রবিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২৩

পূর্ণিমা

নুরুল্লাহ মাসুম


পিতৃহারা পূর্ণিমা লালিত-পালিত হচ্ছিল তার একমাত্র ভাইয়ের সংসারে। ভাইটি তার থেকে বছর আটেকের বড়। পেশায় নৌকা-চালক, যাকে আমরা মাঝি বলে জানি। বিশাল দেহের অধিকারী বাহর আলী প্রমত্তা সন্ধ্যা নদীতে খেয়া পাড়াপাড়ের কাজ করে। বাবার আমলের একটা মাঝারি গোছের নৌকা তার একমাত্র সম্বল। খুব সকালে এক-গামলা পান্তা খেয়ে প্রায় মাইল দেড়েক পাঁয়ে হেঁটে নৌকার কাছে যায় এবং কাজে লাগে। বাহর আলীর নৌকা যখন ঘাটে সক্রিয় হয়, তখন বাজারের মসজিদে মুয়াজ্জিন আজান দেয়। দিনভর কাজ শেষে এশার নামাজের অনেক পরে বাহর আলী ঘরে ফেরে।

বাবা মারা যাওয়ার বছর তিনেক আগে দুই বছরের বোন পূর্ণিমাকে রেখে মারা যায় বাহর আলীর মা। ছোট্ট বোনটাকে মানুষ করতে তার বাবাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। প্রথমদিকে বাহর আলীর ফুপু এসে বাড়িতে থাকতেন। এক বছর যেতে না যেতেই বাহর আলীর বাবা এস্কেন্দার আলীও পরপারে চলে গেলেন। ছোট্ট বোন পূর্ণিমাকে নিয়ে তখন বাহর আলীর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। ফুপু আরো বছরখানেক ওদের সাথে ছিলেন, তারপর তিনিও অনন্তলোকে যাত্রা করলেন। ফুপুর কোন ছেলে-মেয়ে না থাকায় শ্বশুর বাড়িতে যতটকু জমি-জমা ও নগদ সম্পত্তি পেয়েছিলেন, তা বাহর আলীর হাতে তুলে দিয়ে যান। তবে ফুপু বাড়ির লোকদের তালবাহানায় জমি-জমার কোন ভাগই বাহর আলী পায়নি।

পূর্ণিমা বাহার আলীর সাথেই ঘুমাতো। দিনের বেলায় প্রতিবেশীরা তাকে দেখে রাখতো। বাহর আলী রাতে যা রান্না করতো, সেটাই ছিলো সকাল ও দুপুরে ওদের দুজনের খাদ্য। রাতে আবার রান্না। মাঝে মধ্যে এ-ঘর ও-ঘর থেকে কিছু খাবার জুটতো পূর্ণিমার ভাগ্যে। পূর্ণিমা খুশী হতো। ফুপু মারা যাওয়ার পর ওদের এক পাড়াতুত চাচি মূলত পূর্ণিমাকে দিনভর দেখে রাখতো।

একাকী বাহর আলী ছোট্ট বোনটাকে লালন-পালন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল। পাড়া-প্রতিবেশীরা তখন মোক্ষম পরামর্শ দেয় ঘরে বউ আনার জন্য। বাস্তবে তাই ঘটে। বছর দুয়েক বাদে এক পৌষের শেষে বাহর আলীর ঘরে আসে নতুন বউ- দুটো গ্রাম বাদ দিয়ে কোন এক দরিদ্র পরিবারের মেয়ে নতুন বউটি। বিয়েতে কোন জাকজমক ছিলো না, থাকার কথাও নয়। তবু বাড়ির অন্যান্য গৃহস্তরা মিলে যা আয়োজন করে, তাতেই নতুন বউ তাহেরা বানু খুশী হয়; খুশী হয় বাহর আলীও। 

৫ বছর বয়স থেকেই পূর্ণিমার একাকী থাকার অভ্যাস হয়ে যায়। আরো বছর দুয়েক বাদে বাহর আলী ও তাহেরার ঘর আলো করে আসে একটি ছেলে- নাম রাখা হয় মজিবর। দেশ তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ণিমা ছোট থাকায় একপ্রকার নিশ্চিন্তে দিন কাটে বাহর আলীর। অন্যান্য ঘরের সোমত্ত মেয়েদর নিয়ে প্রতিটি পরিবার ছিল দুশ্চিন্তগ্রস্ত। কেউবা তাদের পাঠিয়ে দিয়েছিল দূর গাঁয়ের কোন নিকট বা দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে। সে সময়টাতে সকলে নানান ভাবনায় থাকলেও পূর্ণিমা দিন কাটিয়েছে হেসে-খেলে।

মজিবরকে নিয়ে ফুপু পূর্ণমার দিন কাটে বেশ। হেসে-খেলে দিন বয়ে যায়। দিন যত গড়ায় বিপদ তত সামনে এসে দাঁড়ায়। পূর্ণিমা দিনে দিনে গায়ে-গতরে ধাই-ধাই করে বেড়ে চলেছে। গায়ের রঙ ঠিক পূর্ণিমার চাঁদের মতই। ওর বাব-মায়ের দেয়া নামটা সার্থক হতে থাকে দিনে দিনে।

বন্যায় পুরো দেশ ডুবে আছে। সদ্য স্বাদীন দেশে তখন দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে। গ্রাম ছেড়ে সকলেই ছুটছে ছোট-বড় শহরের দিকে। কেউবা চালনা বন্দরে কাজের সন্ধানে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম হুহু করে বেড়ে চলেছে। বাড়ে না কেবল বাহর আলীর নৌকা পারাপারের তোলা। যুদ্ধের আগে থেকে চলে আসা দুই পয়সাতেই তাকে যাত্রী পারাপার করতে হয় দেড় মাইল চওড়া সন্ধ্যা নদী। সে যেমন-তেমন কাজ নয়। মাঘের শেষ থেকে শুরু করে শ্রাবণের শেষাবধী সন্ধ্যার যে প্রমত্তা রূপ, যে না দেখেছে তাকে বিশ্বাস করানো যাবে না। কঠোর হাতে বৈঠা ধরে অনায়াসে বাহর আলী পাড়ি দেয় সেই নদী। এলাকায় তার একটা নাম-ডাক রয়েছে দক্ষ মাঝি হিসেবে। নাম-ডাক যতই থাকুক, দিন শেষে ইজারাদারের পয়সা দিয়ে বাহর আলী যা হাতে পায়, তাতে সংসার চালানো কষ্ট হয়ে ওঠে।

অনিন্দ্য সুন্দর রূপের কারণে গ্রাম ছাপিয়ে গ্রামান্তরে পৌঁছে যায় পূর্ণিমার নাম। পূর্ণিমা এখন আর কেরানী বাড়ির পুকুরে গোছল করতে যেতে সাহস পায় না, ওর ভাবী ও চাচীরা ওকে একা যেতে দেয় না পুকুর ঘাটে। এলাকার বখাটেদের নজরে পড়ে পূর্ণিমা। অগত্যা সাব্যস্ত হয়, তাহেরা বিবি কেরানী বাড়ির পুকুর থেকে পানি এনে দেবে কলসী ভরে। হয়ও তাই। ঘরের পেছনে কলা-পাতার দেয়া ঘেরাটোপের মাঝে সেই এক কলস পানিতেই চলে পূর্ণিমার গোছল পর্ব। এ নিয়ে তার কষ্টের সীমা নেই। গ্রামের মেয়ে পুকুরে ডুবাবে, সাঁতার কাটবে- সে আর হয়ে ওঠে না। গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা দিয়ে দিনাতিপাত করে সে।

গ্রামের সকলের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। প্রতি রাতেই কোন না কোন বাড়িতে চুরির ঘটনা ঘটছে। দেশান্তরী হওয়ার কারণে প্রতিবেশী অনেক বাড়িতেই এখন মানুষজন কম, কোন কোন বাড়ি তো একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। বাজারে চালের আকাল। এখন বাহর আলীসহ অনেকেই দিনে দুবেলা আটার রুটি খায়। গলা দিয়ে কি নামে সেই রুটি? এরই মধ্যে আটার সাথে ধানের কুড়ো মেশানো পাওয়া গেছে। এ নিয়ে পঞ্চায়েতে নালিশ হলে বিচার-আচারের ঘটনাও ঘটেছে। রক্ষী বাহিনী আর লাল বাহিনীও মাঠে নেমেছ এসব কর্মকান্ড সামাল দিতে।

পূর্ণিমা আর অমাবশ্যার পালাবদলে আমাদের আলোচ্য পূর্ণিমা আরো বড় হতে থাকে। মনের কষ্ট আর খাবারের অনটন তার গতরের শ্রীবৃদ্ধিতে তেমন একটা প্রভাব ফেলে না। পূর্ণিমাকে এখন আর বাড়ির বাইরে ধারে-কাছের কোন খোলা যায়গায় দেখা যায় না। তবে দুষ্টু ছেলেরা ওৎ পেতে থাকে কখন সে কলাপতার ঘেরাটোপে গোছল করে আজানু লম্বা চুল শুকানোর জন্য বাড়ি উঠানের পশ্চিম কোনায় এসে বসবে, একটা জলচৌকি পেতে। বলাই বাহুল্য, বাহর আলীর অভাবের সংসারে পূর্ণিমার ভাগ্যে কোনকালেই চুলে দেবার মতো সুগন্ধি তেল জোটেনি। তবু, সে কি সুন্দর ঘন ও দীর্ঘ-কালোকেশী সেই পূর্ণিমা। এটা শুকানোর জন্য সে প্রতিদিন বাধ্য হয়েই উঠানের পশ্চিম কোনায় জলচৌকিতে বসতে হতো। পূর্ণিমা কেরানী বাড়ির মেয়েদর মুখে শুনেছে- চুল শুকানোর জন্য না কি কি এটা যন্ত্র আছে! ব্যবহার করবে কি, কোন কালে চোখেই দেখেনি সে। শুধু পূর্ণিমা কেন, কেরানী বাড়ির সকলেই কি তা দেখেছে? ওরা যখন বড় বোন হালিমার শ্বশুর বাড়ি চানপুর যায়, সেখানে দেখেছে কয়েকজনে। শহর বলে কথা। পূর্ণিমা শহর তো দূরের কথা, সন্ধ্যা নদীর পার হয়ে ওপাড়ে যায়নি কোনকালে। যাবার মতো ভাগ্য কি তার হবে কখনো? শুনেছে, ওপাড়ে বায়োস্কোপ আছে। বড় একটা লম্বা ঘরের ভেতরে আলো নিভিয়ে দিয়ে বই দেখায়- কি সুন্দর সুন্দর কাহিনী। শুদ্ধ ভাষায় না কি বলে সিনেমা হল, দেখায় সিনেমা।

কচু-ঘেচু গাডি (ওল কচু) আর কচুর বই (লতি) দিয়ে যখন ওদের দিন কোন রকমে কেটে যাচ্ছিল, তখন পূর্ণিমার বিয়ের প্রস্তাব আসে পাশের গ্রামের মাঝি-বাড়ির বড় ছেলের জন্য। ছেলেটির নামও মজিবর। মাঝি বাড়ি ছেলে হলেও সদরে একটা কলেজের দপ্তরী সে। মাসে মাসে মায়না পায় পঁচিশ টাকা। বাহর আলী রাজী হয়ে যায়। আদরের বোনটার যেমন একটা গতি হবে, তেমনি তার নিজের দায়িত্বও কমবে। তছাড়া ওদের বাড়িতে চাকরী করা কোন ছেলে নেই, তাই জানে না, চাকরি করা ছেলেরা কেমন হয়। গায়ে-গতরে কতটা শক্তিশালী হয়! তবে এটুকু জেনেছ- ওদের বাড়িতে খাওয়ার কষ্ট নেই।

বাহর আলী চেষ্টা করে বোনটার বিয়েতে সাধ্যমত ধুমধাম করার। জনা বিশেক লোক দাওয়াত করে খাইয়েছে। জামাইকে একটা কেমি ঘড়ি দিয়েছ। কথা দিয়েছে একটা সাইকেল দেবে- যাতে তার কলেজে যেতে সুবিধা হয়। এজন্য তার জমানো সবগুলো টাকা খরচ হবে জেনে তার বউ বাধা দিয়েছিলো, বাহার আলী শোনেনি। একটা বোন, কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে; তার জন্য খরচ করবে না তো কার জন্য করবে!

এখন আর গ্রামের ছেলেরা কেরানী বাড়ির পুকুরের আড়ালে থেকে পূর্ণমার অনিন্দ্য সুন্দর কালো-দীর্ঘ কেশ দেখার জন্য আড্ডা জমায় না লুকিয়ে। বহু বছর হয়ে গেছে পূর্ণিমাও ভাইয়ের বাড়িতে আসে না। সকলে ভাবে, পূর্ণিমা তার নিজের সংসারে ভালই আছে।

কুড়ি বছর হয়ে গেল, পূর্ণিমার কোন খবর জানে না গ্রামের লোকজন। কেমন আছে সে? পূর্ণিমার কোলে কি তার থেকে ফুটফুটে সুন্দর সন্তান এসেছে? সে কি নিজের সুখে ভাইয়ে কথা, ভাবীর কথা, প্রতিবেশীদের কথা এমন কি তার ভাইয়ে ছেলে মজিবরের কথা ভুলে সুখের সংসার করছে?

প্রতি বছর চৈত্র-সংক্রান্তির মেলায় গ্রামে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসে ফাতু, সুরিয়া, মম, ফজিলা, নার্গিস, হাসি; সকলেই খেলার সাথী। এ সময়টাতে গ্রামজুড়ে যেন মেয়েদের মেলা বসে। এ বাড়ি ও-বাড়ি পড়ন্ত বিকেলে ওদের আড্ডা হয়, নিজ সংসারের গল্প, ছোটকালের গল্প- যেন স্মৃতি হাতড়ানোর প্রতিযোগিতা! সকলেই স্বামী সন্তানসহ এ সময়টাতে বেড়াতে আসে। কেবল পূর্ণিমার আর দেখা মেলে না চৈত্র-সংক্রান্তির মেলাতেও।


১৫ ২১১৭ আগস্ট ২০২৩

ইস্টার্ন প্লাজা, হাতিরপুল, ঢাকা।