রবিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৩

বরেন্দ্র ও প্রাগজ্যোতিষপুরের তেতুলিয়া - চতুর্থ পর্ব

নুরুল্লাহ মাসুম

চতুর্থ পর্ব

একই উপজেলার কুলিক নদীর তীরে রাজা টংকনাথের রাজবাড়ি অবস্থিত। সদর উপজেলা হতে রাজবাড়িটি ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। রাজা টংকনাথের পিতা বুদ্ধিনাথ চৌধুরী ছিলেন মৈথিলি ব্রাহ্মণ। এদের পূর্ব-পুরুষদের কেউ জমিদার ছিলেন না। বর্তমানে রাণীশংকৈল উপজেলার কাটিহার নামক জায়গায় গোয়ালা বংশীয় নিঃসন্তান জমিদারের মন্দিরে সেবায়েত হিসাবে কাজ করতেন টংকনাথের পিতা বুদ্ধিনাথ । গোয়ালা জমিদার কাশি যাওয়ার সময় তাম্রপাতে দলিল করে যান, তিনি ফিরে না এলে মন্দিরের সেবায়েত বুদ্ধিনাথ জমিদারির মালিক হবেন। এভাবেই বুদ্ধিনাথ জমিদারির মালিক হন। জমিদার বুদ্ধিনাথের দ্বিতীয় ছেলে টংকনাথ তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের আস্থা অর্জন করার জন্য মালদুয়ার স্টেট গঠন করেন। বিভিন্ন সময় সমাজ সেবা মূলক কাজের জন্য ১৯২৫ সালে ব্রিটিশ সরকার টংকনাথকে চৌধুরী উপাধিতে ভূষিত করেন। পরবর্তীতে দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজনাথ রায়ের বশ্যতা স্বীকার করে রাজা উপাধি পান। রাজা টংকনাথ স্বীয় স্ত্রী রাণী শংকরী দেবীর নামানুসারে মালদুয়ার স্টেটের নাম পরিবর্তন করে নামকরণ করেন রাণীশংকৈল।

টংকনাথের রাজবাড়ির অবস্থা দেশের অন্যান্য পুরাতন রাজভবনের মতই। কোন রক্ষণাবেক্ষণ তো নেই-ই, বরং দিনে দিনে বাড়ির বিভিন্ন অংশ খুলে নিয়ে যাওয়ার ফলে বাড়িটির কঙ্কাল অবশিষ্ট রয়েছে বলা যায়। এমনকি দোতলায় যাওয়া যে সিঁড়িটি সেটির মূল দুটি লোহার ভিম ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। দোতলা ভবনগুলোর দেয়াল থেকে কারুকাজ করা ইট খুলে নেয়া হয়েছ। বাড়ির বাহির মহল ও অন্দর মহলের অবস্থান আজও সুস্পষ্ট বোঝা যায়। যদিও ভবনগুলোর ওপর আগাছায় ভরে গেছে অনেক আগেই। বিশাল এই রাজবাড়ির অনেকগুলো ভবন ভেঙ্গে অর্ধেক হয়ে আছে। লতাগুল্ম দেয়ালগুলোয় পোক্ত আসন গেড়েছে অনেক আগেই। জনশ্রুতি আছে, রাজবাড়ি থেকে কুলিক নদীর তলদেশ দিয়ে একটি গোপন সুরঙ্গপথ ছিল নিরাপত্তার জন্য। আজ আর সেগুলোর চিহ্ন নেই। বাড়ির ভেতরে রঙমহল ছিল বলে ধারণা করা যায়। ভাঙ্গা বাড়ির ভেতরের নির্মান কৌশল এবং চলমান বারান্দা ও বড় বড় পিলারের অবস্থান দেখে তা পরিস্কার ধারণা লাভ করা যায় বটে। বাড়ির সীমানার মধ্যেই নতুন করে ভবন নির্মান করে স্থাপন করা হয়েছে বাচোর ইউনিয়ন ভূমি অফিস। পুরো এলাকাটি এখনো বেদখল হয়ে যায়নি, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ চাইলে এখনো এই বাড়িটিকে মেরামত করে পর্যটনের মোক্ষম একটি স্থাপনা দাড় করাতে পারে। কাকে বলবো, আমাদের পর্যটন বিভাগ তো আরো অলস, পর্যটনের সমৃদ্ধি নিয়ে সরকারের কারো মাথাব্যাথা রয়েছে বলে তো মনেই হয়নি কোনো কালে।

এখানে পৌঁছানোর পরে, রাজার বাড়ির মাঠে ছেলেদের ফুটবল খেলতে দেখতে পাই। এক সময়ে ওরা এসে আমাদের সাথে ছবি তুলতে চাইলো। বিশেষ করে আমার সাথে সেলফি তোলার আগ্রহ দেখালো কয়েকজন তরুন। তাদের সাথে ছবি তুলতে হলো। সকলে মিলে বাড়িটি ঘুরে দেখার পাশাপাশি আমি ব্যক্তিগতভাবে আলাদা করে কিছু ছবি নিলাম- পরবর্তীকালে লেখার সুবিধার জন্য। এখানেও আমাদের অবস্থান ছিলো আধা ঘন্টার মতো। এরপর আমাদের গন্তব্য পীরগঞ্জ উপজেলার লেকপার্ক।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। হেমন্তের আগমনে দিনের পরিধী কমে আসছে ক্রমশ। সন্ধ্যার আগে আগে আমরা পৌঁছলাম পীরগঞ্জ উপজেলার সাগুনিতে। এখানে টাঙ্গন নদীর উপরে একটি সেতু রয়েছে এবং সেতুর পাশেই নির্মান করা হয়েছে একটি রাবার ড্যাম। এলাকাটিতে প্রচুর শাল গাছ লাগানো হয়েছে। ফলে প্রতি বিকেলেই এখানে অনেক মানুষের আগমন ঘটে। রাবার ড্যাম দেখা একটা উদ্দেশ্য বটে, পাশাপাশি বনায়ণের মাধ্যমে সৃষ্ট সুন্দর বনানীতে ঘুরে বেড়ানোর জন্যও এখানে মানুষজন আসে। এটিকে বলা হয় লেক পার্ক। রাবার ড্যামের কারণে শুকনো মৌসুমে ড্যামের একপাশে পর্যাপ্ত পানি থাকলেও অন্যপাশে পানির পরিমান অনেক কম থাকে, দেখতে শুকনো লেকের মতোই লাগে।


এখানে থাকতেই দেখলাম সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষজন দেবী দুর্গার প্রতীমা বিসর্জন দিতে আসছে দলে দলে। সকলে মিলে দেবী বিসর্জন অবলোকন করে রওয়ানা হলা শহরের উদ্দেশ্যে।

চলবে



কোন মন্তব্য নেই: