বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

কিশোদের ভয়ংকর প্রতিবাদ ও কিছু কথা

কিশোদের ভয়ংকর প্রতিবাদ ও কিছু কথা
নুরুল্লাহ মাসুম

দৈনিক প্রথম আলোর অন্যতম প্রধান সংবাদে জানা গেল টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে ২০ জন কিশোর অভিনব এবং ভয়ংকর কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ করেছেমঙ্গলবার রাতে নিজেদের দেহ ধারালো বেস্নড জাতীয় অস্ত্রে এমনভাবে ক্ষত বিক্ষত করেছে কিশোররা যাতে তাদের মাথার তালু থেকে কপাল পর্যন্ত এবং কাঁধ থেকে দুই হাতের বাহু বরাবর নিচের দিকে লম্বা লম্বা করে কেটে গেছে এবং অঝোরে রক্ত ঝরছিল; তাদের রক্তে হাসপাতালের মেঝে ভেসে যাচ্ছিল২০ জনকেই সেলাই দিতে হয়েছেহাসপাতালে চিকিসক ও সেবিকাদের কিশোররা জানিয়েছে, তাদের ঠিকমতো খাবার না দেয়ায় এবং নির্যাতন করার প্রতিবাদ হিসেবে তারা এ কাজ করেছে
এই অভিনব ও ভয়ংকর প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের প্রচেষ্টা চালিয়েছে বলে মনে করা অযৌক্তি নয়তবে গতানুগতি ভাবে কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ বলেছে, এক কিশোরের কফ সিরাপ খাওয়া নিয়ে ঘটনার সূত্রপাতজানালার বা টিউবলাইটের ভাঙা কাচ দিয়ে তারা শরীর ক্ষতবিক্ষত করেছেপ্রথম আলো আরো জানাচ্ছে, টঙ্গী হাসপাতালের নথিপত্রে আহত কিশোরদের সবার নাম ও বয়স ১৪ থেকে ১৮ বছরের মধ্যেআইনি নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের নাম প্রকাশ করেনি পত্রিকাটি
উল্লেখিত কিশোরদের মধ্যে তিনজন কেন্দ্রের আবাসস্থলের তিনতলায়, বাকিরা পাঁচতলায় থাকেমঙ্গলবার রাত আটটায় রাতের খাবার খেয়ে তারা নিজেদের কক্ষে যায়; তারপরই ভয়ংকর এ ঘটনা ঘটেরাত ১১টার দিকে চিকার-চেঁচামেচি শুনে কেন্দ্রের দায়িত্বরত ব্যক্তিরা বিষয়টি জানতে পারেনপ্রথম আলো হাসপাতালের সেবক মো. সাখাওয়াত হোসেন এর উদ্বৃতি দিয়ে জানায় 'সবশেষে যে পুলাডারে আনল, ওর ঘাড়ে দুই ইঞ্চি কাটাপোয়া ইঞ্চি গভীর কাটা আধা ইঞ্চি ফাঁক অইয়া রইছেআমি সাথে সাথে ইএমওকে দেখাইস্যারে ওরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে রেফার্ড করে দেনতারপরও কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আমারে অনেক রিকোয়েস্ট করে কয়, 'সিলাই কইরা দেন'আমি রাজি হই নাইস্যাররে বলার পর সে বলছে, 'আমি এই রিস্ক নেব না'সাখাওয়াত আরও জানান, প্রত্যেকের শরীরের পাঁচ-ছয়টা করে জায়গায় কাটামাথা, দুই হাত ছাড়াও দু-একজনের পা এবং পেটেও কাটা ছিলতিন, চার, ছয় থেকে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা কাটাএক কিশোরের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওর কাঁধ থেকে হাতের কনুই পর্যন্ত প্রায় ১০ ইঞ্চি ফাড়া ছিল
এমন আরো অনেক মারাত্মক বর্ণনা রয়েছে প্রথম আলোর প্রতিবেদনেসেগুলো উল্লেখ করে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই নাকিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র মূলত কিশোর অপরাধীদের সংশোধন কেন্দ্রসরকারী অর্থে এ কেন্দ্রটি পরিচালিত হয়কিশোর বয়সের কারণে তাদের অপরাধ যতই মারত্মক হোক না কেন, সাধারণ কারাগারে না পাঠিয়ে এই কেন্দ্রে রেখে তাদের সংশোধনের ব্যবস্থা নেয়া হয়মনে রাখতে হবে কিশোর বয়সে তাদের খাবারের পরিমানটা বেশীই দরকার হয়খাবারের মানের বিষয়তো রয়েছেইএ কথা সকলেই জানে, সরকারী ব্যবস্থাপনায় এই কেন্দ্র বা কোন শিশু সদনেই খাবার মান ততোটা উন্নত নয়ফলে ওই কেন্দ্র বা সদনগুলোয় প্রতি বছর দুই ঈদ বা বিশেষ বিশেষ দিবসে 'উন্নত মানের খাবার' সরবরাহ করা হয়- একথা জাতীয় প্রচার মাধ্যমে ফলাও করে প্রচারও করা হয়এ থেকেই বোঝা যায় কেন্দ্র বা সদনগুলোয় সাভাবিক সময়ে খাবারের মান 'উন্নত' থাকে না
টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের কিশোররা খাবারের মান কতটা নিম্নমানের হলে প্রতিবাদের ভাষা এমন ভয়ংকর হতে পারে তা অনুমান করাটা খুব কষ্টসাধ্য বিষয় নয়কেবল খাবার নিম্নমান বলেই এমনটি হয়েছে তাও ধরে নেয়ার অবকাশ নেইকিশোররাই বলেছে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে, 'কফ সিরাপ' খাওয়া নিয়ে বাদানুবাদের কারণে এমনটি ঘটেছেপ্রশ্ন হলো 'কফ সিরাপ' এক ধরণের ওষুধ এবং তা বেশী পরিমানে খেলে মাদকতায় পেয়ে বসতে পারেএমন ওষুধ কিশোরদের কক্ষে থাকবে কেন? কেন কেন্দ্রের চিকিসা বিভগের কাছে থাকবে না? সাধারণ কারাগারগুলোয় কয়েদীদের নিয়ম করে ওষুধ কাওয়ানোর ব্যবস্থা থাকে, ওখানে নেই কেন? প্রতিবেদনে আরো জানা গেছে কোন এক কিশোরকে আদালতে আনা-নেয়ার সময় তার ভাই তাকে তা দিয়েছেতাই-ই যদি সত্য হয়, তাহলে তাদের হাতে মারাত্মক অস্ত্রও এভাবে আসতে পারেকর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আগে নজর দেননি কেন? সাদা চোখেই এটি তাদের দায়িত্ব অবহেলার পর্যায়ভুক্ত

আমরা আশা করবো, সরকারের দায়িত্বশীল মহল বিষয়টি নিয়ে ভাববেন এবং যাতে করে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রটি কিশোরদের জন্য সত্যিকারের সংশোধনাগার হয়ে ওঠে সেদিকে নজর দেবেনযে ঘটনা ঘটে গেছে সেটির সঠিক তথ্য উদঘাটনে আন্ত্মরিক প্রচেষ্টা নেবেন এবং এর পতিকার করবেনএক্ষেত্রেও যেন গতানুগতিক 'তদন্ত কমিটি' গঠিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে