রবিবার, ২ জুন, ২০১৩

অগোছালো বাক্যালাপ



একদিন তুমি হাসতে হাসতে জানতে চেয়েছিলে:
- আমায় একটা প্রেমপত্র লিখবে?
অবাক বিষ্ময়ে ক্ষাণিক সময় বিমূঢ়; ততধিক বিষ্ময় নিয়ে আমি পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম:
- আমি, তোমাকে?
আরও ক্ষাণিকটা সময় কাটলো- হয়তোবা বিষ্ময়ের ঘোর কাটাবার ব্যর্থ চেষ্টার সময় ক্ষেপণ; আবারো প্রশ্ন রেখেছিলাম:
- আমি তোমাকে প্রেমপত্র লিখবো?
শেষ হেমন্তের সোনলী ধানের ক্ষেতে বয়ে যাওয়া মৃদুমন্দ হাওয়ার তালে যেমন করে ধানের শীষ দোলে, ঠিক তেমনি করে দুলে উঠলে তুমি; খিল্খিল করে হাসির নহর বইয়ে দিয়ে মৃদু স্বরে তোমার উত্তর- ছোট্ট, সুন্দর ও মিষ্টি উত্তর:
- হ্যা
বিমোহিত আমি; বিশ্বাস করো নন্দিনী- আমি সত্যিই বিমোহিত, পুলকিত, চমৎকৃত হয়েছিলাম সেদিনআমার মনের প্রতিটি কোনায়; নাহ্, সঠিক শব্দ ব্যবহার করা হলো না, প্রতিটি অনু-পরমানু সেদিন আনন্দে ভেসেছিল কেতম তরো! সেই অনুভূতির ব্যাখা তোমায় আমি দিতে পারবো না
ক্ষাণিকটা সময় সেদিন তুমি আমার পাশে ছিলেঘোর বর্ষাকালগাঁয়ের মেঠোপথ তখন ভিজে একাকার- ক্রমাগত তিন দিনের মুষল ধারায়মাসটা ছিল আষাঢ়- তবু বর্ষাধারা মনে করিয়ে দিচ্ছিল শ্রাবণের আগমণী বার্তাকাঠর বাঁটের সেই-ই পুরানা দিনের মোটা কালো কাপড়ের একটিমাত্র ছাতা; তোমাকে-আমাকে, কাউকেই সেই অঝোর ধারা থেকে রক্ষা করতে পারছিল নাতবু শক্ত হাতে ধরেছিলাম ছাতার বাঁটঝড়ো হাওয়া যদিবা ছিলনা, তবু দুই ফার্লং পথ তোমায় এগিয়ে দিয়েছিলামতোমার ফেরার তাগিদ ছিলআকাশে সূর্য নেই, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার চিহ্ন ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হচ্ছিলভেজা-কর্দমাক্ত মেঠো পথে দ্রুত পা চালাবার মত অবস্থাও ছিল নানন্দিনী, তোমার কি মনে আছে- সেই বৃষ্টি ভেজা বিকেল বা সন্ধ্যায় তোমার পড়নে ছিল গাঢ় সবুজ রঙের সুতি শাড়ি? ব্লাউজটা ছিল গাঢ় হলুদ বা সোনলী।  আমাদের বাড়িতে তোমার আগমনের সাথে সাথেই বলেছিলাম:
-হেমন্ত আসতে এখনও বাকী অনেকটা- প্রকৃতির মাঝেঅথচ তোমায় দেখে মনে হয় হেমন্ত এসে গেছে
-কি করে?
বিষ্ময়ভরা চোখে জানতে চাইলে তুমি
হেসে আমি বলেছিলাম:
- সবুজ জমিনে সোনলী ফসলএতো হেমন্তের আগমনী বার্তাতোমার শরীরে সবুজ জমিন আর.........
তুমি সেই সময়ে কী সাবলিল ভঙ্গিমায় হেসেছিলে; তোমার সেই হাসি আজো আমার চোখে ভাসেনিভৃতে শুনতে পাই তোমার কণ্ঠের কলধ্বণী
আজ আমি বড্ড আনমনাকোন কাজে মন বসছে নাপ্রথাগতভাবে সবচেয়ে কঠিন অথচ বিখ্যাত, অবশ্যই বিশ্ববিখ্যাত নাট্যকার শেক্শপিয়ারের ওথেলো নিয়ে বসলামছেলেবেলা থেকেই জেনে এসেছি, কঠিন ভাষায় লেখা বই নিয়ে বসলে সহসাই ঘুম পায়বিশ্বাস করো, ওথেলো আমায় ঘুমের রাজ্যে নিয়ে যেতে পারেনিবরং কেবলি সেই বৃষ্টিস্নাত বিকেল বা সন্ধ্যার কথা বারবার মনে হতে থাকেঅবশেষে-
কতকাল আগের সেই কথাতোমার সেই-ই ছোট্ট অথচ সুন্দর একটা অনুরোধ রক্ষার কাজে বসে গেলামহাতের কাছে কাগজ কলম ছিল না; একটু সময় করে সংগ্রহ করতে হলোফাঁকে এককাপ চা তৈরী করে নিলামতুমি তো জান, জানি না এখন আর তোমার মনে আছে কি না; আমি নিজের হাতে চা তৈরী করতে পছন্দ করি সে-ই কবে থেকেসে দিন বিকেলেও তোমায় নিজ হাতে চা করে খাইয়েছিলামনা, এখন আর কাঠের জ্বালানি দিয়ে চা করতে হয় না; গ্যাসের চুলা তো আছেইরয়েছে ওভেন- মুহুতেই পানি গরমসহজেই হাতের মুঠোয় তৈরী চা
কি লিখবো তোমায় নন্দিনী? প্রেমপত্র লেখে কি করে? আমরা কি কখনো প্রেম করেছি? সত্যি করে বলো তো, তুমি কি কখনো আমার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছে? অথবা আমি তোমার......?
এক সাথে পথ চলেছি কতদিন? আমরা কি আদৌ কোন কালে খোলা ময়দানে গোল্লাছুট বা বৌ-চি খেলেছি? আমার একটা বিষয় পরিস্কার মনে আছে, আমরা বর্ষা কালে ভরা যৌবনা নদীতে একত্রে অনেকে মিলে সাঁতার কেটেছিমনে আছে তোমার? সাতারে তুমি আমার চেয়ে অনেক ভাল ছিলেএ নিয়ে মাঝে মাঝে হারু আর মম কতই না খেপাতো আমায়বেটা ছেলে হয়েও আমি একটা মেয়ের সাথে সঁতারের পাল্লায় হেরে যেতাম! তবে আমার সুখ ছিল অন্যত্রদীর্ঘক্ষণ পানিতে ডুবে থাকার রেকর্ডটা ছিল আমারই; অন্যদের সেখানে কোন ঠাঁই ছিল না
ছেলেবেলার সেই দুষ্টু রেকর্ডটাই আমার জীবনের সাথী হয়ে রইলতাইতো তোমার সেই ছোট্ট অথচ সুন্দর একটা আব্দার রাখতে আমি ব্যর্থ হয়েছিবলতে পার- আমি পানির নিচেই ডুব দিয়ে লুকিয়ে ছিলাম দীর্ঘ দিনআজ যখন পানির ওপর ভেসে উঠলাম; মনে হলো হেমন্তের সেই সবুজ মাঠে সোনালী ধানের ওপর বয়ে যাওয়া মৃদুমন্দ হাওয়ায় দোল খাওয়া তোমার মুখখানিতাইতো কাগজ-কলম নিয়ে বসলাম
হয়তো তুমি হাসবেএকবিংশ শতকের আধুনিকতায় যখন চার বছরের শিশুর লেখা-পড়ার হাতেখড়ি হয় ল্যাপটপ বা পিসিট্যাব দিয়ে, সে সময়ে আমি প্রাচীনপন্থী কাগজ-কলম নিয়ে তোমায় প্রেমপত্র লিখছিকি করবো বল? আমারতো মনে হয়, কাগজ-কলম না হয়ে এ লেখাটা যদি তালপতায় কয়লার কালি ও বাঁশের কঞ্চির কলম দিয়ে লিখতে পারতাম- আমার আনন্দ হতো আরো মধুর, আরো আবেগঘন
ঝিনুকের খোল পাকা শান-বাঁধানো ঘাটে ঘসে ঘসে কাঁচা আম কেটে আচার খাওয়ার কথা কি তোমার মনে আছে? সে সময়ে গাছের আম চুরি করে, বাগানের কাঁচা লঙ্কা চুরি করে, নদীর ধারে নল-খাগড়ার বনে তুমি, আমি, লুকিয়ে আমের আচার খেতাম; মাধবী, ললিতা, হাসু, কাকন, মতি, রুদ্র- আরো কতজনাই থাকতো সাথেসকলে সব সময় না থাকলেও তুমি আর আমি থাকতাম সব সময়েবলা যায় ওটা ছিল আমাদের দলআজকের দিনে দেখ, প্রাকৃতিক ঝিনুকের সেই জায়গাটা দখল করেছে পিলারনামের ছোট্ট যন্ত্র; যা সব ধরণের সবজি ও ফলের বাঁকল তোলার কাজে ব্যবহৃত হয়; তোমার আমার বাঁকলও তুলতে পারে এই পিলার
প্রেম কি নন্দিনী? তুমি কি আমার কথা ভাব? আমি কি তোমার কথা ভাবি? একে অপরের দুঃখের সাথী কি আমরা হতে পেরেছি? আজ তুমি কোথায়, আর আমি? কতদিন আমাদের দেখা হয় না, মনে পড়ে? তবু তোমায় নিয়ে আজ লিখছি? শরতের মুক্ত আকাশ যেন আমার বাড়ির ছাদে নেমে এসেছেসেখানে ইচ্ছে করলেই হাত বাড়িয়ে পূর্ণিমার চাঁদ ছোঁয়া যায়
তর্জন-গর্জনে ভরা সেই ভয়ঙ্কর নদীর পাড়ের ছোট্ট সুন্দর গাওখানি ছেড়ে একে একে সকলেই শহরে পাড়ি জমালসত্যি কথা বললে বলতে হয়, শহরমূখী হতে বাধ্য করলো প্রকৃতি আমাদেরবাস্তবস্থা আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিল একে অপরকে- সকলকেউত্তর-দক্ষিণে বয়ে যাওয়া সেই নদীর ধারে কত রাত আমরা পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় স্নাত হয়েছি; মনে পড়ে কি? দল বেধে সেই রাতগুলোয় হেড়ে গরায় কত গান আমরা গেয়েছি- তা কি হিসেবের খাতায় লেখা যাবে?
শীতের রাতে খেজুর রস চুরি করে পাতার উনানে পায়েস খাওয়ার কথা, মনে পড়ে তোমার? আজো আমি সেই পায়েসের স্বাদ পাই নির্ভতে- একান্তেতুমি কি পাও?
কতকাল হলো, পূর্ণিমার আলোয় স্নাত হচ্ছি না; বা বলতে পার হওয়ার সুযোগ নেই- যান্ত্রিক এই শহরেতুমি আমি কত কাছাকাছি এই শহরে; অথচ সপ্তাহান্তে আমাদের দেখা হয় না বললেই চলেভাবতো একবার- পল্লীর সেই সব দিনের কথাদুই ফার্লং পথ পাড়ি দিয়ে কতদিন, কত রাত তুমি আমাদের বাড়ি চলে আসতে হেঁটেআমার কথা না হয় বাদই দিলামগাঁয়ের বেশীর ভাগ ছেলে-মেয়ে ভুতের ভয়ে সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বেড় হতো না; ব্যতিক্রম ছিলে তুমিআর আমি, আজও পর্যন্ত কোন ভুত বা পেত্নীর সাক্ষাৎ পেলাম না- দুঃখটা থেকেই যাবে
কি লিখবো নন্দিনী? তোমার ডাগর চোখ দুটির কথা? ঐ মায়াবি চোখ আমায় আজও ভাবায়; আজও আমি ডুবে যেতে পারি ঐ কাজল কালো চোখের গহীনেঅথবা তোমার সেই নেচে যাওয়া শস্য ক্ষেতের মত মিষ্টি হাসি আর মুক্তোর মত দাঁতকোনটা রেখে কোনটা নিয়ে লিখবো? তোমার দেখা মিলতেই আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যেতাম- তোমার একই অঙ্গের কোন্ অনু-পরমানু আগে উপলব্ধি করবো; সত্যি নন্দিনী আমি ভেবে পাই না, চোখ আগে না মুখ আগে; না কি তোমার তীক্ষ্ণ নাসিকা! তোমার চুলের কথা নাইবা বললাম
আমার ভাল লাগে তোমার ছন্দময় হাঁটার গতি- যেন কূকূল ধ্বনীতে বয়ে চলা নদী; ক্রমাগত তাকিয়ে থাকার মত, ক্লান্তিহীন; নেশাগ্রস্তের মতনাহ্, এ কথাগুলো বলা হয়নি তোমায়কখনও কখনও মনে হয়, তুমি এলে- তোমায় কাছে পেলেই তোমার অস্তিত্ব অনুভবে এতটা কাছাকাছি হব; যেখান থেকে তুমি পালাতে পারবে নাবিশ্বাস করো, তুমি কাছে এলে আমার সেই সুপ্ত বাসনা একেবারেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, মনে হয় গাছের গোলাপ ছিড়ে হাতে নিলেই  ওর সৌন্দর্যহানি ঘটবে; শুকিয়ে যাবে, মরে যাবেগাছেই ও চিরযৌবনা- থাক না ওখানেই! বলতে পার, এটা আমার দুর্বলতা বা ভীরুতাগোলাপের সৌন্দর্য প্রকৃতির মাঝেই যথার্থহেমন্তে খাদ্যের প্রয়োজনে ধান কাটা হয়ে গেলে মাঠ হারায় সৌন্দর্য; পেট ভরে গৃহস্থেরআমি অনাহারী থাকতেই বেশী পছন্দ করিবলতে পার- এটাও আমার ভীরুতাঅভুক্ত থেকেও মনের আনন্দ; এটাই বা কম কিসের?
নারে নন্দিনী, প্রেমপত্র লেখা আমার কম্ম নয়প্রেমই করতে পারিনি আজও- কি করে প্রেমপত্র লিখবো বলো?
কবে থেকে তোমায় ভাললাগে, বলতে পারবো নাছোট্ট বেলাটা বেশ অনেকগুলো বছর একসাথে খুব কাছাকাছি ছিলাম; তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেল ভীষণ একাকীত্বে! কখনও-সখনও, একাকীত্বের মাঝে তোমার স্মৃতি নিয়ে সময় কেটেছে আমারতোমারও কি তেমনটি ঘটেছে কখনও? আবার যখন ইট-পাথরের এই প্রাণহীন নগরীতে আমরা মিলিত হলাম- আমরা সমব্যাথী, সহযাত্রীউভয়েই হারানোর বেদনাসিক্ত; তবু জীবন বহমানকেউ কারো সাথে নয় অথচ কত কাছে- ঠিক যেন রেল সড়কের মতসমান্তরালে পথ চলছি নিরন্তর, শুনছি-জানছি একে অপরের সুখ-দুঃখের গল্পকথা, চোখর জল ফেলছি, কখনওবা হেসেই লুটোপুটি খাচ্ছি; আবার শান্তনাও দিচ্ছি, মিলতে পারার ইচ্ছেটা পূরণ হচ্ছে না; পূরণ হবারও নয় কোন দিন

নাহ্, আমার দ্বার প্রেমপত্র লেখা হবে না নন্দিনীক্ষমা করো আমায়তোমার ধ্রুব না হয় আরেক দিন চেষ্টা করবে তোমার উদ্দেশ্যে সুন্দর একটা প্রেমপত্র লিখতেঅপেক্ষায় থাক ততদিন এবং ভাল থেকো নিরন্তর


ধানমন্ডি, ঢাকা

১৯০১৪৩ মে ২০১৩