বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৩

নদী সমুদ্র আকাশ

নদী সমুদ্র আকাশ
নুরুল্লাহ মাসুম

উত্তাল তরঙ্গ আছড়ে পরছে সাগরতটেবঙ্গপোসাগরের বেলে মাটিযুক্ত সৈকতে আছড়ে পরা ঢেউগুলো বালির সাথে লুকোচুরি খেলে ফিরে যাচ্ছে সাগরের অথৈ বুকেমাঝখানে ঢেউয়ের মাথার ফুটে থাকা ফুলগুলোর শ্বেতশুভ্র অসাধারণ সৌন্দর্য সমুদ্রের চোখ জুড়িয়ে দেয়
সাগর তীরে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো অসংখ্য পাথরের একটার ওপর বসে আছে সমুদ্র, দক্ষিণ বাংলার সন্তান হয়েও সাগর পাড়ে বেড়ানো অভিজ্ঞতা তার বেশি দিনের নয়যে কারণেই বারে বারে সৈকতে আছড়ে পরা ঢেউগুলো দেখতে তার ভালো লাগেমন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকে সে ঢেউগুলোর দিকেঢেউগুলোর উৎস কোথায় জানে না সমুদ্রতবে সাগরের বুকে সৃষ্ট ঢেউগুলোর সাতে নিজর একটা মিল খুঁজে পায় সেজীবনের নানান চরাই-উৎরাই এবং সাগরের ঢেউগুলোর সৈকতে আছড়ে পরা, আবারো সাগরের ফিরে যাওয়ার মধ্যে দারুণ একটা যোগসূত্র আবিষ্কার করে সেএতে করে মনটা আরও বেশি উদাস হয়ে যায়
সূর্য পশ্চিমাকাশের শেষ প্রান্তে চলে এসেছেলক্ষ-লক্ষ সূর্য যেন সাগরের বুকে লুকোচুরি খেলছেসূর্য যত নিচে নামছে, সাগরের মাঝে ততবেশি সূর্য বেড়ে যাচ্ছেপ্রশান্ত মহাসাগরের বুকে এ দৃশ্য আরও বেশি লোভনীয় হতো বলে তার মনে হয়সেখানে পানি আরও বেশি স্বচ্ছশ্যাম উপসাগরের পানিও স্বচ্ছএখানে পানি ঘোলা বলে দৃশ্যটা তার কাছে কিছুটা হলেও ম্রিয়মাণ
উঠে দাঁড়ায় সমুদ্রসৈকতে লোকের ভিড় বেড়েছেঘণ্টাখানেক আগেও খুব কম সংখ্যক দর্শনার্থী ছিল, এখন কয়েকগুণ বেশিভিড়টা তার ভালো লাগে না
একাকী হাঁটতে থাকে সমুদ্র, উত্তর দিকেও দিকটায় মানুষের ভিড় কমদর্শনার্থী ওদিকটায় কম বলে পাথরের সংখ্যা যেমন বেশি, তেমনি পাথরগুলো ময়লাও বেশি
আরও সামনে আগায় সে; আরওথ আরও
এদিকটায় গাছ-গাছালির সংখ্যা বেশিকিছুটা অন্ধকারও বটেআর এগুতে সাহস হয় নানির্জনতা বেশ পছন্দ তারতাই বলে নিরাপত্তার দিকটাও তাকে ভাবতে হয়অন্তত একজন সাথী থাকলে আরও একটু এগুনো যেতএকটা গাছের পাশে দাঁড়ায় সমুদ্রসূর্য তখন দিগন্তের একেবারে শেষ সীমানায়অপূর্ব এক দৃশ্যলক্ষ-কোটি সূর্য যেন সাগরের পানির মধ্যে জোটবদ্ধ হয়ে বিশাল লম্বাটে এক আকার ধারণ করেছেদমবন্ধ করে অপরূপ প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকে সে
- কি চমৎকার! তাই না?
বা দিকে তাকায় সমুদ্রসংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়
- অপূর্ব!!
ক্ষাণিকটা সময় কেটে যায়সমুদ্র তখনো দিগন্তের দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে
আগন্তুকও চুপ করে দাঁড়িয়ে
সূর্য সাগরের পানির নিচে হারিয়ে গেছেআকাশ এবং সাগরের পানিতে তখনো তার আভা লেগে আছেআগন্তুক আবারো বলে
- জায়গাটা নিরাপদ নয়; ও দিকটায় যাই, চলুন
- চলুন
বলে সমুদ্র হাঁটতে আরম্ভ করে
- আমি নদীপাহাড় তলী থাকি
ক্ষাণিক বাদে সমুদ্র বলে
- বেশ নামতো আপনারআমি সমুদ্রগতকালই চট্টগ্রাম এসেছি
পাশাপাশি হাঁটতে থাকে ওরা
পুরো সৈকত জুড়ে তখন আধাঁর নেমে এসেছে
নদী আর সমুদ্রের জানা-শোনার তিন মাসনদী চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে থাকলেও আদিতে ওরা চন্দ্রদ্বীপের বাসিন্দাবাবা বড় ব্যবসায়ীওদিকে সমুদ্র ঢাকার বাসিন্দা হলেও আদিবাস খলিফাতাবাদপরে এক পুরুষ চন্দ্রদ্বীপেনিজেদের পূর্ব পুরুষদের মধ্যে একটা মিল যেমন ওরা খুঁজে পায়, তেমনি ওদের নামের মিলটাও চমৎকারনদী পথ চলতে চলতে সমুদ্রে তার শেষ গন্তব্যএটা স্বভাবিক নিয়মএক্ষেত্রেও তাই হয়তিন মাসেই নদী আর সমুদ্র তেমনি গন্তব্যে পৌঁছে যায়যদিও গতি উল্টো
সমুদ্রকেই আসতে হয় নদীর কাছে বারংবার
তিন মাসে সমুদ্র কম করে হলেও নদীর কাছে পাঁচ বার এসেছেপ্রতিবারেই ওরা ওদের প্রথম সাক্ষাতের সেই গাছটার কাছে এসে বসে; নিরবে সময় কাটায়সাগরের বুকে সূর্যের হারিয়ে যাওয়ায় দৃশ্য নয়ন ভরে অবলোকন করেসময়ান্তে সমুদ্র ফিরে যায় ঢাকায়
বর্ষাকালসাগরের বুক ভরা জলভরা যৌবনা কর্ণফুলি, বুক উজার করা ভালোবাসার ডালি সাগরের বুকে ফেলে দেয়সাগরের বুকের সে ভালোবাসা উত্তাল তরঙ্গের আকারে আছড়ে পরে সৈকতেমেঘলা আকাশের এমন এক দিনে সমুদ্র আর নদী কাছাকাছি; সৈকতের সেই গাছ তলায়
- কেমন লাগছে? জানতে চায় নদী
- মন্দ নয়জবাব সমুদ্রের
- কেমন? আবারো জানতে চায় নদী
- ভরা ভাদরের আনন্দ বেদনার মতোউত্তর সমুদ্রের
- এর পর দু'জনেই উদাস
সন্ধ্যার মৃদু-মন্দ বাতাস হঠাৎ করেই গতি পায়গাছের পাতায় ঝিরি-ঝিরি শব্দপ্রকৃতি যেন প্রাণ ফিরে পায়
নদী আর সমুদ্রের মধ্যে আসে জীবনের মাদতকতা
হঠাৎ করেই ওদের জীবনের গতির পরিবর্তন হয়তখনই ওরা ছক করে ফেলে সিলেট যাবে বেড়াতে; সম্ভব হলে পরদিনই
হোটেলে ফিরে ঢাকায় ফোন করে সমুদ্রবাড়িতে জানায় ফিরতে দেরি হবেতখন তার চোখের সামনে জাফলং আর তামাবিলের অপরূপ প্রকৃতিচট্টগ্রামের বিপরীত এক দৃশ্য
ওদিকে নদীর বাড়িতে ভিন্ন দৃশ্যপরদিনই সিলেট যাবার মতো ছক সে তৈরি করতে পারে নিতাইতো ফোনে সমুদ্রেকে জানায়, আরো একদিন সময় লাগবেফোনটা পেয়ে সমুদ্র ভাবে, ভরা ভাদরের আনন্দ বেদনার কাব্য এমনিই হয়
দু'দিন বাদে রাত দশটার ট্রেনে ওরা রওয়ানা হয় সিলেটেপ্রথম শ্রেণীর বার্থরাতটা ঘুমিয়ে কাটাবার কথা, বাস্তবে তা হয় নাসারা রাত ওদের কাটে না ঘুমিয়ে, হাজারও কথার মালা গাঁথতে গাঁথতেদু'টো ভিন্ন জগতের মানুষএকাকার হয়ে যায় ওরা অন্তত কথার মালায়যেন কত জনমের জানা শোনা ওদেরহঠাৎ করেই সমুদ্র জানতে চায়
- তোমার ভয় করছে না?
- কিসের ভয়?
- আমাকে?
- কেন?
- আমিতো পুরুষ
- তাতে কি?
- যদি অশুর ভর করে?
- তা করবে না
- কি করে বুঝলে?
- বুঝতে পারি
- কিভাবে?
- এমনিই
এমনি নানান কথার মাঝে ওদের রাতটা পার হয়ে যায়শেষ রাতে শ্রীমঙ্গলে এসে দু'জনেই সিদ্ধান্ত নেয় এখানেই নেমে যাবে, সিলেট যাওয়া হবে নাট্রেন থেকে নামার আগে দু'জনার মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি হয়সে মতেই ওরা পথ চলবে
রাতের বাকি সময়টা ওরা স্টেশনের চায়ের দোকানে কাটিয়ে দেয়ভোরের আলো ফুটলে রিক্সায় চা বাগানেচট্টগ্রাম থাকতেই বাগানের রেস্ট হাউসের থাকার ব্যবস্থা করেছিল সমুদ্রবাগানের ফটকে পোঁছতেই ছোকরা গোছের একজন ওদের অভ্যর্থনা জানায়পরে ওরা জেনেছিল ছেলেটি বাগানের সুপারভাইজার
বেলা আটটা নাগাদ ম্যানেজার হুমায়ূন কবীর ওদের সাথে দেখা করেতার প্রথম প্রশ্ন
- সমুদ্র, তুমি বিয়েটা করলে কবে?
সমুদ্র তার কথায় সঠিক কোন উত্তর না দিয়ে বলে
- আপনার সৌজন্যে বৌ-ভাতটা এখানেই আয়োজন করবো
সমুদ্র তার কথা রেখেছিলচা বাগানের কর্তাগোছের লোকদের সম্মানে দু'দিন বাদেই আয়োজন করেছিল ডিনার পার্টির
সকলের নাম আর আজ মনে নেই নদীরতবে কাশেম, ইমরান, এমদাদ আর মতিউরের কথা আজও তার মনে আছে
দিন সাতেক ছিল ওরা ওখানেকাশেম আর মতিউর সব থেকে বেশি সময় দিয়েছিল ওদেরবাগানে ঘুরিয়ে দেখানোকুলিদের বস্তিতে নাচ গানের আসরে নিয়ে যাওয়া আর কমলা বাগান ঘুরিয়ে দেখানো, সবই করেছিল ওরাকাশেমের কথা আজও মনে পড়ে নদীর, কি আন্তরিকভাবেই না নদীকে সে 'ভাবী' বলে ডেকেছিল
সেই সাত দিনের কথা নদী আজও ভুলতে পারে নিকোন দিন ভুলতেও পারবে না সেচা বাগানের ভেতরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটেছিল ওরা দু'জননা, কোন ক্লান্তি আসেনি সে দিন ওদেরঅথচ আজ অল্পতেই ক্লান্তিতে কাতর হয়ে ওঠে নদী, আগের মতো মনযোগ দিতে পারে না কোন কাজেসাত দিনের কোন সময়ই সমুদ্র কোন প্রকার অসহনীয় দাবী করেনিঅভিমান করে নদীও এক রাতে জানতে চায়
- কেন আমার এখানে এসেছি?
- বেড়াতে
- শুধুই বেড়াতে?
- তা নয় তো কি?
- ওরা আমায় ভাবী ডাকে
- তাতো ডাকবেই
- তাহলে আমরা দূরে কেন?
- কই, যথেষ্ট কাছেই তো আছি
- হাঁ, যা, এক ছাদের নিচে, তবে বহু দূরে
সমুদ্র বোঝে নদীর কথাতবে যথেষ্ট সাবধানী সেগম্ভীর ¯^রে বলে
- বিপদে ডাকতে যাও?
- কিসের বিপদ?
- সামাজিক
- যা হবার হবে, আমি সামলাবো
এরপর ওদের ব্যবধান কমেনদীর জল যে ভাবে সাগরে মেশে, সাগর যেমন নদীর জল নিজ বুকে ধারণ করে, তেমনি এক বাধাহীন স্রোতে মিশে যায় নদী আর সমুদ্রপৃথিবীর তাবৎ বাধা দূর করে ওরা একাকার হয়ে যায়কাশেম আর মতিউরের 'ভাবী' ডাক সার্থকতা লাভ করে
মাস খানেক পর নদী আর সমুদ্র সিদ্ধান্ত নেয়-ওরা বিয়ে করবেএর আগেই ওরা ঠিক করে অনাগত অতিথির নাম হবে আকাশনদী জানতে চায়
- নামটা আকাশ হবে কেন?
- নদী সাগরে মেশে, আর সাগর আকাশে বিলীন হয়, তাই
- যদি মেয়ে হয়?
- না ছেলেই হবে
- যদি হয়?
- হোক, নামটা আকাশই হবে
নির্ধারিত দিনে সমুদ্র ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আসেনিঢাকা থেকে আসা সবগুলো ট্রেন চেক করা হয়সমুদ্র কোনটাতেই আসেনিঢাকায় ফোন করা হয়ঢাকা থেকে জানান হয় সমুদ্র চট্টগ্রাম গেছে
কিছুদিন বাদে পত্রিকা আর টিভিতে সমুদ্রের নিখোঁজ সংবাদ ছাপান হয়সমুদ্রের হদিস আর মেলেনি
সামাজিক অপবাদ মাথায় নিয়েও নদী আকাশের জন্ম দেয়সমাজ থেকে পালায় সেআশ্রয় নেয় ভানুগাছ গ্রামেকাশেম আর মতিউর তাকে সহায়তা করে
সেই ভানুগাছ, যেখান থেকে সমুদ্রের দেয়া উপহার আকাশকে নিয়ে নদী ফিরে গিয়েছিল চট্টগ্রামঅনাকৃতির আকাশ আজ আকৃতি পেয়েছেবাস করছে মায়ের সাথে, সেই ভানুগাছ গ্রামেআকাশ আছে, সমুদ্রের পরিচয়েনদী আছে সমুদ্রের পরিচয়ে; নেই কেবল সমুদ্র
আকাশ আর নদীর থেকে সমুদ্র আজ বহুদূরেদিগন্তের ওপারে ঠিকানা বিহীন কোন জায়গায়নদী আজও সমুদ্রের অপেক্ষায়, তাকিয়ে সামনের দিকে নয়; আকাশ পানে

গোলিকর চর

গোলকীর চর
নুরুল্লাহ মাসুম

বোশেখ মাসের বিকেলকেরায়া নৌকায় করে যখন কাউখালীর কাছাকাছি পৌঁছালাম, মাঝি প্রায় চিৎকার করে আঞ্চলিক ভাষায় বলে ওঠে
-        সার, ওই দ্যাহেন একটা চর
রোদের তীব্রতা উপো করে গাঢ় অথচ মোটা কাঁচের চশমার পেছনে লুকানো চোখ দুটো দিয়ে ওদিকটায় তাকাবার ব্যর্থ চেষ্টা করলামপশ্চিমে হেলানো সূর্য নদীর জলে হাজার রবির জন্ম দিয়েছে ইতোমধ্যেইরবিরশ্মি যেমনি আঘাত হানছে অসংখ্য রবিকনা তেমনি আঘাত হানছেকেরায়া মাঝির ওই চরআর দেখা হল নাব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ না ঘটিয়ে বিজ্ঞের মতো প্রশ্ন করলাম
-        কতণ লাগবে?
-     ঘণ্টা খানেক
বুঝলাম বেশ দূরের পথসন্ধ্যাও নেমে যেতে পারে, ভয় পেতে লাগলামচরে পৌঁছতেই যদি সন্ধ্যা হয়ে যায়, ফিরবো কখনসান্তনা পেতে চাইলাম
-        চরে থাকোনের মতো কোন জায়গায় আছে?
এক গাল হেসে পৌঢ়ত্বের কাছে হার মানা মাঝি জবাব দেয়
- থাকোনের জাগা পাইবেন কই? গোলকীর চরে মানুষ থাকে নাকি?
-        তাহলে?
-        বেলাবেলি ফিরা আইতে অইবো
এবার বুঝলাম এবং নিশ্চিন্ত হলাম, ঘণ্টাখানেক দূরের পথ বলে মাঝি যে কথা বলেছিল সে পথটুকু যেতে ততটা সময় লাগবে না
হাদিস অবশ্য বলেছিল স্টিমার থেকে নেমে গোলকীর চরে পৌঁছতে সাকুল্যে এক ঘণ্টা লাগতে পারে, যদি উজান বাইতে না হয়সে হিসেব মতে তিনটে নাগাদ পৌঁছতে পারবো বলে ভাবতে চাইছি
গোলকীর চরপিরোজপুর জেলার একটা ছোট্ট চরসাধু ভাষায় বললে বলতে হয় দ্বীপদণিাঞ্চলে এমন বহু দ্বীপ আছে, যা কোন দিন মানচিত্রে উঠবে নাবহু ছোট্ট চরের একটি গোলকীর চরঐ গন্তব্যে পৌঁছার জন্য আমি একাকী এ পথে
দৈনিক সান্ধ্য কাগজের একটি রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রথম এ চরের প্রতি আমার আগ্রহ সৃষ্টি হয়মুক্তিযুদ্ধের সাথে মিশে আছে এর ইতিহাস
১৯৪৭ সালের কোন এক সময়-অবশ্যই ১৪ আগস্টের পর, গোলক বানু আশ্রয় নেয় সন্ধ্যা নদীর এক নাম না জানা চরেঅন্যভাবে বলা যায়, তখনো চরটির নামকরণ হয়নিদেশ ভাগ হয়ে গেলগোলক বানু সকলের অলক্ষ্যে  আশ্রয় নেয় সেখানেসাথে তার প্রাণের সখা ভূবনেশ্বর হালদারওদেও সম্পর্ক  স্বাধীন পাকিস্তনে কেউ মেনে নেবে না ভেবেই ওদের ঐ গোপন মিশনওরা এসেছিল সাগর পাড় থেকেএখন আর কেউ জানে না ওরা মূলত কোন এলাকার বাসিন্দা ছিল
মুসলিম প্রধান পাকিস্তনের নেতৃবৃন্দ মতার ভাগাভাগিতে ব্যস্তলোকাল লিডাররাও কেন্দ্রীয় নেতাদের তোষামোদে আরো বেশি ব্যস্তসে কারণে অসময়ে ঐ জমির খবর তখন তেমন কেউ নেয় নিতাছাড়া চরটি তখনো ডুবো ডুবোঅমাবশ্যা ও পূর্ণিমার জোয়ারে চর ডুবে যায় ঘোলা জলেতাই কারো নেক নজর নেই ওদিকে
দিন কাটেকালের হিসেবে পার হয়ে যায় অনেক গুলো বছরদেশ রাজনীতি অর্থনীতি কোন কিছুই গোলক বানু আর ভবনের জীবনে প্রভাব ফেলতে পারেনাভূবনেশ্বর খেটে খাওয়া মানুষদিন মজুরীর কাজ করে দিন গুজরান করেচরের মাঝে একটা খড়ের ঘর তুলে সংসার শুরু করেছিল অনেক আগেই, ওরা এখন তিনজনসংসারের সীমানা বাড়ে নিগোলক বানু শুকরিয়া আদায় করে আল্লাহর কাছেভূবন ভগবানের কাছে নতজানু হয়ে কৃতজ্ঞতা জানায়নবাকে নিয়ে ওদের দিন ভালই কাটে
ভর অমাবশ্যা-পূর্ণিমার জোবায় পানি বাড়লে ওরা মাচা বানিয়ে দিন কাটায়নবা জানতে চায়
-        মা আমরা এইহানে ক্যান?
-        এইটা আমাগো বাড়ি
-        ক্যামনে আইলা নদীর মদ্যি?
-        আল্লাহ দিসে
বাবা বলে-
-  ভগবানের কৃপায় এটা আমাদের বাড়ি হয়েছেনদীর জল আর মাছ আমাদের দেবতাজল আমাদের তি করে না, মাছ খাইয়া বাঁচি
নবা মা-বাবা দুজনকেই ভালোবাসেপ্রকৃতি নবাকে দুরন্ত বানায়প্রায় সময় ওকে দেখা যায় নদীর জলেফিরবে মাছ নিয়েজাংলা দিয়ে মাছ ধরার কৌশল সে বাবার কাছে শিখেছেশুকনার সময় লাউ গাছ, কুসির গাছ আর নানান পদের সবজির চাষ করে নবা
এত কিছুর পর ওর একটা দুঃখ আছেসেই দক্ষিণে কাউখালী, পশ্চিমে গাববাড়ি, পূর্বে আমড়াজুড়ি আর উত্তরে জলাবাড়ি, কোনটাই তার দেখা হয় নিনিজের বাড়ি সম্পর্কে নবার  বাবা ভূবন বলে
- আমাদের বাড়ি গোলকীর চর
একদিন গোলক বানু জানতে চায় স্বামীর কাছে
-        তুমি এইডারে গোলকীর চর কও ক্যান?
-        তোমার লাইগ্যা এই চর আমি পাইছিএত বছর অইল, কেউ আহে নাই দখল করতেএইডার মালিক তুমিতাইতো এইডার নাম গোলকীর চর
নবা মায়ের কাছে জানতে চায়
-        মা, তোমার নাম গোলকবানু হইল ক্যান?
-        জন্মের সময় আমার বদন খানি আছিল গোলহেই লেইগ্যা তোর নানায় নাম রাখছিলো গোলক বানু
নবা মায়ের কথায় হাসেআবারো জানতে চায়
-        আমার নানা-নানী কই?
-        হেরা হেই-ই দক্ষিণে থাকতোএহন মনে অয় নাই
-        তুমি আর যাবা না?
-        তৌফিক নাইরে বাবাবলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে
ভূবন একদিন বলেছিল
-        গোলকী, তুমি বাপের বাড়ি যাবা না?
- কেমতে?
- ধর আমি যদি লইয়া যাই?
