রবিবার, ৭ মে, ২০১৭

পুরানখ্যাত করতোয়া তীরে- দ্বিতীয় পর্ব

পুরানখ্যাত করতোয়া তীরে- দ্বিতীয় পর্ব

নুরুল্লাহ মাসুম

করতোয়ার উপর সেতুতে ডা. নিমোর সাথে লেখক

১২ এপ্রিল। হাসনাইন ভাইয়ের স্ত্রী- ভাবী সকাল সকাল আমার জন্য খাবার তৈরী করলেন। উকিল সাহেবকে আদালতে যেতে হবে। একসাথে আহার পর্ব শেষ করে, ভাবী ও বাচ্চাদের বিদায় জানালাম।
এরপরের গল্পকথা অন্য বিষয়ে। এবারে ভিজুয়ালাইজ হবেন শাকিল ও নিমো। সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে সাক্ষাৎ মিললো তাদের। শাকিল বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শ্রেণীর ছাত্র। আর নিমো হচ্ছেন একজন চিকিৎসক, পুরো নাম নাইমা খালেক। পেশায় চিকিৎসক হলেও প্র্যাকটিস করেন না বা কোনো চাকুরী করেন না। রংপুরের সংস্কৃতি অঙ্গনে অতি পরিচিত নাম; সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন সংস্কৃতি ও সমাজ সেবা নিয়ে। তার সাথে কথা হয়েছিল আজ পুরাণখ্যাত পূণ্যতোয়া করতোয়া নদ দেখাতে নিয়ে যাবেন। যেই কথা সেই কাজ। নিজে গাড়ী চালান। চালক হিসেবে খুবই দূর্দান্ত তিনি। গান গাইতে পারেন বেশ। তবে দুঃখের গান শোনেন বেশী। তবে কি তার জীবনটা দুঃখে ভরা!
রংপুরের রসুলপুর- এক বর্ধিষ্ণু অঞ্চল, একসময়ের নামকরা জমিদারী। সেই জমিদার বাড়ির সন্তান ডা. নাইমা খালেক। নিজেকে নিমো নামে পরিচয় দিতে সাচ্ছন্দবোধ করেন।
ফাইন্ডিং নিমো নামে একটি মুভি রয়েছ- ওয়াল্ট ডিজনি প্রযোজিত; যা অ্যানিমেশন স্টুডিওতে নির্মিত একটি কম্পিউটার এ্যানিমেটেড কমেডি, ড্রামা ও অ্যাডভেঞ্চারধর্মী চলচ্চিত্র। ২০০৩ সালে মুক্তি পায়এর পুরো কাহিনী আবর্তিত হয় নিমো নামের একটি ছোট্ট কৌতূহলপ্রবণ শিশু ক্লাউনফিশকে ঘিরে, যার অতিরক্ষণশীল বাবা মার্লিন, ডোরি নামের একটি নীল সার্জনফিশকে সাথে নিয়ে তার অপহৃত পুত্রসন্তানকে সিডনি বন্দরের পথে খুঁজে বেড়ায়এর মাঝেই মার্লিন তার সন্তানের ঝুঁকিকে সহজভাবে নিতে শেখে এবং নিমোকে নিজের খেয়াল রাখতে দেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয় ছবিটি ২০১২ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর থ্রিডি ফরমেটে দ্বিতীয়বার মুক্তি পায় এবং ৪ ডিসেম্বর ডিভিডিতে বাজারে আসেসমালোচকদের কাছ থেকে ব্যাপকভাবে প্রশংসা পাওয়া এ ছবিটি একাডেমী এওয়ার্ডে সেরা অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র বিভাগে পুরষ্কার এবং বেস্ট স্ক্রিনিং বিভাগেও মনোনীত হয়২০০৩ সালে সর্বোচ্চ আয় করা চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে এটির অবস্থান দ্বিতীয়এছাড়াও সর্বকালের সবচেয়ে বেশি ডিভিডি কপি বিক্রির গৌরবও এই ছবিটির অর্জনের ঝুলিতে রয়েছে
তবে কি আলোচ্য ডা. নাইমা নিজেকে ফাইন্ডিং নিমোর নিমোর মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায়!
নাইমার পিতা শাহ আব্দুল খালেকো ছিলেন সমাজসেবী। তিনি রেড ক্রিসেন্টের জীবন সদস্য ছিলেন। এছাড়া রংপুর চেম্বারসহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে যুক্ত ছিলেন। নাইমার দাদা খন্দকার শাহ আব্দুর রউফ ছিলেন আইন এপশায় যুক্ত এবং রংপুরের পিপি ছিলেন। তাঁর বাবা শাহ কলিম উদ্দিনও আইনজীবী ছিলেন। নাইমার মা নিলুফার খালেক রংপুর রেড ক্রিসেন্ট, লেডিস ক্লাব রংপুর অটিস্টিক ফাউন্ডেশনসহ বহু সংগঠনে যুক্ত ছিলেন। তাঁর বাবা এমদাদ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমএলএ)। তাঁর বাবা (নাইমার মায়ের দাদা) খান বন্দে আলী মিয়া ছিলেন রসুলপুরের জমিদার।

করতোয়ার উপর সেতুতে লেখক

নাইমাকে নিয়ে এত কথা বলার কারণ, প্রথম দর্শনেই তাঁর ভেতরে একটা আভিজাত্যের ছাপ লক্ষ্য করেছিলাম- চলনে এবং বলনে। আগেই বলেছি, চালক হিসেবে তিনি দূর্দান্ত প্রকৃতির। ভাল গাইতেও পারেন। সংস্কৃতিসেবী হওয়ায় তার পরিচয়র পরিধি বেশ। কবিতাও লেখেন- ভাল আবৃত্তি করেন। তার কবিতায় কষ্টের ছোঁয়া একটু বেশী বলেই মনে হলো।

(৩)
রংপুর শহর ছেড়ে নিমোর গাড়ী ছুটে চলছে ঢাকা মহাসড়ক ধরে। হঠাৎ করেই গাড়ী মোড় ঘুরলো দিনাজপুরের দিকে- রংপুর-ফুলবাড়ী সড়কে। রাস্তার দুই ধারে সবুজ গাছের সমারোহ, তারও পরে বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত- রয়েছ ধান, ভুট্টা ক্ষেত। যতদূর দৃষ্টি যায়, ততদূর সবুজ আর সবুজ- অসম্ভব সুন্দর। মাঝে মধ্যে বড় বড় দু-চারটা বিশাল বৃক্ষ নিজেদর উপস্থিতি জানা দিচ্ছে। কখনও কখনও দৃষ্টির সীমায় ধরা দিচ্ছে পল্লীর ঘর- নিজস্ব বৈচিত্র্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চলার পথে অনেক নদী- ছোট-বড় অতিক্রম করলাম কালভার্ট বা সেতুর কল্যাণে। নিমো জানালেন কোনটার নাম যমুনেশ্বরী, কোনোটা বা তিস্তার শাখা... সবগুলোর নাম তারও জানার কথা নয়। এ কারণেই করতোয়া নদী নিয় একটু ঘেঁটে দেখতে হলো ঢাকায় ফিরে-
এক সময় করতোয়া ছিল তিস্তা নদীর প্রধান ধারাআড়াই হাজার বছর আগে প্রাচীন বাংলার রাজধানী বগুড়ার ঐতিহাসিক মহাস্থানগড় এই নদীর তীরেই অবস্থিত ছিলকরতোয়া নদীর নামকরণ নিয়ে একটি পৌরাণিক কিংবদন্তি আছেকর অর্থ হাত, আর তোয়া অর্থ জলহিন্দু দেবতা শিব হিমালয় পর্বতকন্যা পার্বতীকে বিয়ে করেনবিয়ের অনুষ্ঠানে শিবের হাতে (কর) যে জল (তোয়া) ঢালা হয় সেই পানি নিঃসৃত হয়ে করতোয়া নদীর সৃষ্টিমহাভারতের বনপর্বের তীর্থযাত্রা অধ্যায়ে করতোয়া পুণ্যতোয়া নামে অভিহিতপুণ্য অর্থ পবিত্র, তোয়া অর্থ জলঅর্থাৎ প্রাচীনকালে করতোয়ার জলকে অতি পবিত্র বিবেচনা করা হতোএই নদীর পবিত্রতা সম্বন্ধে করতোয়া মাহাত্মা নামে প্রাচীন গ্রন্থ আছে, যেখানে এই নদীর প্রাচীন সমৃদ্ধির পরিচয় মেলে১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজির বাংলা অভিযানকালে এই নদী গঙ্গা নদীর চেয়ে তিন গুণ বড় ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছেবিস্তার ক্ষয়ে যাওয়া পুরোনো গতিপ্রবাহই আজকের করতোয়া, যা পাঁচটি অংশে বিভক্ত হয়েছেযথা- দিনাজপুর-করতোয়া, আত্রাই, রংপুর-করতোয়া, বগুড়া-করতোয়া, পাবনা-করতোয়াএই পাঁচটি করতোয়া ছাড়াও উত্তরবঙ্গের ছোট ছোট অনেক নদী করতোয়া নামে অভিহিত হতে দেখা যায়এই নদীর মোট দৈর্ঘ্য ৫৯৭ কিলোমিটারউত্তরবঙ্গের বিভিন্ন শহর এই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছেভুটান সীমান্তের উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা থেকে উৎপন্ন হয়ে করতোয়া বিভিন্ন উপ-নদীর জলধারা বুকে ধারণ করে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেএখানে বৃহত্তর রংপুর-পাবনা জেলার মধ্য দিয়ে রংপুরের প্রায় ১৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে কতিপয় জলধারার সংযোগে সৃষ্ট নতুন উৎসমুখ থেকে আনুমানিক ২৪২ কিলোমিটার দক্ষিণে ইছামতি নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছেউত্তরতম প্রবাহে এর নাম তিস্তা; এই তিস্তার জলধারা তিনটি খাতে প্রবাহিত হতো- করতোয়া, আত্রাই, পুনর্ভবাকরতোয় নদী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলায় উপত্তি লাভ করেছে এই নদীর জলধারা বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার তেতুলিয়া উপজেলার ভোজনপুর ইউনিয়ন দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং দিনাজপুর সদর উপজেলার সরকারপুর ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে আত্রাই নদীতে পতিত হয়েছে করতোয়া প্রধানত রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের অন্তর্গত একটি ছোট নদী যা একসময় একটি বড় ও পবিত্র নদী ছিলএর একটি গতিপথ, বর্তমানে যেটির নাম করতোয়া নিম্ন নদী, বগুড়া জেলার মহাস্থানগড় দিয়ে প্রবাহমানকরতোয়া মাহাত্ম্য-এর অতীত ঐতিহ্যের প্রমাণ করে মহাভারতে বলা আছে, তিনদিন উপবাসের পর করতোয়া নদীতে ভ্রমণ করা অশ্বমেধা (ঘোড়া বলিদান) এর সমান পূণ্যের সমান 
করতোয়া নিম্ন নদী বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া  গাইবান্ধা জেলার একটি নদীনদীটির দৈর্ঘ্য ১২২ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১৪৪ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকারবন্যাপ্রবণ নদীটির প্রবাহের প্রকৃতি বারোমাসি এবং নদীতে জোয়ারভাটার প্রভাব নেইকরতোয়া নিম্ন নদীটি রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার মিলনপুর ইউনিয়নে প্রবহমান দেওনাই-চাড়ালকাটা-যমুনেশ্বরী নদী থেকে উৎপত্তি লাভ করেছেএই নদী ক্রমান্বয়ে মিঠাপুকুর,  নবাবগঞ্জ,  পীরগঞ্জ,  ঘোড়াঘাট,  পলাশবাড়ী,  গোবিন্দগঞ্জ, শিবগঞ্জ, বগুড়া সদর, শাজাহানপুর  শেরপুর উপজেলায় পৌঁছেছেএই নদীর জলধারা বগুড়া জেলার উক্ত উপজেলার খানপুর ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে বাঙালি নদীতে নিপতিত হয়েছে
পূণ্যতোয়া করতোয়ার ওপর নিমোর গাড়ী থামলো- নদীর ওপর মানে নদীর ওপর সেতুতে। বেশ চওড়া সেতু। করতোয়ার অবস্থা খুবই শোচনীয়। নদীর তলদেশ এতটাই নিকটে যে, শ্যাওলা পরিস্কার দৃশ্যমান। পরিস্কার পানি। এক সময়ের প্রমত্তা করতোয়ার জীর্ণ দশা দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়। ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজির বাংলা অভিযানকালে করতোয়া এমনটা থাকলে তার বঙ্গবিজয় আরো সহজ হতে পরতো। মূলত দেখার মতো নেই এখনকার করতোয়া। ইতিহাস জানা থাকলেই কেবল করতোয়া উপলব্ধি করা সম্ভব। প্রায় ঘন্টাখানেক সময় কাটালাম সেখানে- সেতুর উপর। শাকিলের হাতে ক্যামেরা ক্লিক-ক্লিক শব্দ করেই চলেছে। আমি নদীর দূরাবস্থার কয়েকটা ছবি তুললাম।

করতোয়ার গভীরতা এতটাই কম যে, তলদেশের শ্যাওলা দৃশ্যমান

(৪)
ফেরার পালা। চায়ের তেষ্টা যেমন পেয়েছে, তেমনি প্রচন্ড গরমে নিমোর পেল ঠান্ডা পানির তেষ্টা। ফিরতি পথে গাড়ী থামিয়ে ঠান্ডা পানি সংগ্রহ করা হলো। নিমো কিছুটা পানি মাথায় ঠেলে নিয়ে বাকীটা পান করলো। শাকিল অবাক হলো- আমি ঠান্ডা পানি পান করি না শুনে। আরো খানিকটা সময় পার করে, পথের দুধারে শালবন অতিক্রম করে নিমোর গাড়ী থামলো। আমরা ঠাঁই নিলাম মা-বাবা নামের একটা রেস্টুরেন্টে। স্থানটা দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার মধ্যপাড়া এলাকার ভাদুরী বাজারে। জল-খাবারের মাঝেই ঠিক হলো আমরা মধ্যপাড়া কিঠন শিলা প্রকল্প দেখতে যাবো। যদিবা এটা জানাছিলো, পূর্বানুমতি ছাড়া এ প্রকল্প এলাকায় প্রবেশ সম্ভব নয়। নিমো বললেন, চেষ্টা তো করে দেখি, পারলে দেখবো, না হলে ফিরে আসবো- আগো তো যাই। চমৎকার কঠিন মনোভাব। আমার বেশ পছন্দ হলো। গাড়ী ছুটে চললো মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্পের পথে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রকল্পের গেটে আটকে দেয়া হলো। আমাদের জানানো হলো, অফিস থেকে অনুমোদন নিতে হবে। ভাবনায় ফেলে দিলো আমাদের। নিমো এবং শাকিল ভাবতে শুরু করলো, ভেতরে রংপুরের কেউ আছেন কি না। এমন সময়ে আমরা দেখা পেলাম দৈনিক ইনকিলাব-এর পার্বতীপুর উপজেলা প্রতিনিধ এম এ জলিল সরকারের সাথে। তিনি নিমোর পরিচয় পেয়ে জানালেন একজনের কথা, যাকে বললে ভেতরে যাবার অনুমতি মিলতে পারে। জলিল সাহেবই ফোন করে কথা বলে নিমোকে দিলেন। কথা হলো এবং ভেতরে যাবার অনুমতি মিললো। জলিল সাহেবকে গাড়ীতে তুলে নেয়া হলো। দেশের একমাত্র কঠিন শিলা প্রকল্প দেখতে ধীরে ধীরে গাড়ী চললো প্রকল্পের সংরক্ষিত এলকার ভেতরে।
যার কল্যাণে এ প্রকল্প এলকায় প্রবেশের অনুমতি পেলাম, তিনি সৈয়দ রাফিজুল ইসলাম- প্রকল্পের অন্যতম ব্যবস্থাপক। প্রথমে তার দপ্তরেই আলাপ হলো। রংপুরের সন্তান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। রেড ক্রিসেন্টের জীবন সদস্য। নিমোর সাথে নানান বিষয়ে আলোচনা করলেন। আমি অভ্যাগত- কেবল শুনছিলাম। মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম কঠিন শিলা প্রকল্পের ইতিবৃত্তি। একপর্যায়ে তিনি আমাদের সাথে বের হলেন প্রকল্প এলাকা ঘুরিয়ে দেখাতে।
সংক্ষেপে জেনে নেই এই পকল্পের কিছু কথা।

মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্প এলাকা 

১৯৭৪-৭৫ সালে  বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর দিনাজপুর জেলার মধ্যপাড়া ও সংলগ্ন এলাকায় ছয়টি কূপ খনন করে এবং ভূ-পৃষ্ঠের অতি অল্প গভীরতায় পুরাজীবীয় যুগের কেলাসিত ভিত্তিস্তরে কঠিন শিলার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়এ সকল কূপে ভূ-পৃষ্ঠের ১২৮ মিটার থেকে ১৫৪ মিটার গভীরতায় পুরাজীবীয় কঠিন শিলা পাওয় যায়বাংলাদেশ সরকার মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনন ও উত্তোলন প্রকল্পের কারিগরি ও অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করার লক্ষ্যে এসএনসি নামক কানাডীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করে১৯৭৭ সালে সমীক্ষা শেষে এসএনসি প্রকল্প কারিগরি এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে নিরাপদ এবং লাভজনক হবে বলে মত প্রকাশ করে১৯৭৮ সালে সরকার কঠিন শিলা উৎপাদনের লক্ষ্যে মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি প্রকল্প অনুমোদন করে অর্থায়নের জন্য ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সরকার উত্তর কোরিয়া সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেবাংলাদেশ সরকারের পক্ষে  পেট্রোবাংলা এবং উত্তর কোরিয়া সরকারের পক্ষে ন্যাম ন্যাম নামক কোম্পানি চুক্তি স্বাক্ষর করেচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ১৯৯৪ সালের প্রথমদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্পটির কার্যক্রম শুরু হয়
মধ্যপাড়া ভূগর্ভস্থ কঠিন শিলা প্রকল্প প্রায় ১.৪৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃতকঠিন শিলা খনন করা হয় রুম অ্যান্ড পিলার এবং সাব লেভেল স্টোপিং পদ্ধতিতেখনি স্থাপনের জন্য ২৪০ মিটার ব্যবধানে পাঁচ মিটার ব্যাস বিশিষ্ট দুটি খাড়া সুড়ঙ্গ পথ নির্মাণ করা হয়একটি সুড়ঙ্গ পথ মালামাল, যন্ত্রপাতি ও শ্রমিক পরিবহণের জন্য ব্যবহৃত হয়, যার গভীরতা ২৪৩ মিটার এবং অপর সুড়ঙ্গ পথটি ব্যবহৃত হয় কঠিন শিলা পরিবহণে যার গভীরতা ২৮৭ মিটারকেলাসিত ভিত্তিস্তরের উপর ১০০ মিটার থেকে ১৩০ মিটার পুরুত্বের  ডুপি টিলা স্তরসমষ্টি অবস্থান করায় এর মধ্য দিয়ে সুড়ঙ্গ পথ বা শ্যাফট নির্মাণ করতে গিয়ে ব্যয়সাপেক্ষ বিশেষ পদ্ধতি তথা বরফীকরণ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়ভূ-পৃষ্ঠের নিচে ১৭০ মিটার থেকে ২৩০ মিটার গভীরতা থেকে কঠিন শিলা আহরণ করা হয়মধ্যপাড়া কঠিন শিলার প্রাক্কলিত মজুতের পরিমাণ ১৭২ মিলিয়ন টন এবং উত্তোলনযোগ্য মজুত প্রায় ৭২ মিলিয়ন টনমধ্যপাড়ার এইসব কঠিন শিলা মূলত নাইস, গ্রানোডায়োরাইট এবং কোয়ার্টজ ডায়োরাইটসহযোগে সৃষ্ট
উত্তর কোরীয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ন্যামন্যাম মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও পাথর উৎপাদনে আশানুরুপ গতি আনতে না পারায় তার পরিবর্তে বেলারুশের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জার্মানীয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়ামকে খনির উৎপাদন, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়এজন্য ২০১৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটির সাথে ১,৪০০ কোটি টাকা মূল্যে ৬ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় চুক্তি অনুযায়ী কোরীয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের রেখে যাওয়া যন্ত্রপাতি দিয়ে তারা নতুন উদ্যোমে পাথর উত্তোলন শুরু করেপ্রথম দিকে তারা এক শিফটে, পরবর্তীতে দুই শিফটে ও সবশেষে তিন শিফটে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার মেট্রিকটন পাথর উত্তোলন করতে থাকেসময়মত নতুন যন্ত্রপাতি আনতে না পারায় খনির পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এর দায়ভার নিয়ে খনি কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চলছে রশি টানাটানি
প্রচন্ড রোদ, রাফিজুল ইসলাম আমাদের ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন। অনেক যন্ত্র অব্যবহৃত অবস্থায় দেখতে পেলাম। নতুন কিছু যন্ত্রও দেখা গেল। হয়তো বা শীঘ্রই প্রকল্পে পাথর উত্তোলন শুরু হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করলেন।
এর ফাঁকে আরেকটা কথা বলে রাখা ভাল। আমার ঢাকা ফেরার নির্ধারিত সময় ছিল দুপুর ১২টা। ডা. নিমোর এই অভিযানের ফলে ১২টা বাস ধরা যাবে বলে সন্দেহ দেখা দিল। কথাটা তাকে জানাতে আমার টিকেটের ডিটেইলস নিয়ে ফোন তুললেন। আমার টিকেট ছিলো এস আর পরিবহনে। নিমো সেখানে ফোন করে আমার টিকেট বাতিল করতে এবং অন্য কোন পরিবহনে ৩টা বা তার পরে টিকেট কাটার জন্য নির্দশনা দিলো। ১৫-২০ মিনিট পরে জানা গেল, বিকাল ৩টায় অন্য এক পরিবহনে আমার টিকেট কনফার্ম করা হয়ে গেছে। জানতে পারলাম, এস আর পরিবহন-এর মালিক তার এক ভগ্নিপতি।
রাফিজুল ভাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে এবং জলিল সরকারকে সাধে নিয়ে প্রকল্প এলাকা থেকে বের হয়ে এলাম। জলিল সাহেব গেটে নেমে গেলেন, তার অন্য কোনো প্রোগ্রাম রয়েছে। আমরা ফিরে চললাম রংপুরের পথে।

পূণ্যতোয়া করতোয়া... আজো বয়ে চলে... 

(৫)
ফিরতি পথে ঢাকা মহাসড়কের কোন একস্থানে গাড়ী থেমে গেল। ছোটখাটো এক রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা হলো। জানা গেল নিমো এখানে প্রায়শই যাতায়াত করে থাকে। পথনির্ভর ভ্রমণকারীর জন্য এর থেকে ভাল গন্তব্য আর কি হতে পারে?
গরমে ঘেমে ভিজে-নেয়ে একাকার হয়ে হন্তদন্ত হয়ে শহরের দিকে ফেরার প্রস্তুতি। সময় বয়ে চলেছে- ঢাকাগামী বাস ধরতে হবে। চালকের আসনে আগের মতই নাইমা নিমো। পেছনের আসনে বসে দু’চারটা কথা হলো। কাব্যলোকের পরবর্থী আয়োজন গ্রীষ্মের কবিতায় তার কবিতা দেবার কথা আদায় করা হলো। অনুরোধ রইলো কালেবশেখীর মতো ছুটে বেড়ানোর পাশাপাশি স্বীয় পেশায় কিছুটা হলেও সময় দেবার। বুদ্ধিদীপ্ত মানুষটি আর কোন কথা দিলেন না।
মিটিট পাঁচেক আগেই আমরা পৌঁছে যাই বাসস্ট্যান্ডে- যদিবা এজন্য তাকে কিছুটা বেশী পথ অতিক্রম করতে হয়েছে যানজট এড়ানোর জন্য। সঙ্গত কারণে গাড়ী ছুটেঠে তীব্র গতিতে- চালক যখন বলিষ্ঠ, তখন ভীতির কারণ থাকতে পারে না। তবু সতর্কতা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ, এটা মানতেই হবে।
নিমো আর শাকিলের বিদায়ে পালা- শেষ কথা: জীবনশূখী হতে হবে, নইলে রসুলপুরের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে সমর্থন জানান নিমো। এরপর খানিকটা অপেক্ষার পালা- বাস ছাড়ার জন্য।
তপ্ত দুপুরে কালো পিচঢালা পথ ধরে এগিয়ে চলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ী; আসনটাকে সামান্য পেছনে হেলিয়ে আরামদায়ক অবস্থান নেয়ার প্রচেষ্টা.... মগেজ তখন গত দুদিনের চিত্রগুলো চলমান হয়ে ওঠে তৃতীয় নয়নে যা দেখা দেয় ক্রমাগত।
না, ফিরতি ভ্রমণটা আরামদায়ক হয় নি মোটেও। ঢাকায় ফিরেছি মধ্যরাতের পরে- কল্যাণপুরে পা রাখার সময় ঘড়িতে সময় রাত দুটো অতিক্রম করেছে।
শেষ