শনিবার, ২৭ জুন, ২০১৫

মিয়ানমারে ভারতের রক্তক্ষয়ী ঝটিকা সামরিক অভিযান!

মিয়ানমারে ভারতের রক্তক্ষয়ী ঝটিকা সামরিক অভিযান!
নুরুল্লাহ মাসুম 
ভারতের সেনাবাহিনী মঙ্গলবার মিয়ানমারের ভেতরে ঢুকে যে বিশেষ অপারেশন চালিয়ে উত্তরপূর্বাঞ্চলের বেশ কিছু জঙ্গিকে মেরে ফেলেছে এবং অন্তত দুটি শিবির ধ্বংস করেছে, তা নিয়ে সেদেশে শুরু হয়েছে বিশ্লেষণক্ষমতাসীন বিজেপি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের একাংশ দাবী করছে এই বিশেষ অপারেশনের মাধ্যমে একটা কড়া বার্তা দেয়া হয়েছে সব দেশকেই যে জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসীদের রুখতে সীমান্ত পেরতেও ভারতীয় সেনারা পিছপা হবে নাএই অংশের ইঙ্গিত পাকিস্তানের দিকেইবিশ্লেষকদের অন্য অংশের মতে এর আগেও বিদেশে অপারেশন চালিয়েছে ভারতীয় বাহিনীসর্বশেষ এই অপারেশন কখনই সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদ রোখার জন্য এটা নতুন শক্তিশালী নীতির ফল নয়
ভারতের সেনাবাহিনী দাবী করেছে, তাদের প্যারাকমান্ডো আর ইনফ্যান্ট্রির সদস্যরা মঙ্গলবার ভোর রাত থেকে মিয়ানমারের ভেতরে ঢুকে একটা বিশেষ অপারেশন চালিয়ে নাগা জঙ্গি গোষ্ঠী এনএসসিএন খাপলাং এবং তাদের সহযোগী আরও কিছু জঙ্গিগোষ্ঠীর শিবির ধ্বংস করেছে; অনেককে মেরেও ফেলেছেঠিক কতজন জঙ্গি নিহত হয়েছেন, সেটা এখনও পরিষ্কার নয়
ভারতের প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায় চৌধুরী বলছিলেন, ভারত সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে বলেই এত বড় অপারেশন চালাতে পেরেছে সেনা বাহিনীতারা নিজে থেকে কখনই এই অপারেশন চালাতে পারে নাতাঁর মতে, এই অপারেশনের মাধ্যমে নিশ্চিতভাবেই বিভিন্ন দেশকে একটা বার্তা দেয়া গেছে, প্রয়োজন পড়লে বিদেশে গিয়েও ভারতীয় সেনা বাহিনী জঙ্গি বা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অপারেশন চালাতে পারেযে সব দেশের এই বার্তাটা বোঝা উচিত, আশা করা যায় তারা বুঝতে পারবেতবে তার মানে এই নয় যে আবারও নিশ্চিতভাবেই এরকম অপারেশন চালানো হবে ভবিষ্যতে
এটা পরিষ্কার যে, এই অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক এবং নিশ্চিতভাবেই পাকিস্তানের দিকেও একটা বার্তা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে রাজনৈতিক মহল থেকেযদিও ভারতীয় সেনা বাহিনী বলছে, মনিপুরে গত চার তারিখে যেভাবে তাদের ২০ জন সদস্যকে হত্যা করেছে নাগা জঙ্গিরা, তারপরে এরকম প্রতিহিংসামূলক অপারেশন চালানো কিছুটা বাধ্যবাধকতার প্রশ্ন হয়ে উঠেছিলবিশ্লেষকদের একাংশ আবার এই অপারেশনে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তটাকেই বড় করে দেখছেন
ভারতের নিরাপত্তা বিষয়ক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট অফ কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্টের কার্যনির্বাহী পরিচালক অজয় সাহনী বলেছেন, এই অপারেশনের পরে সামরিক কৌশল নিয়ে আলোচনার থেকে বেশী দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক আষ্ফালনকেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপি-র সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা এই অপারেশনকে ভারতের একটা নতুন সামরিক নীতি হিসেবে দেখাতে চাইছেনবোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে, সরকারের একটা শক্তিশালী নীতি, পেশীশক্তির প্রদর্শন হচ্ছে
কিন্তু এধরণের অপারেশন আগেও চোরাগোপ্তা হয়েছেমঙ্গলবারের অপারেশনটার প্রয়োজনীয়তা ছিল একটা স্থানীয় হামলার ঘটনার প্রেক্ষিতেএই অপারেশন থেকে কোন বড়সড় কৌশলগত পরিবর্তন না হওয়ারই সম্ভাবনাসাহনী আরও বলেছেনএকটা অপারেশনে সেনা বাহিনী বিজয়ী হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মিয়ানমারে অবস্থিত জঙ্গি শিবিরগুলো  ধ্বংসের জন্য লাগাতার প্রচেষ্টা না থাকলে এই অপারেশনের কোন গুরুত্বই থাকবে না
প্রায় একই কথা বলেছেন উত্তরপূর্ব ভারতের নিরাপত্তা ও জঙ্গিতপরতার বিশ্লেষক রাজীব ভট্টাচার্যিতিনি বলেন, জঙ্গি শিবিরগুলি আদৌ ধ্বংস করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছেতিরিশ বছরেরও বেশী সময় ধরে এই শিবিরগুলি গড়ে উঠেছেসেগুলোর সংখ্যা নিয়মিত বেড়েই চলেছে
ভারতের সেনা বাহিনী নিশ্চয়ই এই শিবিরগুলো ধ্বংস করতে চাইবেপ্রশ্ন হচ্ছে, সেই সুযোগ মিয়ানমার তাদের বারবার দেবে কি নাকারণ মিয়ানমার সরকার বা তাদের সেনা বাহিনী একটা নতুন ফ্রন্ট খুলে উত্তরপূর্বের জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে চাইবে না
এমাসের চার তারিখ মনিপুরের রাজধানী ইম্ফল থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে ৬ ডোগরা রেজিমেন্টের সদস্যদের ওপরে হামলা হয়রোজকার মতোই রোড ওপেনিং পেট্রল বা রাস্তার নিরাপত্তা খতিয়ে দেখার জন্য সেনা বাহিনীর চারটি গাড়ি পারালং আর চারোং গ্রামের কাছে পৌঁছলে প্রথমে ভূমি মাইন ফাটানো হয়তারপরেই রকেট ছোঁড়া হয়; চলতে থাকে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে গুলির বৃষ্টিস্থানটি ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত থেকে ২০ কিলোমিটার দূরেএই হামলার প্রেক্ষিতেই মঙ্গলবারের সেনা অপারেশন
এই অপারেশনের পরিকল্পনা তৈরি করার জন্যই ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বাংলাদেশ সফরে যান নিবাহিনীর ওপরে জঙ্গি হামলার পরেই মনিপুরের রাজধানী ইম্ফলে সেনাপ্রধান দলবীর সিং সুহাগ মঙ্গলবারের অপারেশনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন বলে জানা গেছেসূত্র: বিবিস বাংলা
লক্ষ্যণীয় এই প্রথম বারের মত কোন প্রতিবেশি রাষ্ট্রে ঢুকে গোপন অভিযান চালিয়ে অন্তত ২০ জন জঙ্গিকে খতম করেছে ভারতীয় সেনা স্পেশাল ফোর্সের সৈন্যরাএমআই-১৭ভি-৫ কপ্টারে চেপে অত্যন্ত গোপনে তাঁরা মায়ানমার সীমান্তের মধ্যে কয়েক কিলোমিটার ঢুকে জঙ্গিদের দুটি ঘাঁটিতে অতর্কিত হামলা চালায়ভারত দাবি করেছে এই অভিযানে মায়ানমার তাদের সহযোগীতা করেছে কিন্তু এই অভিযান সম্পর্কে মায়ানমারের কোন সেনা কর্মকর্তার বিবৃতি এখনো পাওয়া যাইনিএই অভিযানের পর ভারত সাফ জানিয়ে দিয়েছে পাশ্ববর্তী দেশে যদি জঙ্গিরা অবস্থান নেয় তাহলে তারা বসে থাকবে না
ভারতের এই হামলা পর মায়ানমারের সার্বভৌমত্ত লংঘন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছেভারতের এই আধিপত্য বিস্তারের মনোভাব পাশ্ববর্তী সামরিকভাবে দুর্বল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্তের জন্য হুমকি হিসাবে দেখা দিয়েছেআমাদের সরকার তো নিজেদের জঙ্গি প্রমাণে উঠে পড়ে লেগেছে
নরেন্দ্র মোদির সফরের আগে কুমিল্লায় পেট্রল বোমা হামলায় নিরীহ মনুষ দগ্ধ হলেও লাভ কার হয়েছে তা মানুষ সহজেই বুঝতে পারেছেআমাদের এখানে জঙ্গি রয়েছে এ প্রচার করতে সব চেয়ে বেশি আগ্রহী আমাদের সরকারভারত ব্যাপক জঙ্গি হামলার শিকার হলেও তাদের দেশে যে জঙ্গিদের বিশাল ঘাটি রয়েছে তা স্বীকার করতে নারাজতাই নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশ যদি ভারতীয় সেনাবাহিনীর হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে কি?

১২ জুন ২০১৫