হয়েছে। তার কথায়, তেতুল গাছ থেকেই তেতুলিয়ার নামকরণ হয়েছে। আমরা সকাল সাড়ে ৭টার দিকে সেই তেতুল গাছের কাছেই একটি রেস্টুরেন্টে সকালের নাশতা সেড়ে নিলাম।



তেতুলিয়া ১৮৬০ সাল থেক ১৮৬৯ সাল পর্যন্ত রংপুর জেলার একটি মহাকুমা ছিল। শিল্প, বাণিজ্য ও নদী বন্দর হিসেবে তেতুলিয়া ছিল সুবিখ্যাত। এটি ছিল মারোয়ারিদের একটি প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র। মহানন্দা নদী দিয়ে আসা যাওয়া করত মহাজনী নৌকা। এখানে বাণিজ্য মেলা বসত।  তখন তেতুলিয়া শহরের গুরুত্ব ছিল অনেক। ফলে তেতুলিয়ায় গড়ে উঠে বেশ কিছু চমৎকার পাকা বাড়ী, মন্দির ও একটি ঘোড় দৌড়ের মাঠ। একই সময়ে ম্যালেরিয়া এবং কালা জ্বরে এখানে ব্যাপক প্রাণহাণী ঘটলে শহর হিসেবে গড়ে ওঠা তেতুলিয়া বন্দর নগরটি হয়ে পরে অস্বাস্থ্যকর এবং জনশূন্য। ১৮৭০ সালের ১ এপ্রিল এক গেজেট নোটিফিকেশন এর মাধ্যমে তেতুলিয়া মহুকুমার সকল ক্ষমতা বিলুপ্ত করে চূড়ান্তভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয় জলপাইগুড়ি জেলার কালেক্টরের হাতে। ফলে বিলুপ্ত হয় তেতুলিয়ার প্রশাসনিক ক্ষমতা। অনেক পরে ১৯১৩ সালে তেতুলিয়ায় আবার স্থাপিত হয় একটি পূর্ণাঙ্গ পুলিশ স্টেশন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের আগ পর্যন্ত  এটি ছিল জলপাইগুড়ি জেলার অবিচ্ছিন্ন গুরত্বপুর্ণ অংশ। ১৯৪৭ সালের ১৮ আগস্ট স্যার রেডক্লিপ ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অন্য ৪টি থানার সংগে তেতুলিয়াকে পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুরের সাথে যুক্ত করে দেন ।


ডাক বাংলো সংলগ্ন জায়গায় উপজেলা প্রশাসন গড়ে তুলেছে একটি দৃষ্টি নন্দন পিকনিক কর্নার। এখানে স্থাপন করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস খচিত ঐতিহাসিক ৭ মার্চ চত্বর, ৭ বীরশ্রেষ্ঠের প্রতিকৃতি, শিশুদের চিত্ত বিনোদনের জন্য বসার বেঞ্চ ও দোলনা। ঝরণা, ফোয়ারা, পিকনিক কর্ণারের গেট, হিমালয়-কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহনীয় রূপ দর্শনে সুদৃশ্য ওয়াচ টাওয়ার, অভ্যন্তরীণ এবং চারপাশে এইচবিবি রাস্তা ও গাইড ওয়াল তৈরি, কমিউনিটি হলরুম এবং কমপ্লেক্স, নতুন ডাইনিং রুম নির্মাণ করা হয়েছে। উপজেলা পরিষদ চত্বরকে আধুনিকায়ন করতে স্থাপন করা হয়েছে স্ট্রিট লাইট, বাউন্ডারি ওয়াল ও সিসি ক্যামেরা। তারও পাশে বনবিভাগে নির্মিত হয়েছে ইকোপার্ক। চিড়িয়াখানার আদলে এই ইকোপার্কে আনা হচ্ছে হাতি, হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণী। এতেও যুক্ত হচ্ছে পর্যটনের নতুনমাত্রা। এর সাথে এখানকার সবুজ চা, পাথর, হস্তশিল্প পর্যটনে আলাদা মাত্রা যুক্ত করেছে। এছাড়াও উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে চৌরাস্তা বাজারটিতে পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন নির্মাণ, পার্কিং এরিয়া নির্মাণ, সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য বৃক্ষরোপন, বসার জন্য বেঞ্চ, ওয়াকওয়ে, উন্মুক্ত মঞ্চ, বঙ্গবন্ধুর তর্জনী, মাল্টিপারপাস হাট শেড ও সিসি রোড নির্মাণ ও জাতীয় মহাসড়কে (এশিয়ান হাইওয়ে) বাইপাস রোডে স্থাপিত হয়েছে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্মরণীসহ বিভিন্ন ভাস্কর্য, ফলক নির্মাণের মাধ্যমে পর্যটন শিল্প আধুনিকায়নে রূপান্তরিত হয়েছে।


পর্যটকরা ডাকবাংলোর পিকনিক কর্ণারে দাঁড়িয়ে হিমালয়-কাঞ্চনজঙ্ঘা, মহানন্দা নদী, শ্রমিকদের পাথর উত্তোলন, ওপারে সীমানা প্রতিবেশী ভারতের কাটাতারের বেড়া, সার্চলাইট, চা বাগানসহ নানান কিছু দেখতে পান।


চলবে