রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৩

নসিমন-করিমন এর সাথে একদিন


নসিমন-করিমনর সাথে একদিন

নুরুল্লাহ মাসুম

ঢাকা থেকে এক কবি বন্ধু ফোন করে জানতে চাইলেন আমার অবস্থান কোথায় এবং খুব ব্যস্ত কি নাআমি তখন দিনাজপুর রেলওয়ে স্টেশনের ছোট্ট এক রেস্টুরেন্টে দুপুরের আহারে ব্যস্তবিদ্যুতের বেহাল অবস্থা এবং সকাল থেকে বেশ জক্কি-ঝামেলা নিয়ে ঠাকুরগাঁ থেকে দিনাজপুরে পৌঁছেছিকবি বন্ধুকে এটুকুই বললাম, দিনভর নসিমন-করিমনের সাথে ব্যস্ত ও বেহাল সময় কেটেছে- তবু ভাল আছি, দুপুরের কাবার খাচ্ছিবন্ধুটি জানতে চাইলেন- এরা আবার কারা?” আমি হাসব না কাদব- বুঝতে পারছিনা, রেস্টুরেন্টের খাবারের ঝাল আমার অস্থিরতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল- ঘামছি দরদর করেখাবারের সাথে কতটা ঘাম গলধকরণ হয়েছে- তা বলতে পারছিনবন্ধুকে জানালাম- বিষয়টি নিয়ে ঢাকা ফিরে কথা বলবো
খেতে বসার আগেই জেনে গিয়েছি, দিনাজপুরে দ্রুতযান এক্সপ্রেস ৬ ঘন্টার মত বিলম্ব- তাছাড়া টিকেটও পাওয়া যাবে নাঅথচ আমাকে ঢাকা ফিরতেই হবে
এইতো সেদিন ৩ জুন ঠাকুরগাঁ গেলাম- দাপ্তারিক কাজেইখোলাসা করে বলাই ভাল, ঠাকুরগাঁয়ে শারদীয়া সুহৃদ ফোরাম গঠিত হয়েছিল সর্বপ্রথম- ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরেসেই সুহৃদ ফোরামের সদস্যদের সাথে মতবিনিময়ের কথা চলছিল বহুদিন ধরেসময় ও সুযোগের অভাবে যাওয়া হয়ে ওঠেনিশেষ পর্যন্ত নির্ধারিত দিনের একদিন পরে যাত্রা করলামবৃহত্তর দিনাজপুরে শারদীয়ার বিশেষ প্রতিনিধি রয়েছেন একজন- তিনি আমার থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন আগে থেকেই৪ জুন নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টা বিলম্বে ঠাকুরগাঁ পৌঁছতেই তাকে পেলাম, তিনি আমায় অভ্যর্থনা জানালেন এবং সার্কিট হাউসে নিয়ে গেলেনসেখানেই আমার থাকার ব্যবস্থাটা হয়েছিল
তৈরী হয়ে বেরুতে সাকুল্যে ঘন্টাখানেক সময় লেগেছিল বটে, শারদীয়ার বিশেষ প্রতিনিধি বসেই ছিলেনসকালের নাস্তাটা তার বাসায় করতে হবেনাস্তাও হলো- পরিচয় ঘটলো তার পরিবারের সদস্যেদের সাথেগৃহকর্ত্রী একজন ব্যাংকার; আরো জানলাম তিনি নানান সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্তভাল লাগলো তিনি উদীচীর জেলা পর্যায়ের অধিকর্তা জেনেতিন মেয়ে সকলেই বড়, পড়াশোনায় ব্যস্ত
এরপর গেলাম জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তার দপ্তরে- সৌজন্য সাক্ষাৎসেখানেই প্রথম শারদীয়া সুহৃদ ফোরামর ফোরাম প্রধান কবি দিল আরা রুমী এলেনক্রীড়া কর্মকর্তার দাপ্তরিক কাজের জন্য কবিকে সার্কিট হাউসে যেতে বলে ছুটলাম সেখানেক্রীড়া কর্মকতা সেখানে পৌঁছে দিলেন
সার্কিট হাউসে পৌঁছে ফোরাম প্রধান বকুল ফুল দিয়ে আমায় বরণ করে নিলেননিজেকে নিজের কাছে বেশ গুরুত্বপূষর্ণ মানুষ মনে হচ্ছিলবেশ কিছু সময় কথা হলোফোরামের অবস্থা, সদস্যদের বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়া- এমনি পর্যায়ে একটু চায়ের ব্যবস্থা হলোএর পরে চললাম কবি দিল আরা রুমির নিজস্ব দপ্তরে
অয়ন- একটি বেসরকারী সংস্থামূলত নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করে সংস্থাটিফোরাম প্রধান দিল আরা রুমি সেটির সম্পাদক ও সমš^য়কারীছোট্ট অফিস, ঠাকুরগাঁ পৌরসভা কমপ্লে·ের ভেতরেতাদের কাজকর্মের কিছু বর্ণনা পেলাম
কথা ছিল শারদীয়ার বিশেষ প্রতিনিধির বাসায় দুপুরের খাবার খেতে হবেসে মতে তিনি এসে আমাকে নিয়ে যাবেন- তবে তিনি এলেন না, ফোন করে জানালেন বিশেষ কাজে তিনি ব্যস্ত, রুমি যেন আমাকে বাসায় পৌঁছে দেনবাসা খুজতে গিয়ে একটু কষ্ট হয়েছে বটে- শেষ পর্যন্ত খুজে পেয়েছিলামবাসায় যাবার আগে ঠাকুরগাঁ সুহৃদ ফোরামের সচিব মমিনুল ইসরামের সাথে দেখা হল তার সরকারী দপ্তরেতিনি ঠাকুরগাঁর জেলা সঞ্চয় কর্মকর্তাসেখানে কিছুটা সময় কাটলো একসাথেকথা হলো সন্ধ্যায় রুমির বাসায় ফোরমের সদস্যরা একসাথে বসবেন
দুপুরের খাওয়ার আয়োজন করেছে বিশেষ প্রতিনিধির মেঝ মেয়েমা ব্যাংকে, বাবা ব্যস্ত- কাজেসেখানেই জানলাম তার বড় বোনকে দুপুরের ঠিক আগই সাপে কামড়েছেবাবা তাকে নিয়ে রংপুরে মেডিকেলে হসপিটালে গেছেনঅবাক হলাম বটে- মেয়ের এত বড় দুর্ঘটনার কথা তিনি অতিথির জন্য বেমালুম চেপে গেলেন এবং আমার খাবারের ব্যবস্থা ঠিকই করেছেন দেখেখাবার পরে সার্কিট হাউসে ফিরে এসে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্ট করে ব্যর্থ হলাম
বিকেলটা একরকম অলসতায় কেটে গেলবিশ্রাম নেয়া হয়নি সকালে- এক সময়ে ঘুমিয়ে গেলাম, যেটা কখনোই আমার হয় না
সন্ধ্যা নাগাদ কবি রুমির ফোনে ঘুম ভাঙ্গলোতার দেয়া পথনির্দেশনা ধরে হাজির হলাম ফায়ার সাভিসের সামনে- মমিনুল ইসলাম সেকানে আমায় অভ্যর্থনা জানিয়ে বাসায় নিয়ে গেলেনআগে থেকেই ফোরামের সদস্যরা সেখানে ছিলেনপরিচিত হরাম রুমির স্বামী অধ্যক্ষ আব্দুল আলীর সাথেশারদীয়া সুহৃদ ফোরাম নিয়ে কথা হলোফোরামের সদস্য বাড়ানো বিষয়ে কথা হলফোরাম সদস্যদের লেখালেখিতে আরো বেশী করে সম্পৃক্ত করার বিষয়ে কথা হলোবলতে হয় সেখানে চলছিল জম্পেস এক আড্ডাসদস্যরা আয়নাতপৃষ্ঠাটি বন্ধ রাখায় দুঃখ প্রকাশ করে আবারো চালুর দাবীও জানালেনআমাদের সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে বললাম- আয়নাত বন্ধ হলেও নারীদের নিয়ে লেখা লেখি বন্ধ হয়নি এবং নিয়মিত সাহিত্য পাতা প্রকাশ শুরু করে নতুনদের লেখার সুযোগ করে দেয়াটা বোধ করি সকলেরই পছন্দ হয়েছে- সম্মতি দেন সকলেইআলোচনার মধ্যেই হাজির হলো অবিনাশ’- সংবাদপত্র কর্মীযার হাত ধরে শারদীয়াসহ সকল দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা পৌঁছে যায় পাঠকের হাতে নিয়মিতএইতো কিছুদিন আগে তাকে নিয়ে শারদীয়া একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়অবিনাশের আসল নাম সঞ্জয়প্রকাশিত সেই নিবন্ধের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছিল সে
আলোচনার মাঝেই জানা গেল পরদিন সকাল থেকে রংপুর বিভাগে পরিবহন ধর্মঘট শুরু হচ্ছে ৭২ ঘন্টার জন্যসর্বনাশ, আমাকে ফিরতে হবে তাহলে আজ রাতেইসে মতে অধ্যক্ষ সাহেব বাসের টিকেট বুকিং দিলেনমনে মনে প্রস্তুতি নিলাম আর ঘন্টাখানেকের মধ্যে ফিরতি যাত্রা শুরু করতে হবেসদস্যরা বললেন থেকে যেতে- এতটা জার্নি ঠিক হবে বলেতাছাড়া দিনে তেমন একটা বিশ্রামও নেয়া হয়নি
আমি প্রস্তুত- যেতেই হবেঠিক তখনই শারদীয়ার বিশেষ প্রতিনিধিন ফোন, তার মেয়ে কিছুটা সুস্থ্য, কাল সকালেই তিনি ফিরছেন এবং তিনি দিনাজপুর থেকে ট্রেনে টিকেট করে কালই আমাকে দিনাজপুরে পৌঁছে দেবেন নিজস্ব মোটর সাইকেলেফলে কিছুটা দোটানায়- যাব কি যাব না! শরীর বলছে যেও না, মন বলছে যেতে হবেশেষ পর্যন্ত যাওয়া হলো না, রাত্রিটা সার্কিট হাউসেই কাটাতে হলো
সকালে একবার বিশেষ প্রতিনিধির ফোন পেলাম, দুপুর নাগাদ তিনি চলে আসবেন; মেয়ের অবস্থা ভাল- কেবল অপেক্ষা ছাড়পত্রেরআশ্বস্ত হলাম; দেরি করেই বিছানা ছাড়লাম- স্বউদ্যোগে খুঁজে নিলাম নাস্তার জায়গা
দেশে ডিজিটালাইজেশনের ব্যাপকতার কারণে; আরো খোলাশা করে বললে বলতে হয়, আকাশ সংস্কৃতির ব্যাপক বিস্তারের কারণে সিনেমা হলের সংখ্যা খুব দ্রুতার সাথে কমে গেছেবড় বড় সিনেমা হল মালিকরা পর্যন্ত নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেনপাশাপাশি আন্তর্জাতিকতার সুযোগে কর্পোরেট ব্যবসা সংস্কৃতিরও ব্যাপকতা লাভ করায়, সিনে কমপ্লে·ের সংখ্যাও বাড়ছেবিশ্বায়নের এমন ডামাডোলের মধ্যে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট সিনেমা হলগুলো একেবারেই বিলুপ্ত প্রজাতির অন্তর্ভূক্ত হতে চলেছেএমই এক প্রেক্ষাপটে ঠাকুরগাঁয়ে দেখলাম মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে বলাকা টকিজভাল লাগলোবলাকা টকিজের পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে সকালের নাস্তার জন্য বসে গেলামদুএকজনের সাথে আলাপচারিতায় বুঝলাম- একেবারে সরকারী ব্যক্তিবর্গ ছাড়া যারা সার্কিট হাউসে থাকতে আসেন, তাদের জন্য এ রেস্টুরেন্টটি হচ্ছে নিকটতম খাবারের স্থানসিনেমার খবর নিতে গিয়ে জানলাম- একেবারে নিম্নমধ্যবিত্তদের বিনোদনের জন্য এখনো টিকে আছে এটিসমাজের উঁচু দরের লোকেরা এখন আর সিনেমা দেখতে খুব একটা আসেন নাকলেজ বা স্কুণ পালানো ছেলে-মেয়েরাও এখন এর বড় পৃষ্ঠপোশকযে ভাবেই হোক, এটি এখনো টিকে আছে
নাস্তাপর্ব ষে হতেই সুহৃদ ফোরাম প্রধান কবি দিল আরা রুমীর ফোন পেলামতিনি তাঁর এনজিও অফিসে আমন্ত্রন জানালেনকখন দিনাজপুরের উদ্যেশ্যে যাত্রা করতে পারবো, সে বিষয়ে মোটেই নিশ্চিত নই; আমারদের বিশেস প্রতিনিধির ফোন বন্ধ পাচ্ছি বারংবার
কিছুটা শংকা আর দুশ্চিতা মাথায় নিয়ে হাজির হলাম অয়ন এর অফিসে
সেখানেও চা পর্ব শেষ হলোজানলাম অয়নের আরো খবরাদিতারা কি বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেনপ্রশাসন কতটা সহায়ক ভমিকা নিয়েছে বা কতটা বিপরীত চিত্র- সবটাই, হয়ত সবটাই রুমী অকপটে বলে গেলেনসব কথা বলা বা লেখা যাবে নাসমাজের বিরূপ অবস্থার মধ্যেই আমাদের সকলকে হাল ধরতে হয়- পথ চলতে হয়রাজনৈতিক মতাদর্শের বিষয়টি শুধু আমাদের দেশে নয় বিশ্বের সব দেশেই মসৃন চলার পথটিকে সবসময় কণ্টকাকীর্ণ করে থাকেমানুষ জাতি বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ হিসেবে এটি আমাদের মজ্জাগত ও সহনীয় হয়ে গেছে
এক পর্যায়ে রুমী নিজে থেকেই ঠাকুরগাঁ শহরটি ঘুরিয়ে দেখাবার প্রস্তাব দিলেনআমি তো এমনটিই চাইছিলাম- বলতে পারছিলাম নাদেখার মত অবশ্যৗ তেমন কিছু নেই- তবু আমার কাছে অনেক কিছুই নতুন মনে হবে
ঠাকুরগাঁ শহরে ঘুরে বেড়ার জন্য কেবল রিক্সাই আমার কাছে যুতসই মনে হলবিকল্প অবশ্য একটা ছিল- ইজি বাইকআমরা রিক্সাই বেছে নিলামসাবলিল গ্রাম্য পরিবেশে আঁকা-বাঁকা রাস্তা ধরে চলছে আমাদের রিক্সাগ্রাম্য রাস্তার সাথে পার্থক্য একটাই- এটা কোন মেঠো পথ নয়কালো পিচ ঢালা পথমাঝে মধ্যে খানাখন্দ আছে বৈকিতবু চলেছি আমারা- বলা যেতে পারে ছন্দময় তালেরাস্তার দুধারে সবুজের সমারোহ এখনো আছে; নগরায়ণের ধাক্কাটা এখনো তেমন লাগেনি বলে প্রকৃতি নিজ অস্তিত্ব নিয়ে এখনো টিকে আছে
প্রথমেই আমরা গেলাম সেনোয়া সেতুর কাছেসেনোয়া বা সেনুয়া একটি নদী, সমতলে পাহাড়ী নদী- পানি নেই রয়েছে শীর্ণ জলধারাএকটু অবাকই হলামঠাকুরগাঁ প্রকৃতার্থে একটি সমতল এলাকাএমন জায়গায় নদীর চেহারা এমন দেখবো ভাবতে পারিনিপশ্চিম বাংলার দার্জিলিং-এ দেখা তিস্তার রূপের মত মনে হল সেনুয়া দেখেভেবে নিলাম, দার্জিলিং এর তিস্তার দূরত্ব খুব একটা বেশী নয় বলেই হয়তো এদের কোন না কোন ভাবে আত্মীয়তা রয়েছেরুমী জানালেন, আর কদিন বাদের সেনুয়া নিজ রূপের আত্মপ্রকাশ ঘটাবেবর্ষা নেমে এলেই প্রমত্তা হয়ে উঠবে সেনুয়াসেনুয়ার যৌবন আসবে বর্ষায়যে কোন নদীর ক্ষেত্রেই সেটি ঘটে থাকেফিবছর নদীগুলো বর্ষায় যৌবনপ্রাপ্ত হয়আহারে! মানুষের যৌবন যদি এমনি করে ফিরে আসতো, তাহলে কত মজাই না হতো! বিশেষ আমাদের মত দরিদ্র দেশের মানুষের যৌবন আসতে না আসতেই নানান বিপত্তিতে যৌবনের গান গাওয়া হয়ে ওঠে নাযখন সময় আসে, তখন আমরা হই বিগতযৌবনাহায়রে প্রকৃতি- একই পৃথিবীতে দুই নিয়ম! সেরা জীব মানুষ তার যৌবনের পুনরাবৃত্তি দেখতে পায় নানদ-নদীসহ পুরো প্রকৃতি ফিবছর যৌবনের স্বাদ পেয়ে থাকেসেনুয়ার বুকে শষ্যের আবাদ মনে কষ্ট দিয়েছে বটেসেতুর কাছে কিছুক্ষণ থেকে এগিয়ে চললো আমাদের বাহনআরো সামনে যেতে বিশাল খোলা মাঠ, স্কুল এবং কলেজশহরের বাইরে যেতেই বিস্তীর্ণ শষ্য ক্ষেতকোনটায় এখনো ধান রয়েছে- কোনটা খালিবর্ষা এলেই চাষাবাদে ব্যস্ত হয়ে উঠবে কৃষকআগের দিনের মত গরুর কাঁধে জোয়াল চড়িয়ে এখনো কৃষক জমি কর্ষণ করে থাকে- আধুনিকতার ছোঁয়ার কোন কোন জায়গায় কলের লাঙ্গল- ট্রাক্টর ব্যবহৃত হয় বটে
ঐ পথে যাবার সময় দেখলাম প্রায় রাস্তা মাঝখানে একটি সমাধি- খুবই সাদামাটারুমী জানলেন- মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ঠাকুরগাঁয়ের দ্বিতীয় শহীদ ১৩ বছরের বালক নরেশ চৌহান এর সমাধিঅবুঝ মারোয়ারি বালক নরেশ চৌহান কিছু না বুঝেই হয়ত ঘরের ভেতের থেকেই বলে ফেলেছিল জয় বাংলাঅমনি হানাদার বাহিনীর থ্রি-নট-থ্রি থেকে ছুটে আছে গুলি, নিভে যায় তার প্রাণনরেশ ঠাকুরগাঁয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের দ্বিথীয় শহীদতাকে তেমন কিছু জানার সুযোগ হয়নিঅনলাইনে তাকে নিয়ে কিছু একটা জানার আশায় খুঁজেছি অনেক, পাইনিচেষ্টা রয়েছে- যদি কিছু পাই, আরেক দিন লিখবো
আগের রাতে ঠাকুরগাঁয়ে কালবোশেখীর ছোবল হানা দিয়েছিলরাস্তার দুধারে অনেকগুলো ভেঙ্গে গেছেশাখা-প্রশাখাহীন গাছগুলো অসহায়ের মত দাড়িয়ে- নতুন জীবন পাবার আশায়সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো- শহরের বড় কবরস্থানের দেয়াল বেঙ্গে গেছেএটি কোন অবাক করা বিষয় নয়অবাক হরাম এটা দেখে- রাস্তার দুধারের দেয়াল ভেঙ্গে দুদিকে পড়ে আছে, যেটি হবার কথা নয়ঝরের গতির সাথে তাল মিলিয়ে দেয়াল দুটো একই দিকে পড়ার কথারুমী হেসে বললেন- হয়ত কাল বোশেখীর ঝড়টা কৎএকটু মাতলামী বেশী করেছিল বলেই এমন হয়েছেমাথা ঝাকিয়ে সায় দিলামঅবাক হৃদয় অবাক হয়েই থাকলো
ফিরে আসার সময়ও সেনুয়া সেতু অতিক্রম করে এগুতে থাকলামএবার দেখবো টাঙন নদঠাকুরগাঁয়ের প্রধান নদী এটিনদের ওপর পুরাতন সেতুটি জীর্ণহয়েছে নতুন একটি সেতুআমরা পুরাতন সেতুর ওপর দিয়ে পথ চলেছিঠাকুর গাঁ সরকারী করেজের সামনে দিয়ে ডায়াবেটিক হাসপাতাল হয়ে এলাম গোবিন্দ নগরেরুমী রহস্য রেখেই বললেন, এই জায়গাটি একটু ব্যতিক্রমীখুজে বের করুন- কেন? চারিদিকে তাকালাম, তেম কোন বিশেষত্ব খুঁজে পেলাম নামনে মনে ভাবছি- রুমী আমাকে বোকা বানাচ্ছেন কি? আবার এও ভাবছি- তা হবে কেন? পরাজয় মেনে নিয়ে বললাম- বিশেষত্ব আপনাকেই বর্ণনা করতে হবে
গোবিন্দ নগর এমন একটা জায়গা, যেখানে চৌরাস্তার তিনধারে তিনটি উপসনালয়একধারে মসজিদ, অন্যধারে গীর্জা এবং আরেক পাশে মাতৃসাধকদের কালী মন্দিরএকটু ব্যাতিক্রমই বটেতিন ধর্মের তিনটি উপাসনালয় একই স্থানে- কি চমৎকার সহাবস্থান! কারো কোন অসুবিধে নেই স্ব স্ব ধর্মাচারে! নিজেদের- বাঙালীদের সহনশীলতার এক সুন্দর উদাহরণমনে পুলকিত একটা ভাব নিয়ে টাঙন নদের ওপরে নতুন সেতু দিয়ে ফিরে চললাম শহরের দিকেছোট্ শহর ঠাকুরগাঁ, দেখার তেম কিছু নেই বটে; তবে প্রকৃতি ধ্বংসের কাজটি দেশের অন্যান্য এলাকার মত এখানেও কমতি নেইটাঙন নদ থেকে অপরিকল্পিতভাবে মাটি কেটে নেয়া হচ্ছে- রীতিমত ড্রেজার দিয়েনিয়ত আমারা পত্রিকায় যেমন দেখতে পাই- সেতুর একেবারে কাছে থেকে মাটি তুলে নেয়া হচ্ছেএতে করে নবনির্মিত সেতুটি যে কোন সময়ে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারেমিদস্যু বা বালুদস্যুরা সেটা বুঝতে না চাইলেও প্রশাসন সেটি বোঝে না- এমনটিতো বলা বা ভাবা যায় নাতবু চলছে বালুদস্যুতা- একেবারে প্রকাশে, দিবালোকে
ফেরারপথে দেখলাম পাইকারী বাজারলিচুর পাইকারী বাজার৮০ টাকা থেকে ১২০ টাকায়  লিচু বিক্রি হয়ে প্রতি শ’- অথচ এই লিচুই যখন ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে যাবে- সেটির মূল্য গিয়ে দাড়াবে প্রতি শ৩৫০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকায় বা স্থান বিশেষে আরো বেশীএভাবেই মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকের মাথায় কাঁঠাল খেয়ে চলেছে বছরের পর বছরঅভাগা কৃষক তার পণ্যে ন্যায্য মূল্য পায়নি কখনোবলে রাখা ভাল (পরে হয়ত ভুলে যাব) এই লিচুই আমি জয়পুরহাট জেলা শহর থেকে কিনেছি ২৩০ টাকা দরে
সার্কিট হাউসে ফিরে শারদীয়ার বিশেষ প্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হইতার মোবাইল, তার স্ত্রীর মোবাইল- বন্ধ পাওয়া গেলদুপুরে খাওয়া পর্ব সার্কিট হাউসেই শেষ করে অগত্যা বিশ্রাম নিতে হলদুএকটা নোট রেখে দ্বিতীয় দিনের মত দুপুর বেলায় শরীরটা এলিয়ে দিলাম সন্ধ্যার খানিকটা আগে হঠাৎ করে মোবাইল বেজে উঠলে কিছুটা বিরক্তিকর ভঙ্গিতে দেখলাম.... আমার কাংখিত নম্বর থেকে কলর্ধর্ফ করে উঠে বসলামবিশেষ প্রতিনিধি জানতে চাইছেন  আমার অবস্থানআমি জানতে চাইলাম- মেয়ের শরীর কেমনভাল’- সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে বললেন, আমি আসছি; তৈরী হয়ে নিন- বেড়োবোসময় চলে যায়, আমি তার অপেক্ষায়; তিনি আসছেন নাসন্ধ্যা হয়ে এলে আমিই তাকে ফোন দিয়ে বললাম- আমি হেঁটে বড় মাঠের সামনে গিয়ে অপেক্ষা করি, আপনি বরং সেখানে আসুনতিনি রাজী হলেন এবং বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা করতে চাইলে আমি বারণ করে বললাম- আগে আসুন, পরে শোনা যাবে
সেই সন্ধ্যাটা তিনি আমায় সময় দিলেনমোটর সাইকেলে করে শহরের কয়েকটা জায়গায় নিয়ে গেলেনপ্রথমে কালী মন্দিরের কাছে- সেখানে নিয়ে তিনি আমায় যে সংবাদ দিলেন, তাতে আমার বিষ্ময়ে মাত্রা বেড়ে গেল।  জানলাম, ১৯৭২ সালের কথাঠাকুরগাঁ তখন মহাকুমা শহরমহাকুমা প্রশাসক একজন তরুণ সিএসপি অফিসারবঙ্গবন্ধু সরকার তখন প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করছেনশহরের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো নানান জনের নামে বা স্থানের নামে নামকরণ হয়ে আছে আগে থেকেইতরুণ মহাকুমা প্রশাসক স্কুলগুলো জাতীয় করণের সময় সেগুলোর নাম দিলেন বিভিন্ন পাখির নামেবুলবুলি, পাপিয়াইত্যাদিএমনটি আমি দেশের অন্য কোথায়ও দেখিনি এমনকি ঠাকুরগাঁয়ে এমন নাম আছে, তাও কোনদিন জানা হয়নিতার আরো অনেক কর্মের কথা জানা হলোপ্রসঙ্গক্রমে এলে সময়মত তা বলা যাবেহ্যা, সেদিনের সেই তরুণ সিএসপি অফিসার আজকের সাপ্তাহিক শারদীয়ার সম্পাদকমন্ডলির সভাপতি, সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি; স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ এবং পরিকল্পনা সচিব এবং বাংলাদেশ স্কাউটস এর প্রাক্তন প্রধান জাতীয় কমিশনার মুহঃ ফজলুর রহমান
এরপরে গেলাম ডিসি অফিস সংলগ্ন একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, সেখানে সদর উপজেলা স্কাউটস সম্পাদকের সাথে পরিচয় হলো- তিনি আগত নির্বাচন নিয়ে ব্যাস্তনানান বিষয়ে আলাপ হলোআলাপচারিতা স্কাউটিং অঙ্গণ ছেড়ে জাতীয় রাজনীতি পর্যন্ত গড়ালোহঠাৎ ঝড়ো হাওয়া এবং বৃষ্টির দ্রুতলয় দেখে আলোচনায় ভঙ্গ দিতে হলোফিরতি পথে বৃষ্টির হামলার শিকার হয়ে আশ্রয় নিতে হলো এক মার্কেটেকিছুটা বিলম্বে তার বাসায় রাতের খাবারমেয়ের অসুস্থতার কারণে বাবা-মা দুজনেই ক্লান্তখুব বেশী কথাবার্তা হলো নাফিরে গেলাম সার্কিট হাউসে
খাওয়া পর্ব শেষ করে আসায় অলস শরীরটা এলিয়ে দিলাম বিছানায়বাইরে তখনো বৃষ্টির আমেজ রয়েছে- ছিটে ফোটা এখনো ঝরে চলেছেভাবছি কাল ঢাকা যাবার ব্যবস্থা কি করে হবেঅন্তত দিনাজপুর পর্যন্ত যেতে পারলে ট্রেন চেপে ঢাকা যাওয়া যাবেট্রেনের টিকেট পাওয়ার বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কিছু জানতে পারিনিরাতের মধ্যেই একটা খবর পাব- এমনটাই কথা হয়েছেঅস্থিরতা বাড়েবারবার ফোন করে বিরক্ত করতেও মন টানছে না
মনটা আরো একাকী হয়ে যায়আমার এ সফর একার হওয়ার কথা ছিল নাঢাকা থেকে আরেক কবি বন্ধুর আমার সাথী হওয়ার কথা ছিলবিশেষ কারণে তিনি আমার সঙ্গী হতে পারেননিএমন একটা পরিস্থিতিতে দুজন থাকলে সময়টা ভাল কাটতবন্ধুটি অবশ্য ফোনে বলেছিল- একদিন পরে যাত্রা করে চলে আসবেআমি খুশীও হয়েছিলামবন্ধুর গাড়ী টিকেটও কাটা হয়ে গেছে- এমনটা জানার পর রংপুর বিভাগীয় পরিবহন ধর্মঘটের কথা জানিয়ে আসতে বারণ করে দেইমনটা হয়ত তারও খারাপ হয়, আমারতো হয়েছেই- কিছুই করার নেইএমন পরিস্থিতিতে একাকী পথ চলার অভিজ্ঞতা আমার রয়েছেএই উত্তর বঙ্গেই আমি পরিবহন ধর্মঘটের মধ্যে নব্বই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছিলাম সেই ১৯৯৭ সালেলালমনিরহাট সদর থেকে বুড়িমারী সীমান্ত পর্যন্ত; কখনো রিক্সায়, কখনো ভ্যানেসকাল সাতটায় যাত্রা শুরু করে সন্ধ্যা পাঁচটা নাগাদ আমি গন্তব্যে পৌঁছেছিলামসে এক করুন এবং দারুন অভিজ্ঞতা-  আরেকদিন না হয় বলা যাবেএবারেও ভাবছি- শেষ পর্যন্ত যদি ট্রেনের টিকেটও পাওয়া না যায়, তবে আবারো শুরু হবে আমার সেই পুরাতন যাত্রাপদব্রজ থেকে রি·, ভ্যান বা অন্য কিছুকোন এক সময়ে গরুর গাড়ীতেও পথ চলেছিহয়ত নতুন করে আবারো তেমনি কিছু ঘটতে যাচ্ছেমানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম একাকী
ট্রেনের টিকেট নিয়ে ফোনের অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলামঘুম ভাঙ্গলো সকালে- নিয়মের বাইরে একটু বেশী সকালেইতৈরী হতে বেশী সময় নিলাম নাশারদীয়া বিশেষ প্রতিনিধি আগেই বলে রেখেছিলেন- সকালের নাস্তা তার বাসায় খাওয়ার জন্য; কথা রাখতে পারিনিএতটা সকালে জেগে ওঠায় ক্ষুধা একটু বেশী লাগার  কারণে রেস্টুরেন্টে নাস্তা শেষ করে তাকে ফোন দিলামআজ আমায় ঠাকুরগাঁ ছাড়তেই হবে, যে করে হোক কাল সকালের মধ্যে ঢাকা পৌঁছতে হবে
তাকে সাথে নিয়ে প্রথমে রেল স্টেশনে- সেখান থেকে রেল ধরে দিনাজপুর বা পার্বতীপুর যাওয়ার পথ খুঁজতেহিসেব করে দেখা গেল- খুব একটা সুবিধে হবে নাদিনাজপুরে পৌঁছতেই সন্ধ্যা হয়ে যাবেতিনি চাইছিলেন, আমি যেন ট্রেনেই ঠাকুরগাঁ ছাড়িআমি একটু গোঁ ধরলামপনের বছর আগেরকার অ্যাডভেঞ্চার আমায় হাতছানিয়ে দিয়ে ডাকছিল যেন! আমার সেই চঞ্চল মন কি করে ট্রেনের বগীতে চুপ করে বসে থাকতে পারে! ঠাকুরগাঁ ভ্রমণের পুরো সময়টা সাথী কেউ না থাকায় যে মনকষ্ট ছিল তা এক্ষণে দূর হয়ে যায়সাথী কেউ থাকলে অ্যাডভেঞ্চারটা জমতো না ভেবে
ইতোমধ্যে মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি- অ্যাডভেঞ্চারে আমি জয়পুরহাট পর্যন্ত যাব, সেখান থেকে বাসে চেপে ঢাকাজয়পুরহাট রংপুর বিভাগে নয়, সুতরাং সেখানে পরিবহন ধর্মঘট থাকার কথা নয়যেমনি ভাবনা, তেমনি কাজতাকে বললাম- আমাকে শহরের বাইরে কোন স্থানে রেখে আসুন, আমি পথ তৈরী করে নেবঅগত্যা তিনি রাজী হলেনসময়াভাবে এবং অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় আমি শারদীয়া সুহৃদ ফোরামের প্রধান কবি দিল আর রুমী বা সচিব মমিনুল ইসরামের কাছ থেকে ফোনে বিদায় নেয়ার কথাও ভুলে গেলাম
শারদীয়ার বিশেষ প্রতিনিধির কাছ থেকে আমার যাত্রাপথের নির্দেশনা নিয়ে নিলামআমাকে যেতে হবে যে ভাবে; রুটটা হল এমনতরো:
- ঠাকুরগাঁ থেকে খোঁচাবাড়ী
- খোঁচাবাড়ী থেকে কবিরাজ হাট হয়ে বীরগঞ্জ
- বীরগঞ্জ থেকে দশমাইল হয়ে দিনাজপুর
এরপর দিনাজপুর থেকে যদি ট্রেন না পাই তবে আবারো অ্যাডভেঞ্জার-
- দিনাজপুর থেকে ফুলবাড়ীযাত্রাপথের সব চেয়ে বেশী দূরত্বের পথ- কমবেশী চল্লিশ কিলোমিটার
- ফুলবাড়ী থেকে বিরামপুর হয়ে হিলি স্থলবন্দর
- হিলি থেকে পাঁচবিবি হয়ে জয়পুরহাট
সাকুল্যে দূরত্ব ১৩৭ কিলোমিটার
তিনি আমায় শহরের প্রান্তে একটি ইজি-বাইকে তুলে দিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে বিদায় নিলেন
এবার আমার মনে পড়ল কবিগুরুর সেই বিখ্যাত গান:
্আমাদের যাত্রা হল শুরু
এখন ওগো কর্ণধার
তোমারে করি নমঃষ্কার
বাতাস ছুটুক, তুফান উঠুক
ফিরবো নাগো আর
তোমারে করি নমঃষ্কার.......
অ্যাডভেঞ্চারের প্রথম পর্বে ইজি-বাইকে আমার সাথী আরো ছয় জনএর মধ্যে চার জন স্কুল শিক্ষক, শহরের বাইরে তাদের স্কুল ধরতে হবে; চারজনই নারীআমি ছাড়া বাকী দুজন পুরুষ- একজনের গন্তব্য জয়পুরহাট, অন্যজন বিরামপুর
মিনিট পাঁচেক পথ চলেছিহঠাৎ যাত্রা বিরতিবিষয়টা কি? খানিক আগে যে সকল ধর্মঘটি শ্রমিক আমাদের বিদায় দিয়ে অভয় বাণী দিয়েছিল তাদেরই কয়েকজন রাস্তা আটকালোধর্মঘটের কারণে ইজি-বাইকও চলতে পারবে নাচালক বেচারা বিপদে পড়লেনআমরা একা নই, এমন আরো কয়েকটি বাইক আটকা পড়লোঅপেক্ষার পালা শেষ হলো- মধ্যস্থতাকারীদের সহায়তায়; গাড়ী প্রতি ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা জরিমানাশ্রমিক নেতারাই নিলেন- আরেক পরিবহন শ্রমিকের কাছ থেকেআমাদের দেশে ট্রেড ইউনিয়নের নামে নেতারা এমন কাজটিই করছে; সে প্রত্যন্ত অঞ্চলেই হোক আর কেন্দ্রেই হোকট্রেড ইউনিয়ন গুটি কয়েক নেতার ভাগ্য ফেরাবার জন্যবলে রাখা ভাল- যে ২১ দফা দাবী নিয়ে রংপুর বিভাগীয় পরিবহন ধর্ম ঘট আহ্বাান করা হয়েছিল, সেখানে সাধারণ পরিবহন শ্রমিকদের স্বার্থে কোন দাবী ছিল না৯-৪০ মিনিটে আমরা ছাড়া পেলাম, যাত্রা শুরু হল খোঁচাবড়ীর পথেমনটা বিগড়ে গেলএভাবে যদি পুরো পথে ঝামেলা হয়, তবে অ্যাডভেঞ্চার আর অ্যাডভেঞ্চার থাকবে না- হয়ে উঠবে তিক্ত ভ্রমণ অভিজ্ঞতাবাইকের সামনে বসে কিছুটা ঝিমিয়ে নিলাম; অবশ্যই নিজের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখেইবেলা ১০-২০ মিনিটে পৌঁছলাম খোঁচাবাড়ীএসময়টাকে পথের দুধারে বাঢ়ী-ঘর চাড়াও দুএকটা কারখানা চোখে পড়লঝিমানোর কারণে পুরো পথের বিবরণ দেয়া সম্ভব হবে না
খোঁচাবাড়ী   থেকে কবিরাজহাট যাবার কথাভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন হওয়ায় একেবারে বীরগঞ্জ পর্যন্ত বাহন পেয়ে গেলাম- এবারে মিশুকঢাকা শহরে এখনো দুএকটা মিশুক টিকে আছে হারিয়ে যাওয়া বিরল প্রাণীর(!) মতসেই মিশুক আমাদের নিয়ে যাবে বীরগঞ্জেভাড়া একটু বেশীই হাঁকলো চালক মহোদয়তবু ভাল- থেমে থাকতে হচ্ছে নাপাইলটকে বলে একটু চা বিরতী নিলামতিনিও আমাদের সঙ্গী হলেন
শুরু হলো আমার বীরগঞ্জ অভিযানপথে কি ঘটবে, এখনো জানিনাএ যাত্রায় আমার সঙ্গী আরো তিন জনএকজনের সাথে আগেই পরিচয়- খোঁচাবড়ী সেক্টরেতিনি বর্ডার গার্ড হিসেব ঠাকুরগাঁয়ে কাজ করেন- ছুটিতে বাড়ী যাচ্ছেন- ছয় মাস পরে
বীরগঞ্জ যাত্রায় তেমন কোন বাধা পেলাম নাবসার ব্যবস্থা একটু ভাল হওয়ায় রাস্তার দুধারে প্রকৃতি দেখার সুযোগ এলোসাথে গাইড নেই- তাই স্থানের বর্ণনা তেমন দিতে পারছি না
প্রায় এক ঘন্টা লেগে গেল বীরগঞ্জ পোঁছতেআগেই বলেছি এবারের যাত্রা ভেশ আরামদায়ক হয়েছিল, যাত্রী কম থাকায়আমরা তিন জন- আরেকজন আছেন, তিনি চালকের সাথেচলতি পথে আলাপচারিতা হলো বেশবিজিবির তরুণ বন্ধু অনেক কথাই বললেনতার নিরাপত্তার সার্থে নামটি প্রকাশ করা গেল নাতার মুখ থেকেই জানলাম বিজিবির বর্তমান দুর্দশার কথাএকটি সুশৃংকল বাহিনী সম্পর্কে খোলামেরা বিস্তারিত আলোচনা করাটা রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ভঙ্গের পর্যায় ভুক্ত বলে অনেক কথা হজম করতে হলোমোদ্দাকথা হচ্ছে ওদের কমান্ড আরো শৃংখলিত হওয়া দরকার
খোঁচাবড়ি থেকে বীরগঞ্জ পর্যন্ত নয়নভরে বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করালামবীরগঞ্জের কাছাকাছি আসতে বিপত্তি ঘটলোআমাদের পাইলট বিপদ আঁচ করতে পেরে কাহারোল মোড়ে নামিয়ে দিলসামনে ধর্মঘটি শ্রমিকরা গাড়ি ভাংচুর করছে- সংবাদ পেয়েই তার এ সিদ্দান্তঅগত্যা নেমে যেতে হলো মিশুক থেকেসাথী সৈনিক বাইকে বললাম, চলুন কিছু একটা গলধকরণ করা যাকতিনি রাজি হলেন নাতাকে সন্ধ্যার আগেই জয়পুরহাট পৌঁছাতে হবেএমনি চলার পথে একজন নান্দনিক মনের সাথী দরকার- তাই তাকে হাতছাড়া করতে মন চাইলো নাপ্রশ্ন উঠতে টারে একজন সৈনিকের মধ্যে নান্দনিকতার বিষয়টি কি করে খুঁজে পেলাম? সে কথা বলে বোঝানো যাবে না- তবে তিনি অন্য দশজন সৈনিক থেকে আলাদা সেটা বুঝতে সময় লাগেনি বেশী
কাহারোল মোড় থেকে একটা রিক্সার ব্যবস্থা হলোচললাম দুজনে বীরগঞ্জের উদ্দেশ্যেএ পথটুকুর দুধারে দোকানপাট ভর্তি- কিছুটা বাণিজ্যিক এলাকার মতরাস্তায় গাড়ি না থাকায় রিক্সা চলছিল রাজকীয় ভঙ্গিতে- ঠিক মাঝখান দিয়েস্বল্প পথ পারি দিয়ে বীরগঞ্জে পৌঁছতেই রেডিমেড যান পেয়ে গেলামতাই বিলম্ব করে রিক্সা নিতে চাইলাম না
এবারে আমাদের বাহন করিমনএই করিমনকে নিয়েই আমার বিপত্তির কথা শুরু করেছিলামকরিমন হচ্ছে এমনি এক যান, যাতে করে মানুষ থেকে শুরু করে যে কোন মালামাল এমনকি গবাদি পশুও বহন করা যায়স্যালো ডিজেল ইঞ্জিনে চলে এটিআমার কাছে মনে হয়েছে এটি একটি খোলা ট্রাকচারিধারে কোন বেরিয়ার নেই- তাই জুতো খুলে, বেশ আরাম করে (বলতে পারেন যোগ ব্যায়ামের পদ্মাসনের মত করে) নিজের আসন তৈরী করলামঝুঁকি একটা রয়ে গেল, হেলান দেয়ার মত কোন স্থান  না থাকায়আমাদের সাথে এবারে অনেক সাথীপ্রায় সকলেই সমতল প্লাটফর্মে গাড়ীর তিনধারে এবং খানিকটা সামনের দিকেও পা ঝুলিয়ে দিব্যি আমার করে বসেছিলেনশহরের পাঠকদের কাছে বিষয়টি পরিস্কার করার জন্য বলা যেতে পারে এভাবে- হরতালে যখন ভ্যানে করে পথ চলতে হয়, ঠিক সেভাবেহ্যা, এটা আরো পরিস্কার হবে- করিমন হচ্ছে ভ্যানের একটি উন্নত সংস্করণ- আকারে বড়, প্রায় দেড় টনের ট্রাকের মত এবং এটি চলে ডিজেল চালিত স্যালো ইঞ্জিনেএর কোন গিয়ার না থাকায় এটি দূর পাল্লার পথে চলাচলে একটা বিরাট ঝুঁকি থেকে যায়
মাথার ওপর খোলা আকাশ- চারিপাশে সতীর্থ সকলে বসে গাল-গল্প করছেনকিছু কথা কানে আসে; কিছু আসে নাসকলেই মাঠের ফসল নিয়ে কথা বলছেনকেবল আমিই চুপচাপ বসে আছি- ধ্যানস্থ সন্যাসির মতচোখ আমার ফসলের মাঠের দিকেকোথায়ও ফসলশূন্য মাঠ, কোথায়ওবা ফসল কাটার অপেক্ষায়; বেশ বাল লাগলো কোন কোন মাঠে কিষান ফসল কাটছেসব মিলিয়ে প্রকৃতি এক অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে আমার সামনে হাজর
ছেলে বেলার কথা মনে হয়গ্রামে ফুফুর বাড়িতে বেড়াতে গেলে ফসলের মাছে যাওয়ার বেশ কয়েকবার সুযোগ হয়েছেফসল কাটর পর খোল মাঠে (নারার ওপর) খালি পায়ে হাটার কষ্টটা বেশ মনে আছেআমার সামনে তখন যেমন কৃষক কালি পায়ে ফসল তুলতো- আজও তেমনি তাঁরা ফসল কাটছে- মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছেতাঁদের কষ্টটা অনুভব করার ব্যর্থ চেষ্টা করতেই পুরো শরীর শিহরিত হলোআবহমান বাংলার কৃষকরা এভাবেই কষ্ট করে ফসল তুলে দেয় ফরিয়াদের হাতে; তারা ফুলে ফেঁপে মোটা তাজা হয়- আমরা শহরে বসে সুবাসিত চালের রান্না করা ভাত-পোলাও খেয়ে খুশিতে ডগমগ হইমাঠের কৃষক মাঠে থাকেন- তাদের ভাগ্যের উন্নতি হয় নামহাজন আর মধ্যস্বত্বভোগী ফরিয়াদের উপস্থিতি যতদিন থাকবে, ততদিন বাংলার কৃষকের ভাগ্য ফিরে আসবে- এমনটা ভাবা যায় না
আকাশ ভরা রোদ- কাঠফাটা বলা যায় অনায়াসেগ্রীষ্মে কাঠফাটা রোদ থাকবে এটাই স্বাভাবিকতবু খোলা আকাশের নিচে করিমনে করে পথচলা একেবারে মন্দ লাগেনিবাতাসের প্রবাহ বেশ বালই ছিলযারা শরীরের খোলশের রঙ নিয়ে বেশী চিন্তিত, তাদের জন্য অবশ্য এ পথচলা কষ্টদায়ক বটেআমি বেশ উপভোগ করেছি- করিমনকে সাথে পেয়েযখন যেদিকে মন চায়- দেখতে পাইবেশ কয়েকবার নিজের মুখটাকে ঘুরাতে গিয়ে নিজের শরীরটাকেও ঘুরিয়েছি- উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমেবেশ মজাদার- তাই না! বসে আছি গাড়ীতে- তবে নামী দামী গাড়ীর মত করে একমূকী হয়ে নয়- বেশ স্বাধীনতা নিয়েমনের আনন্দে যখন যায় এ মন যা’- এমনি করেদেখেছি উত্তর বাংলার অপরূপ সৌন্দর্যমনে অবশ্য এমটা হচ্ছিল কখনো কখনো- যদি একটু হালকা বৃষ্টি হতো বা আকাশটা মেঘরা তাকতো- আনন্দটা হয়তো আরেকটু বেশী হততবু যা পেয়েছি- তাইবা কম কিসে? বৃষ্টি হলেতো যাত্রাটাই মাটি হয়ে যেত
বেলা ১২টা বাজার দশ মিনিট আগেই পৌঁছে গেলাম দশ মাইলনামক স্থানেনামকরণটা আমায় বেশ আনন্দ দেয়ঢাকার কাছাকাছি সতানেরও নাম রয়েছে বাইমাইলনির্দিষ্ট কোন স্তান থেকে এমন কোন জায়গা, যেখানটার কোন নাম নেই- দূরত্ব দিয়েই হয়ত প্রথমে চিহ্নিত করা হয়- পরে সেটিই স্থায়ী নামকরণ হয়ে যায়।  খোদ ঢাকাতে পাক মটরনামের একটি মটর গ্যারেজ থেকে স্তানটির নামকরণ হয়েছিল পাক মটর- দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে সেপি বাংলা মটরনামে পরিচিতবনানীর কাকলীনামের একটি রেস্টুরেন্ট এর নাম থেকে ঐ এলাকার নাম আজ বনানী-কাকলীঢাকার কাছে নারায়ণগঞ্জে এবং বাগেরহাট ও পিরোজপুর জেলার মধ্যবর্তী স্থানের নাম রয়েছে সাইনবোর্ডবিষয়টা বেশ মজার বটে
দশ মাইল নেমে দম নেবার চেষ্টা করলাম- হলো নাভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হয়এখানেও নেমে সাথে সাথে পেয়ে গেলাম একটি ইজি বাইকএবারে যাত্রী তিন জনগন্তব্য দিনাজপুর।  বাইকের পাইলট জানালের ঘন্টা খানেকের মধ্যে পৌঁছে দেবেন দিনাজপুরেসেকানে গিয়ে প্রথম প্রচেষ্টা হবে রেলগাড়ির টিকেট সংগ্রহযদিও বিষয়টি অন্ধারে কালো বিড়াল খঁজে নেবার মতই হবেতবু চেষ্টা করতে দোষ কি!
এবারের ইজি বাইকটি আকারে একটু বড়- কেন যে মনে হচ্ছিল অস্ট্রেলিয়ান গরুর মতআসন সংখ্যাও বেশীযাত্রা মন্দ হয়নিআগের চেয়ে একটু আরামে বসার সুযোগ হওয়ায় বেচারা চোখ দুটো একটু জিরিয়ে নেয়ার সুযোগটা নিয়ে নিলচোখেরই বা দোষ কি বলুন? যত পরিশ্রম- পুরো শরীরের অঙ্গগুলোর মধ্যে- চোখ দুটোই সবচেয়ে বেশী খাটেমাঝে মধ্যে পদ্মার ঢেউয়ের মত করে ঝাঁকুনিতে দৃষ্টি প্রসারিত হয় দূর নীলিমায়, চারিদিকে সবুজের সমারোহ- আরো দূরে সবুজ কেমন করে যেন নীলের সাথে মিলে এককার হয়ে গেছেদখিণা হাওয়া চোখ দুটোকে আরো দুর্বল করে দেয়- সঠিক ভাবে বললে বলতে হয়, বেশী করে অলস করে দেয়সবুজ নীলের অপূর্ব সঙ্গম দেখা হয় না বেশীক্ষণতবে মুদিত নয়নে বারবার মনে হচ্ছিল চিত্রকর এখানে চিত্রঙ্কনের সময় হলুদ রঙের ব্যবহারটা বেশী করেননি বলে নীলের অংশটাই বেশী রয়ে গেছে, নীল আর হলুদের মিশ্রণে সবুজের আয়তনটা সংগত কারণেই কমে গেছে
নীলের সাথে হলুদের সংমিশ্রণ, সাথে সবুজ কম থাকার বিষয়টি বোধ করি মাথার ভেতরে এতটা বেশী কাজ করেছিল; চিত্রকরের ব্যর্থতা না সীমাবদ্ধতা- জানি না; যে কারণেই হোক না কেন- সবুজের সমারোহকে ছাড়িয়ে নীলের ছড়াছড়ি বা আধিক্য কেবল প্রকৃতির মাঝেই নয়, রয়েছে পুরো সমাজ জুড়েসেখানে অবশ্য কলমের কালি শুকিয়ে যেতে বাধ্য হয়অগত্যা-
ঘড়িতে দেখলাম ষাট মিনিট নয়, পঞ্চাশ মিনিটের ব্যবধানে পাইলট আমাদের দিনাজপুর নামিয়ে দিলেনএই একটা জায়গায় আমরা বাঙালীর চিরায়ত অভ্যাসের ব্যতিক্রম দেখলাম
দুপুরের খানিকটা বাদে দিনাজপুরে পৌঁছে প্রথমেই দৌড়ালাম রেলওয়ে স্টেশনের দিকেবিজিবির সেই সৈনিক আমার সথী হলেনপ্রানান্তÍ প্রচেষ্টা একটা ঢাকাগামী টিকেট জোগার করাহোক না সেটা যে কোন শ্রেণীররিক্সা নিতে হলোঅনুসন্ধানে গিয়ে কাউকে পাওয়া গেল নাখোঁজ নিয়ে জানা গেল- বিষয়টি এখন প্যাকেজে চলে গেছেএর মানে হলো, টিকেট বিক্রি এবং অনুসন্ধান এখন একটি বেসরকারী প্রতিষ্টানের হাতেছুটে গেলাম সেখানেকয়েকজন বসে চুটিয়ে আড্ডা মারছেনকথা বলার সুযোগ পাওয়াই কষ্টকরভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই ষাধারণ মানুষের- মানে যাত্রী সাধারণেরকাউন্টারের ঘুলঘুলি থেকে বেশ কয়েকবার তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের ব্যার্থ চেষ্টা করে পাশের গেটে গিয়ে পরিচয় দিতে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া গেলদায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষটি এবার সোজ হয়ে বসলেন এবং আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেনজানালেন, দ্রুতযান এ·প্রেস- যেটি সরাসরি ঢাকা যাবে, সিটে আজ ছয় ঘন্টা বিলম্বে ঢাকা থেকে দিনাজপুর পৌঁছাবেতাই এখন টিকেট দিতে পারবেন না অন্য কোন উপায় আছে কি না জানতে চাইলে জানা গেল- অন্য যে কোন ট্রেন ধরে ঢাকা গেলে পরদিন সন্ধ্যা নাগাদ ঢাকা পৌঁছানো যেতে পারেকথা বাড়ালাম নাভেবে দেখলাম- এর চেয়ে আমার নসিমন-করিমনই বেশ ভাল; দুঃসময়ের বন্ধু- খুব দেরি হলেও রাত আটটা নাগাদ জয়পুরহাট পৌঁছে দেবে; জানামতে গভীর রাত পর্যন্ত সেখান থেকে বাস ছেড়ে যাবেসুতরাং আরেকটু কষ্ট করলে পরদিন সকালেই ঢাকা পৌঁছতে পারবো
কাউন্টার ছেড়ে বাইরে এসে বিজিবির বন্ধুটিকে বলরাম, অনেকক্ষণ ধরে পেটপুজো হচ্ছে না, চলুন কিছু খাওয়া যাক আগেনসিমন-করিমনই এখন একমাত্র ভরসা
স্টেশনের কাছাকছি একটা হোটেলে খেতে বসে আমার বেহাল অবস্থার কথা এ লেখার শুরুতেই বলেছিহোটেলে ঝাল-মসলা একটু বেশীই ব্যবহৃত হয়ে থাকেতবে এখানে খেতে বসে মনে হল উত্তর বঙ্গে মরিচের উৎপাদন বেশী বলে এরা বোধহয় ঝালটাও বেশী খায়বিদ্যুতের বেহাল অবস্থাও বলেছি আগেএমনি অবস্থার মধ্যে মনে পড়ল দিল আরা রুমির বাসায় রাতের খাবারের কথাবেশ যত্ন করে রেধেছিলেন তিনিঝাল আমরা কম খাই, এটা বোধকরি তিনি জেনেছিলেন আগেইতাই খেতে অসুবিধে হয়নিখাবার সময় ঠাকুরগায়ের একটা খাবার দিয়ে বলেছিলেন, খেতে পারবেন কি না জানি না; তবে স্থানীয় খাদ্য তালিকায় এটা জনপ্রিয় খাবার বলেই করেছিখাবারটি হল, পাট পাতা স্যুপস্থানীয় একটা নাম আছে বটে- মনে করতে পারছি নাতবে রুমী যতটা ঘাব্রে গিয়েছিলেন- খেতে পারব কি না; অবস্থাটা হল উল্টে- আমি বেশ মজা করে খেয়েছিলাম পাট পাতার স্যুপএকটু তেতো ভাব অবশ্য আছে- তবে বেশ মজাদার এবং সুখাদ্য ছিল ওটাবহু আগে- ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকের ঘটনা হবে, লালমনিরহাটের খেদাবাগ গ্রামে আমি এ স্যুপ খেয়েছিলামখাবারের বলতে গেলে শারদীয়ার বিশেষ প্রতিনিধির বাসায় যে খাবার খেয়েছি- সেটির কথাও বলতে হয়; ব্যাংকার গৃহিনী অবশ্য আমার খাদ্যাভ্যাসের কথা হয়তো জেনে নিয়েছিলেন; তাই বলতে পারি ওটা ছিল ইউনিভার্সাল খাবার
খাওয়া শেষ করে বিশ্রাম নেয়ার সময় পেলাম রিক্সায়আবারো শুরু হতে যাচ্ছে ভ্রমণ- অনিশ্চিত হলেও এটুকু নিশ্চিত যে, মধ্য রাতের আগে জয়পুরহাট পৌঁছাতে পারবোএবারে আমাদের বাহন হলো ইজি বাইকখুব বেশী সময় লাগলো না যাত্রী ভরে যেতেদীর্ঘ যাত্রা; দিনাজপুর থেকে ফুলবাড়ী- কমবেশী চল্লিশ কিলোমিটার পথদুঘন্টার মত সময় লাগলো; অবশ্য মধ্যাহ্ন ভোজের পর এ যাত্রায় বসার ব্যবস্থা একটু আরামপ্রদ হয়েছিল বলে ঘোড়ার মত দাড়িয়ে ঘুম না হলেও চোখ দুটোকে বেশীক্ষণ প্রকৃতি দর্শনে ব্যস্ত রাখতে পারিনিবরং বলা যেতে পারে চোখ বন্ধ করে উত্তরাঞ্চলের নির্মল বায়ু সেবনে বেশী ব্যস্ত ছিলামবলে রাখা ভাল, ইজি বাইক থেকে নামার পর চারকের ব্যবহার খুব একটা ইজি ছিল না- মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হলোবিষয়টা বুঝলাম স্থানীয় যাত্রীদের কল্যাণেআমরাতো অকূলে বাসছি- অগত্যা চালকের দাবী মেটাতে হলো দম বন্ধ করে
বেলা গড়িয়ে তিন প্রহর অতিক্রম করলোএবারে নতুন বাহনের খোঁজে- খানিকটা অপেক্ষা করে জুটলো একটা নসিমনএর ধরণটা কিছুটা হলেও টেম্পুর মতনএকটি সিরিয়াল ছেড়ে দিলাম- সামনের আসনে বসার জন্যএতক্ষণে নিশ্চিত হয়ে গেছি- জয়পুরহাট- যেখানে গেলে ঢাকাগামী বাস নিশ্চিত, সেখানে পৌঁছতে খুববেশী হলে রাত আটটা বাজতে পারেতাই ভ্রমণটাকে একটু আরামপ্রদ করতে এবং অপরাহ্ণের প্রকৃতি দেখার মানসে সারির দ্বিতীয় নসিমনে আসন করে নিলামসুতরাং সময় পেলাম কিছুটাচললো চা পর্বতবে এখানেই আমি সঙ্গীহারা হলামআমার এ যাত্রায় প্রায় শুরু থেকে বিজিবির যে সৈনিক ভাইটি আমার সাথে ছিল- তিনি প্রওথম সিরিয়ালের নসিমনে যাত্রা করলেনবিদায় নিলাম, আর কোন দিন তার সাথে দেখা হবে কি না, জানা নেইতার সাথে প্রায় অর্ধবেলারও বেশী সময় ধরে চলে অনেক কথা হয়েছে- তার দৃষ্টিকোন থেকে অনেক কথাই জানা হয়েছেযা হয়তো কখনোই লেখার অক্ষরে প্রকাশ করা যাবে নাভাল থাকবেন’- এটাই ছিল তার সাথে বিদায়ক্ষণের শেষ কথা
ঘন্টাখানেকের ভ্রমণফুলবাড়ী থেকে বিরামপুরভাড়া খুব বেশী গুনতে হয়নি-দূরত্বও বেশী নয়- ১০/১৫ কিলোমিটার হবে হয়তোবাবেলা পñিমে হেলে গেছে, গরমের উৎপাত কমে এসেছেপ্রাণোচ্ছল হাওয়ায় নসিমনের সামনে, চারকের পাশে বসে ভ্রমণটা বেশ উপভোগ্যই হয়েছে- নির্দ্বিধায় বলা যায়একটা বিষয় অবশ্য লক্ষ্য করার মত- যতই উত্তর থেকে দক্ষিণে বা দক্ষিণ-পশ্চিমে যাচ্ছি, ধুলোর অত্যাচার ততটাই বেড়েছেপ্রকৃতিগত কারণেই হয়ত মাটির গঠনটা এমন যে, ধুলোর অত্যাচার সইতে হচ্ছেগাছপালার ঘণত্বের বিষয়ে খুব একটা তারতম্য চোখে পড়ল না
বিরামপুর পৌঁছতে সন্ধ্যা হাতছানি দিতে লাগলোমনে তেমন একটা বিষণ্নতা বা ভয় কাজ করছে নাআর মাত্র ৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেই আপাত কাংখিত জয়পুরহাটে পৌঁছে যেতে পারবোঅন্য কোন বাহন না পেলেও রিক্সাতো আছেইএ সামান্য পথ তাই কোন শংকার কারণ হতে পারে না আমার কাছেবলা যেতে পারে বিরামপুর পৌঁছে মনবল বেড়ে গেলতাইতো মোবাইলে কুদ্দুস সাহেবকে পাওয়ার চেষ্টা করলামকুদ্দুস সাহেব হচ্ছেন নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলাধীন শহীদ আব্দুল জব্বার মঙ্গলবাড়ী  বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক, তিনি বেশ কয়েক বছর বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন- বর্তমানে সরকারের নীতিমালার কারণে সেই দায়িত্বে আর নেই।  তিনি আবার শহীদ বুদ্বিজীবি আব্দুল জব্বার মেমোরিয়াল ফাউণ্ডেশনের সচিবও বটেতিনি জানতেন আমি ঠাকুরগাঁ ভ্রমন করছিসে সময়ে তার জয়পুরহাট ভ্রমণের আমন্ত্রণে জানিয়েছিলাম, সুযোগ পেলে বেড়িয়ে যাবআমার সেই সুযোগটা এলো- তবে এটকু ভিন্নভাবেআমার অবস্থা জানার পরে বললেন- আপনি উত্তরবঙ্গে আসবেন, জয়পুরহাট বেড়াবেন না, তা কি হয়? তিনি এও জানালেন, জয়পুরহাট বাসস্ট্যান্ডে আমাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য কেউ একজন থাকবেনমনে সাহস বাড়ল বৈকি
বিরামপুর থেকেও নসিমন পেয়ে গেলাম পৌনে এক ঘন্টার মধ্যে প্রিয় নসিমন আমাদের পৌঁছে দিল হিলিতেহিলি একটি স্থল বন্দরএর একটি অংশ রয়েছে জয়পুরহাটের ভেতরেকিছুটা পথ হাঁটতে হলকোন বাহন নেই- এমনকি রিক্সাও নয়খানিকটা হেঁটে চলার পর ট্রাফিক পুলিশের দেখা মিলল, তারা খুব আন্তরিকতার সাথে আমায় দেখিয়ে দিল কোন পথে গেলে আমি জয়পুরহাট হিলিতে যেতে পারবোএও জানান দিলেন- সেখান থেকে আমি মিনি বাস ধরে জয়পুরহাট জেলা সদরে যেতে পারবোআরো মজার এবং অবাক করা বিষয় হলো মিনি বাসে ভাড়া কত হবে তাও বলে দিলেনধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে চললাম- ভাবছি, দেশের পুলিশের মধ্যে এখনো এমন হৃদয়বান সদস্য আছে তাহলে! হতে পারে আমি স্থানীয় কেউ নয় ভেবে এমনটি সহযোগিতা করেছে অথবা হতে পারে নীতিগতভাবে ঐ ব্যাক্তিটি প্রকৃতার্থে ভাল মানুষ- অপরের সাহায্য করে থাকে নিরন্তরখানিকটা পথ এগিয়ে রিক্সা পেলাম- ট্রাফিক পুলিশের বর্ণনা মতরিক্সা চালক আমায় একেবারে জয়পুর-হিলির বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে দিয়ে মাত্র কুড়ি টাকা দাবী করলোস্ট্যান্ডে তখনো একাধিক মিনিবাস দাড়িয়েকোনটা যাবে নিশ্চিত হয়ে টিকেট কেটে হাতের ছোট্ট ব্যাগটা আসনের ওপর রেখে দিনান্তে নলকপের ঠান্ডা জলে হাত-মুঞ ধুয়ে নিলামআজলা ভরে পান করলাম মাটির গভীর থেকে তুলে আনা ঠান্ডা জলেসে এক অপার শান্তি- লিখে বুঝানো যাবে না।                  
সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্তে বাসটি যাত্রা শুরু করলো জয়পুরহাটের উদ্দেশ্যেহিলিতে পৌঁছেই মনে অনেকটা শান্তি পেয়েছিলাম এই ভেবে- কাংখিত সময়ের আগেই জয়পুরহাট পৌঁছতে পরবো এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পেরেবাস ছাড়ার পর খোশ মেজাজে ফোন করলাম কুদ্দুস সাহেবকেতিনি অবশ্য জয়পুরহাটে নেই- আগেই জেনেছিলামতিনি এবারে আমায় জানালেন- কেউ একজন আমার জন্য জয়পুরহাটে অপেক্ষা করবেবাস ছাড়ার কথা বলায় তিনি আরো নিশ্চিত করলেন, আমি গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই অপেক্ষার জন্য মানুষটি নওগাঁর মঙ্গলবাড়ি থেকে জয়পুরহাটে পৌঁছে যাবেন।  এবারে মনের সুখে ঘুম দিতে পারতামচোখজোড়াও চাইছিল তেমনটিবাস্তবে ঘুম বা তন্দ্রা- কোনটাই হল না
একসময় ঢাকার সদরঘাট থেকে রামপুরা অব্দি একটি বাস সার্ভিস ছিল- ২ নং বাস; আমরা বলতাম মুড়ির টিনট্রাকের মত নাক সামনে বাড়ানো মুড়ির টিন সদরঘাটের ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে থেকে ছাড়তোএখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গেটের দক্ষিণের খালি জায়গাটায় বাসগুলো এসে বিশ্রাম নিতোসেই মুড়ির টিনের একটা বৈশিষ্ট ছিল- যাত্রী ওঠানোর পর চালক ক্ষণে ক্ষণে খুব স্বল্প দূরত্বে কঠিনভাবে ব্রেক কষতোফলে যাত্রীসকল হুমড়ি খেয়ে সামনের দিকে ঝুকে পড়তে বাধ্য হত- মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধেওসেই সুযোগে হেলপার মুড়ির বস্তার মত করে যাত্রী তুলতো বাসের পেছন দরজা দিয়েযাত্রীরাও উঠতেন- বিকল্প কোন যানবাহন না থাকায়হিলি থেকে বাস ছাড়ার পর আমার মনে হচ্ছিল- এ বাসের চালক বোধ করি সেই মুড়ির টিনের কোন চালকের বংশধর হবে হয়েতোসে সময়ে যে কারণে ২ নং রামপুরা বাসের যাত্রী হতে হত এবং সবকিছু হজম করতে হত, আজও তেমনি করে হজম করে কেবলি শুনে চলেছি যাত্রীদের চিৎকার-চেচামেচিবগুড়ার আঞ্চলিক ভাষায় গালাগাল এবং নানা কিছুপাঠক এ অভিজ্ঞতার জন্য আমার কাছে কিছু জানতে না চেয়ে বরং ভাল হয়, যদি একটিবার ঘুরে আসেন আমার মত করেহয়ত আপনারা আমার থেকেও ভাল অভিজ্ঞতা নিয়ে আসতে পারবেন
বাস যখন পাঁচবিবি পৌঁছলো; একটা ফোন পেলাম আমার অবস্থান কোথায় জানানোর জন্যওপাশ থেকে তেমন কিছু না বলে ফোনটা কেটে দেয়া হল
আমি জানালার ধারের একটা আসনে বসেপ্রকৃতির কিছুটা স্বাদ নেয়ার প্রবল ইচ্ছেসরু রাস্তা, দুধারে অসংখ্য গাছ-গাছালিদূরে তেমন কিছু একটা দেখতে পাওয়ার উপায় নেইতবু মাঝে মাঝে গাছ-গাছালি ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে দিগন্ত দেখার ক্ষুদ্র প্রয়াসসূর্য পাটে বসে গেলেও ধরণী একেবারে আঁধারে ছেয়ে যায়নিশরৎ চন্দ্রের আঁধারেরও রূপ আছেকথাটা মনে করে অনিন্দ্য সুন্দর সেই আধারের রূপ খুঁজতে সচেষ্ট হলামআমার তেমন চোখ কোথায় যে আমি শরৎ বাবুর মত আধারের রূপ খুঁজে পাব! তার ওপর আবার আমার চোখে রয়েছে চশমাবোধকরি শরত বাবু চশমা ব্যবহার করতেন না- তাই তিনি আঁধারের রূপ বেশ ভাল করেই আবিস্কার করতে পেরেছিলেন
সাতটার খানিক বাদে জয়পুরহাটে প্রবেশ করলামঅপেক্ষামান মানুষটি আমায় নির্দেশনা দিলেন কোথায় নামতে হবেসে মতে বাটা মোড়ে নেমেই পেয়ে গেলাম মো. আনিসুর রহমানকেঅবাক হলাম- আমি তাকে চিনি এবং জানি, অথচ তিনি নিজে বা কুদ্দুস সাহেব আমায় বলেননি যে আনিস আমায় অভ্যর্থনা জানাবে
মো. আনিসুর রহমানশহীদ আব্দুল জব্বার মঙ্গলবাড়ী বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক আনিসুর রহমানের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল বগুড়া শেরপুরে বছর দেড়েক আগেচেহারাটাও বেশ ভাল মনে আছে আমারভ্রমনকারী হিসেবে আমায় একটু চমক দিতেই কুদ্দুস-আনিসের এটা পরিকল্পনা- মন্দ লাগেনি
সারাদিনের ধকল, আনিস বললেন- আমি চাইলে পুরো বিশ্রাম নিতে পারিআমায় নিয়ে যাওয়া হল কাছাকাছি একটা হোটেলেহাত-মুখটা ধুয়ে নিয়ে খানিকটা বিশ্রাম নেয় হলও বটেতবে বিশ্রাম কি আর ভাল লাগে- নতুন জায়গায় এলাম একটু ঘুরে দেখবো না! এরি মধ্যে ঠাকুরগাঁ থেকে আবু মমহী উদ্দিনের ফোন- আমার এলাকায় গেছেন, কোথায় আছেন, ঢাকার টিকেট পেলেন কিনা- আরো কত প্রশ্নআনিস তাকে বোঝাতে সক্ষম হলেন- আমার খাতির যতেœ কোন কমতি হবে নাআনিস তার পূর্ব পরিচিত বলে জানলাম
চা পর্ব সেরে একটা রিক্সা নিয়ে প্রথমেই বাস কাউন্টারে গিয়ে ঢাকা ফেরার বিষয়টি নিশ্চিত করলাম- হানিফ পরিবহনের রাত পৌনে একটার গাড়িতে আসন পাওয়া গেলএরপর আরেকটি রিক্সায় জয়পুরহাট শহর ঘুরে দেখাগাইড আনিসুর রহমানসমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক- সজ্জন মানুষধারাভাষ্য দেয়ার মত করে আমায় সবকিছু চিনিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেনছোট শহর, আলো-আধারীর মধ্যে দেখার মত চোখের সে ক্ষমতাও তেমন একটা নেইকোথায়ও বসে গল্প হবে- এমনটাও যুৎসই মনে হয়নিএক সময়ে আনিস আক্ষেপ করে বললেন- এতটা কাছে এসে আমি স্কুলটা দেখে যেতে পারবো না; বিষয়টা সে মেনে নিতে পারছে নাবুঝলাম- আমায় এমন সময়ে স্কুলে যেতে বলার মত সাহস দেখাতে পারছেন না আনিসআমি আগ্রহ নিয়ে স্কুলে যেতে কতটা সময় লাগবে জানতে চাইলে আনিস জানালেন ১৫-২০ মিনিটআমি রাজী হয়ে গেলামরিক্সা ভ্রমণ সমাপ্তি টেনে ফিরে চলরাম হোটেলে- যেখানে রয়েছে তার মোটর সাইকেল
দ্রুত আমরা যাত্রা শুরু করলাম স্কুলের উদ্দেশ্যেস্কুল মানে শহীদ আব্দুল জব্বার মঙ্গলবাড়ী বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়স্কুলটি নওগাঁ জেলার মধ্যে হলেও জয়পুরহাট শহর থেকে একেবারেই কাছেরাতের আঁধার ভেদ করে ছুটে চলেছে আনিস সাহেবের মোটর সাইকেলশহর ছাড়াতেই যাত্রাটা বেশ আনন্দদায়ক হয়ে উঠলো আমার কাছেকষ্ট যা হবার হচ্ছে চালকের- আমি পেছনের আসনে বসে এবারে সত্যিকার অর্থে আঁধারের রূপ উপভোগ করে চলেছিদুধারে ফসলের ক্ষেতনিকষ কালো নয়, বরং কালো আর আকাশের আবছা নীল- দুয়ে মিলে নতুন কোন এক রঙ এর সৃষ্টি করেছে- যার নাম আমি জানি নারঙ এর সকল প্রকার আমার সামনে এনে দিলেও আমি হয়ত ঐ রাতে দেখা রঙের মিশ্রণ তৈরী করতে পারবো নাএখানেও আমার প্রতিবন্ধকতা রয়েছে- রঙের জ্ঞান নিয়েদূরের কালো গ্রাম- ফসলের মাঠে যা রয়েছে তা মনে হচ্ছিল হালকা কালো বা ছাই রঙের কোন ফসল- এমনি সব দেখতে দেখতে এক সময় পৌঁছে গেলাম স্কুলে
স্কুলটি আমারদের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বগুড়া বারের প্রখ্যাত আইনজীবী আব্দুল জব্বার এর স্মরণে প্রতিষ্ঠিত- তাঁর পরিবারের উদ্যোগেবিশেষ করে তাঁর ছোট ভাই সাবেক সচিব এবং বাংলাদেশ স্কাউটস এর প্রাক্তন প্রধান জাতীয় কমিশনার এবং সাপ্তাহিক শারদীয়ার সম্পাদকমন্ডলির সভাপতি মুহঃ ফজলুর রহমান স্কুলটি প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বেশী পরিশ্রম করেছেনস্কুলটিকে নিজের সন্তানের মত লালন করেছেন সেই প্রতিষ্ঠাকাল থেকেমঙ্গলবাড়ি একটি প্রত্যন্ত গ্রামসেখানে একটি বালিকা বিদ্যালয় যে কতটা দরকারী- সমাজ সচেতন প্রতিটি মানুষই তা উপলব্ধি করতে পারবেনপ্রয়োজনীয় অথচ কঠিন একটি কাজ সমাধা করেছেন জনাব ফজলুর রহমানছোট্ট একটা টিনের ঘর দিয়ে ১৯৯৬ সালে যে স্কুলটির যাত্রা শুরু হয়েছিল সেটি আজ বিশাল অট্টালিকাগ্রামের মেয়েদের পদচারণায় মূখর সে ভবনঅথচ ভাবতে অবাক লাগে- নিজের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের উন্নয়ণ কর্মকান্ডে ফজলুর রহমান যাতে থাকতে না পারেন- স্থানীয় কতিপয় মনুষ্যরূপধারী সমাজপতি নিরন্তর অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেনসে অন্য প্রসঙ্গ; সুযোগমত বিস্তারিত বলা যাবেআমার ভাল লাগছিল- ফজলুর রহমান সাহেবের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের সামনে আমি দাড়িয়েস্কুলের পুরাতন ভবনে শহীদ বুদ্ধিজীবী আব্দুল জব্বার মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের অফিসসেখানে বসে পরিচিত হলাম বিদ্যালয়ের আরো কয়েকজন শিক্ষকের সাথেচা আসলো, বেশ গল্পও হলো।  আব্দুল জব্বার মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের সাথে আমার খুব ছোট্ট একটা আত্মার সম্পর্কও রয়েছেআরেকদিন না হয় সে সব কথা বলা যাবেরাত বাড়ছেআনিস রাতের খাবার আয়োজনের কথা বলতেই বিনয়ের সাথে নিষেধ করলামজানালাম- ভ্রমণে আমি ভারি খাবার এড়িয়ে চলিরাতের আঁধার পেছনে ফেলে একচোখা দৈত্যের লাল চোখের আলোয় আঁধার কেটে সামনে এগিয়ে চলেছে আনিসের মোটর সাইকেলজয়পুরহাট পোঁছে দিয়ে আনিস অপেক্ষা করতে চাইলেও তাঁকে বিদায় দিলাম এক রকম জোড় করেতাকে মঙ্গলবাড়ী ফিরতে হবে
রাত তিন প্রহরের শুরুতে হানিফ পরিবহনের বাস যাত্রা শুরু করলো ঢাকার উদ্দেশ্যে- ক্লান্তিতে শরীর এলিয়ে দিলাম বাসের আসনেমুদিত নয়নের কর্ণিয়ারও পেছনে অদৃশ্য সেলুলয়েডে একে একে ভেসে উঠতে থাকলো বিগত কয়েক দিনের স্মৃতিময় ঘটনাপঞ্জি এবং বিশেষ করে খন্ডচিত্রের মত দিনভর নসিমন-করিমনরসাথে আমার ঘটনাবহুল স্মৃতি- ক্রমাগত .. ক্রামগত .. ....