- না, তা অইবো নাতুমি গেলে তোমারে আস্তা রাখবে না।   আমি তোমার হারাইতে পারমনা
এরপর কখনোই গোলক বানুকে বাপের বাড়ি যাবার কথা বলেনি ভূবনসে জানতো নিজের বাবা-মা বহু আগেই কলিকাতা চলে গেছেঅবশ্য সে কারণে কখনোই তার দীর্ঘশ্বাস বের হয় নি
নবা একবার বাবার কাছে আবদার করেছিল কাউখালি যাবেবাবা বলেছিল
- দেশ স্বাধীন হইলে যাবি
স্বাধীন মানে কি জানতে চাইলে সে বলেছিল-
-        আমাগো মতন যহন পুরা দেশটা হইবোবিদেশীরা আমাগো উপর মাতুব্বরী করতে পারবো না
মুর্খ নবা বাবার কথার মানে বুঝতে পারে নাইগোলকবানু কিন্তু ঠিকই বুঝেছিলভূবন তাকে কিছু না বললেও দেশের খোঁজ খবর রাখেগোলক বানুর মনটা গর্বে এক হাত ফুলে যায়ও হাসে, ভূবন এইট পর্যন্ত পড়েছিল
অঘ্রাণ মাসবিকেল বেলা থেকেই আকাশে মেঘপানি বাড়তিভূবন বা গোলক বানুকে এ নিয়ে ভাবতে দেখা যায় নাবাইশ তেইশ বছর ধরের ওরা এমনি দেখে আসছেনবার মনে ভয় লাগেঅঘ্রাণ মাসে আকাশে মেঘ থাকবো ক্যান? জল বাড়লেও এতটা বাড়ার কথা নারাত বাড়তেই পানিও বাড়তে থাকেএবারে ভূবন আর গোলক বানুও ভয় পেয়ে যায়মাচাং বানাতে ব্যস্ত্ হয়ে যায় ওরা, সময়ে কুলায় নাশেষে, ঘরের চালে আশ্রয় নেয় ওরাগোলকীর চরে বড় কোন গাছ নেইসেজন্য ওদের আফসোস ছিল নাভূবন জানতো, বড় বড় গাছ হলেই সরকারি লোকের চোখে পড়বেআর চর চলে যাবে সরকারের দখলেআজ পানি বাড়ার গতি দেখে ভয়ে ভয়ে সে ভাবছে, বড় গাছ থাকলে ভাল হতোতিনজনের একটা আশ্রয় হতো
সারা রাত শংকায় কেটে গেলোকোন মতে বেঁচে রইল ওরাভগবানের কাছে কৃতজ্ঞতা জানায় ভূবনগোলক বানু বহুদিন পর নামাজ পরেনবা, সে আর কি করে, তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকেকখন মেঘ কেটে সূর্য উঠবে সেই আশায়
এরপর থেকে ভূবন বিকল্প বাসস্থানের চিনন্তা ভাবনা করতে থাকেগোলক বানু সায় দেয় নাতবে নবার জন্য মায়া ছাড়ে গোলক বানুনবাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়ে মিয়ার হাটের একটা কাঠের গোলায়ভূবনের আশা, নবা যেন ভাল থাকেগোলক বানুর আশা, নবা কাজ করে অনেক টাকা জামিয়ে এই চরে বড় ঘর বানাবেসরকার এই চর নিলেও যেন কিনে রাখতে পারে সেতারপর-
তারপর নবার ঘরে আসবে সুন্দরী একটা বউসে হবে শ্বাশুরী, আরও পরে দাদিছোট সোনার সংসার আনন্দে হাসিতে ভরে রাখবে আরেক নবা
একদিন গভীর রাতে নবা বাড়ি আসেসাথে জনা চারেক বেটা ছেলেমায়ের কাছে মিছা বলেনা নবা
-        মা দেশে যুদ্ধ শুরু হইছেপীর সাহেব আমাগোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতাছেপাকিস্তানীরা বাঙালি মারতাছে
গোলক বানুর মাথায় ঢোকে না কিছুসে বুঝতে পারে নাপাকিস্তানতো একটা দেশতারাও তো এ দেশের লোকনিজেরা নিজেগো মারবো ক্যান? তবে ছেলে যখন যুদ্ধ করছে, মায়ের মত যুদ্ধের পক্ষেতাছাড়া বাবা খুশি হয় যে, স্বাধীনতার কথা কদিন আগেও নবা বুঝতো না, সেই ছেলেই এখন স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছেসে প্রতিজ্ঞা করে যুদ্ধের পে তারা কাজ করবে

গোলকীর চরে পৌঁছতেই চোখ দুটো ভরে গেলচারিদিকে সবুজের সমারোহবড় কোন গাছ নেইসবুজ ঘাস আর মাঝে মধ্যে দুএক গোছা বিচালি, মাঝি নৌকা বেঁধে রেখে আমায় সঙ্গে নিলদুজনে হাঁটছিসে বলে যাচ্ছে......
-        যুদ্ধের সময় গোলক বানুর বাড়িতে মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্প হইছিলোআমড়াঝুড়ির হাশেম চেয়ারম্যান খবরটা কাউখালী থানায় জানাইয়া দিছিলরাজাকারের বাচ্চা আছিল বেডা
-        তার মানে ওর বাবাও রাজাকার ছিল?
-        না ভাই সাবহের বাবাতো আরো আগেই মরছিলতয় রাজাকারগো রাজাকারের বাচ্চা কইতে ভালো লাগে
-        তারপর?
-        খবর পাইয়া কাউখালী আর স্বরূপকাঠী থেইক্যা গানবোটে মিলিটারীরা আইলো, লগে বহুত রাজাকারপুরা চরডা দখল কইরা ফালাইলো
-        মুক্তি বাহিনীরা কোথায় ছিল?
-        হগলতেই চোরা ডুব দিয়া গাববাড়ির দিকে পালাইছিলদিন ভর পুরো গোলকির চরে কাউরে পায় নি পাক আর্মি, কেবল গোলক বানুকে ছাড়াহাশেম চেয়ারম্যানের ভাষ্যমতে ক্যাপ্টেন বুঝতে পারে পুরো চরটা গোলক বানুরএকাই মুক্তিদের ক্যাম্পটা সে চালাইতোকিন্তু কোন মুক্তি ধরতে না পারায় ােভে গুলি করে হাশেম চেয়ারম্যানকে মেরে ফেলে মিলিটারীরামাঝির ভাষায়
-        কুত্তা হাশেমের লাশ মাস খানেক সন্ধ্যা নদীতে ভাসছিলজোয়ার ভাটায় এই নদীতেই আওয়া-যাওয়া করছেঅন্য কোন হানে যায় নাই
-        গোলক বানুর কি হলো?
-        কুত্তার বাচ্চারা গোলক বানুরে মাইরা একটা খুটি পুইতা ঝুলাইয়া রাখছিল
কথাগুলো বলে মাঝি চোখ মুছলো
-        তয় দেশ স্বাধীনের পর হগলে মিল্লা নবারে লইয়া হের মায়ের হাড্ডি গুলান ওই-ই হানে কবর দিছিল
না, দেশ স্বাধীন হবার পর নেতা গোছের কেউ গোলকীর চরে আসে নিকোন সৌধ নির্মিত হয় নি গোলক বানুর কবরেতবে সার্ভে বিভাগ যখন এই চরটিকে তালিকাভুক্ত করে তখন সরকারের খাতায় এর নাম স্থায়ীভাবে হয়ে যায় গোলকীর চর
কিভাবে হলো এই নামকরণ? মাঝির ভাষায়-
-        একদিন লাল নিশান উড়াইয়া একখান ইস্প্রিট বোট আইলোসায়েবরা কি জানি কওয়া কওয়ি করলোহেই সময় গোলক বানুর কবরের সামনে বওয়া আছিল হের স্বামীআধ পাগলা তহনসায়েবরা যখন জিগাইলো তোমার নাম কি? চরের নাম কি? তখন হের খালি একখান কথা
- গোলকীরে, তোর চর আইজ থেইক্কা সরকার লইয়া গেলরে
কতাডা কইয়াই হেও মইরা গেল
সূর্য ডুবো ডুবোপাশাপাশি দুটো সমাধিকোন সৌধ নেইশান্তিতে চির নিদ্রায় শায়িত গোলকবানু আর ভুবনেশ্বরতাদের ছেলে নবা আর আসে না এ চরে
নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়ে চোখের কোনায় জলের উপস্থিতি অনুভব করলামসেই সাথে শুনতে পেলাম তিব্র চিৎকার
-        গোলকীরে, তোর চর আইজ থেইক্কা সরকারে লইয়া গেলরে