উনিশতম পর্ব
গত সপ্তাহে
সুন্দরবনের ভেতরে শ্যালা নদীতে একটি তেলবাহী জাহাজ দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে ডুবে গেছে। নৌ-পথে নৌযান ডুবে
যাওয়া নতুন কিছু নয়। এবারের ঘটনাটা একটু ব্যতিক্রমধর্মী। উপকূলবর্তী নোনা পানির পরিবেশে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং অখন্ড ম্যানগ্রোভ
বনভ‚মি হিসেবে পরিচিত এই সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে নৌ-চলাচল নিষিদ্ধি। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের
ইউনেস্কো এ বনটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করে। এর ভেতর দিয়ে নৌ-চলাচল
নিষিদ্ধ থাকলেও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় বিশেষ ও জরুরী প্রয়োজনে নৌ-যান চলাচলের অনুমতি
দিয়েছিল, যদিবা পরিবেশ মন্ত্রণালয় বহুবার সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌ-চলাচল
বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। কে শোনে কার কথা! অবস্থা দৃষ্টে মনে হতে পারে পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ‘একই বাড়ির দুই সতিন’। পরিবেশ মন্ত্রণালয় পরিবেশ রক্ষার কথা বলছে, অন্যদিকে নৌ মন্ত্রণালয় মানুষের প্রয়োজনের কথা বলছে। শ্যালা নদীতে তেলবাহী
জাহাজ ডুবে যাবার পর সম্প্রতি নৌ পরিবহন মন্ত্রী এমনটাই বলেছেন।
ঘটনার
বর্ণনার কোন প্রয়োজন নেই,
কেননা দেশবাসী, তথা বিশ্ববাসী ইতোমধ্যে পুরো ঘটনা জেনে গেছেন; তারা আরো জেনেছেন, সরকারী সংস্থাগুলো
পানি থেকে তেল অপসারণে ব্যর্থ হয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের সহায়তায় গতানুগতিক পন্থায় তেল
অপসারণের উদ্যোগ নিয়েছে। ডিজিটাল যুগে আদী পন্থায় কাজ করাটা তেমন সুখের হবার কথা নয়। পরিবেশ মন্ত্রণালয়
এবং পরিবেশবাদীদের ক্রমাগত আবেদন নিবেদন সত্তে¡ও কেন এবং কার স্বার্থে নিষিদ্ধ নৌপথে নৌ চলাচলের অনুমতি দিল, সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন
এবং বিস্ময়ও বটে! যেখানে সাধারণ নৌ চলাচল করার কথা নয়, সেখানে তেলবাহী জাহাজ কেন চলবে। বিকল্প পথ হিসেবে যে
কোন সময়ে এ পথ ব্যবহৃত হতে পারে;
এর অর্থ এই নয় যে, নিয়মিত রুট সংস্কারের কাজ না হওয়ায় ‘বিকল্প পথ’-ই হয়ে উঠবে নিয়মিত পথ। উপরন্ত জানা গেছে, ডুবে যাওয়া জাহাজটি মূলত তেলবাহী জাহাজ নয়, ওটা ছিল মোডিফাইড জাহাজ। আরো বিস্ময়ের বিষয়
হলো- পরিবেশের জন্য মারাত্মক এই দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন
কোন কর্তাব্যক্তি ঘটনাস্থাল পরিদর্শন করনে নি। পরিবেশ মন্ত্রী ঘটনার
সয়ম পেরুতে পরিবেশ সম্মেলন নিয়ে ব্যস্ত। এমন একটা ঘটনা উন্নত বিশ্বের কথা বাদ দিয়েও বলা যায়, প্রতিবেশী ভারতে ঘটলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী সফর বাতিল করে দেশে
ফিরে আসতেন। আমাদের দেশে এমনটি হওয়ার কোন সুযোগ (!) নেই। নৌ পরিবহন মন্ত্রী
তো বলেই দিলেন বিশেষজ্ঞের মতো করে- ফার্নেস
অয়েলে সুন্দরবনের কোন ক্ষতি হবে না!
ঘটনার
পর থেকে টেলিভিশন টক শো গুলোয় কথার ঝড় বইছে। নানান মুনির নানান মত। কেউ তীব্র ভাষায় সরকারের
সমালোচনা করছেন, কেউ বা একটু নরম সুরে। তবে সকলেই ঘটনার দীর্ঘমেয়াদী
ক্ষতির কথা মেনে নিচ্ছেন। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা নিজেদের গা বাঁচিয়ে কথা বলছেন। কথায় কথায় প্রধান-মন্ত্রীর
তরিৎ সিদ্ধান্তে কথার রেফারেন্স দিয়ে নিজের চেয়ার ঠিক রাখার প্রাণান্ত
চেষ্টা করে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য নিয়মিত নৌপথ দ্রুত চালু করার তাগিদ দিয়েছেন, তবে সুন্দবনের ভেতর দিয়ে নৌ চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেন নি; এমন কি এটি ব্যবহারে কৃচ্ছতা অবলম্বনের কথাও তারা বলছেন না।
সুন্দরবন-
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতে এর অংশ রয়েছে,
সেখানে নৌ চলাচলের অনুমতি নেই; আমাদের এখানে থাকবে কেন? একশত নটিক্যাল মাইল
ঘুরে যেতে হলে যে ক্ষতি হবে, এ পথটি অবিলম্বে বন্ধ
করে দেয়া না হলে দেশের ক্ষতির পরিমান আরো বেশী হবে; তাই এ পথে অবিলম্বে
নৌ চলাচল বন্ধ করা একান্ত জরুরী।
১৯-১২-২০১৪