চিফ স্কাউট হিসেবে রাষ্ট্রপতি এবং
অন্যান্য প্রসঙ্গ
নুরুল্লাহ মাসুম
২য় পর্ব
হাইকোর্টে
বাংলাদেশের প্রধান স্কাউট হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতির মনোনয়ন নিয়ে রিট পিটিশন
হবার পরে এবং এ বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্টের
রুল জারির পরে কারো কারে গাত্রদাহ শুরু হয়েছে এবং নানান মন্তব্য শুনতে হয়েছে। এতে
কোন সমস্যা হবার কথা নয়। খোদ বাংলাদেশ স্কাউটস এর বড় বড় কর্তাব্যক্তিগণও বিষয়টি
নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন বলে জানতে পেরেছি। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য সভাকক্ষেই
নাকি স্বীকার করে নিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে তাদের আগে ভাবনা উচিত ছিল; এখন ভুল সংশোধন
করার সময় এসেছে। তবে বিপক্ষেও ছিলেন অনেকে- তারা এ বিষয়ে আইনী লড়াই চালাবেন বলেছেন
বলে জানতে পেরেছি। বিষয়টি আইনী লড়াইয়ের নয়, ভুল সংশোধন
করার। কেননা, মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে বাংলাদেশের প্রধান স্কাউট মনোনয়ন করাটা
দোষের নয়, অনেক দেশেই এ ব্যবস্থা চালু আছে; তবে আমাদের দেশে যে পদ্ধতিতে করা
হয়েছে, সেটি ভুল এবং পরিষ্কারভাবে দেশের সংবিধানের লংঘন। বাংলাদেশ স্কাউটস এর মতো
একটি বেসরকারী সংগঠন রাষ্ট্রপতি কোন পদ-পদবী প্রদান করতে পারে না। এক্ষেত্রে দেশের
সংবিধানের মাধ্যমে তাঁকে এ দায়িত্ব প্রদান করলে তা হত যথাযথ। তাছাড়া রাষ্ট্রপতি
সংবিধান মোতাবেক প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কারো পরামর্শে কাজ করতে পারেন না; এখানে
বাংলাদেশ স্কাউটস এর প্রধান জাতীয় কমিশনারের পরামর্শে রাষ্ট্রপতি যে সকল কাজ
করছেন, সেগুলোই সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। তাছাড়া, আমাদের দেশের সংবিধান অনুসারে
প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন প্রধান নির্বাহী; অথচ স্কাউট সংগঠনে প্রধানমন্ত্রীর কোন
অফিসিয়াল অবস্থান নেই।
এবার
আসি বিশ্বের প্রধান প্রধান দেশগুলোয় চিফ স্কাউট প্রসঙ্গে। এ কথা সকলেই জানেন,
বিশ্বের চিফ স্কাউট হচ্ছেন স্কাউটিং এর প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট স্টিফেনশন স্মিথ
ব্যাডেন পাওয়েল (লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল বা বিপি নামে সমধিক পরিচিত)। আজো পর্যন্ত এ
মর্যাদা অন্য কাউকে দেয়া হয়নি। যেখানে বিশ্বের প্রধান স্কাউট একজন আর্মি অফিসার
(লেফটেনেন্ট জেনারেল পদ মর্যাদার) সেখানে স্কউটিং এর জন্মভূমি ইংল্যান্ডে
(যুক্তরাজ্য) সংগত কারণে মহামান্য রানী চিফ স্কাউট হননি। অনেকেই
হয়তো জানেন না যে, ইংল্যান্ডের চিফ স্কাউট পদটি নির্বাচিত পদ। বর্তমানে
ইংল্যান্ডের নির্বাচিত চিফ স্কাউট হচ্ছেন বিয়ার গ্রিলস (Bear Grylls ) যিনি পেশায় একজন টেলিভিশন সাংবাদিক। তিনি
বিশ্বখ্যাত ডিসকভারী চ্যানেল এ কাজ করেন। তাঁর “ম্যান অ্যান্ড
ওয়াইল্ড” সিরিজটি বিশ্বখ্যাত এবং খুবই জনপ্রিয় সিরিজ।।
১৯৭৪ সালে জন্মগ্রহণ করা বিয়ার গ্রিলস হচ্ছেন যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বয়োকনিষ্ঠ চিফ
স্কাউট। তিনি ২০০৯ সালে চিফ স্কাউট হিসেবে নির্বাচিত হন।
অস্ট্রেলিয়া
স্কাউটস এর চিফ স্কাউট পদেও পদাধিকারবলে কেউ অধিষ্ঠিত নন। সেখানে ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ
কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ‘স্কাউট অস্ট্রেলিয়া’র ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট
দেশের গভর্নর জেনারেলকে দেশের চিফ স্কাউট পদ গ্রহণের আমন্ত্রণ জানান।
উল্লেখ্য, অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রপধান বৃটেনের রানী এবং রানীর পক্ষে সেখানে গভর্নর
জেনালের রাস্ট্রপ্রধান হিসেবে কাজ করেন। আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন, অস্ট্রেলিয়া
স্কাউটস-এ ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট এবং ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান দুটো
আলাদা পদ এবং দু’জন ব্যক্তি এ দু’টি পদে অধিষ্ঠিত
হন।
আমাদের
প্রতিবেশী ভারতে চিফ স্কাউট নামে কোন পদ নেই, বরং ভারতের ভাইস প্রেসিডেন্ট ভারত
স্কাউটস অ্যান্ড গাইড এর ‘চিফ প্যাট্রন’ হিসেবে অধিষ্ঠিত।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, ভারতের ভাইস প্রেসিডেন্ট তিনিই, যিনি ভারতের পার্লামেন্টের
উচ্চ কক্ষ রাজ্যসভার অধ্যক্ষ; তিনি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সেদেশে রাষ্ট্রপতিকে কোন
পদে আসীন করা হয়নি। বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ আমেরিকায় চিফ স্কাউট নামে কোন
পদ নেই। ভুটানেও চিফ স্কাউট নামে কোন পদ নেই রয়েছে ‘প্যাট্রন’- দেশের যুবরাজ এ পদে অধিষ্ঠিত; রাজাকে এ পদে মনোনয়ন দেয়া হয়নি।
নেপালের শিক্ষা ও ক্রীড়া মন্ত্রী হচ্ছেন সে দেশের ‘চিফ স্কাউট’। শ্রীলঙ্কায় ১৯৫৭ সালের ১৩
নং আইনে বলা হয়েছে দেশের প্রেসিডেন্ট স্কাউটস এর ‘প্যাট্রন’ হবেন, তিনি রাজী না হলে যিনি রাজী হবেন তেমন কাউকে এ পদে মনোনয়ন
দিতে পাবে স্কাউট কাউন্সিল।
প্রসঙ্গত
একটি বিষয়ে একটু আলোকপাত করা যেতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিফ স্কাউট
কমিশনারগণ (যে পদবীধারীই হোক না কেন- চিফ ন্যাশনাল কমিশনার, ন্যাশনাল কমিশনার, চিফ
স্কাউট কমিশনার ইত্যদি) শীর্ষ বৈঠকে
মিলিতি হন। যদি কোন এক শুভ লগ্নে বিভিন্ন দেশের চিফ স্কাউটগণ এমনি এক শীর্ষ বৈঠকে
বিশ্বের কোন এক স্থানে মিলিত হন, তখন আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতিকে বসতে যুক্তরাজ্যের
চিফ স্কাউট বিয়ার গ্রিলস এর সাথে- বিষয়টি রাষ্ট্রপতির জন্য কতটা সম্মানজনক হবে!
মোদ্দাকথা,
বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৮ (২) মোতাবেক “রাষ্ট্রপ্রধানরূপে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সকল ব্যক্তির ঊর্ধ্বে
স্থান লাভ করিবেন এবং ......”; তাঁকে দেশের অসংখ্য বেসরকারী সংগঠনের মধ্যে
একটি (যদিও সর্ববৃহৎ নিঃসন্দেহে) বাংলাদেশ স্কাউটস এর “চিফ স্কাউট” পদে বসিয়ে “জাতীয় স্কাউট
কাউন্সিল” এর সদস্য বানিয়ে “রাষ্ট্রপতি’র পদমর্যাদার যথাযথ সম্মান দেখানো হয়নি।
পাশাপাশি
একথা স্বীকার করতেই হয়, বহু দেশেই রাষ্ট্রপ্রধান (যে নামেই হোক না কেন-
প্রেসিডেন্ট, রাজা, রানী, গভর্নর জেনারেল) চিফ স্কাউট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আমাদের
দেশেও করছেন; তবে আমাদের দেশের সংবিধান এ পদে রাষ্ট্রপতির মনোনয়ন প্রক্রিয়া যথাযথ
নয়; যদিবা বিষয়টি নিয়ে আগে কখনোই ভাবা হয়নি। তাই, এ বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্টের রুল
জারির পরে যদি সরকার ইচ্ছে করেন, তবে
মহান জাতীয় সংসদে আইন পাশ করে রাষ্ট্রপতিকে দেশের চিফ স্কাউট হিসেবে মনোনীত করে
দায়িত্ব প্রদান করতে পারে এবং সেটাই হবে সংবিধান সম্মত।
আগামীতে: কেন সরকারী
কর্মকর্তাগণ পদাধিকারবলে স্কাউট সংগঠনের বিভিন্ন পদে থাকতে পারেন না............
চোখ রাখুন এই পাতায়।
এবিষয়ে প্রথম পর্ব দেখতে ভিজিট করুন: