বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৩

শবের মিছিল আর কত দীর্ঘ হলে আমরা মানুষ হবো?: এত মৃত্যুর দায়ভার কে নেবে

শবের মিছিল আর কত দীর্ঘ হলে আমরা মানুষ হবো?

এত মৃত্যুর দায়ভার কে নেবে

নুরুল্লাহ মাসুম

আবারো লাশের মিছিল! এক, দুই, তিন নয় শত শতলাশের প্রাথমিক আবাস হয় এনাম মেডিকেলের লাশ ঘরে, তারপরে হাসপাতালের ওয়ার্ডে, তারও পরে বরান্দায়- সবশেষে গ্যারেজেনা, তাতেও কুলোয়নিহাসপাতালের গন্ডি ছাড়িয়ে লাশদের জায়গা হয় পার্শবর্তী অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ের বারান্দায়সব জায়গাতেই লাশের উত্তরাধিকারদরে আহাজারি, আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়; চোখে জল আসে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী সেনা সদস্যদেরও- তারাওতো মানুষদমকল বাহিনীর সদস্যরা হামেসাই এমন দৃশ্য দেখে তাকে, বরা যায় লাশ আর ধ্বংসস্তুপের মাঝেই তাদের বসবাস
একবার মনে হচ্ছিল, প্রয়াত অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর কবরনাটকে যেভাবে লাশের আগমন ঘটে, সেই বর্ণনার সাথে তুল্যমান হতে পারে; ভেবে দেখলাম মুনীর চৌধুরী হয়তো ভাবতেও পারতেন না, এভাবে লাশের মিছিল হতে পারেতাঁর ভাবনার একটা গন্ডি ছিল- দুই, চার, ছয়....বাস্তবে বুধবার দেশবাসী যা দেখলো তা মুনীর চৌধুরীর সেই ভাবনা ছাপিয়ে, এমনকি স্মৃতিতে এখনো উজ্জল আশুলিয়ার তাজরিন গার্মন্টেসের লাশের মিছিলকেও ছাড়িয়ে গেল এবারেএ নিবন্ধ যখন লেখা হচ্ছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা আটটা পর্যন্ত সাভারের রানা প্লাজা ধ্বসের কারণে মৃতের সংখ্যা ২৩০ জনভবনে আটকে থাকা দুই হাজার জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে
ঢাকার অদূরে সাভারে রানা প্লাজা নামের আট তলা ঐ ভবনের তৃতীয় তলার নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেড, চতুর্থ তলার প্যান্টম এ্যাপারেলস লিমিটেড, পঞ্চম তলার প্যান্টম ট্যাক লিমিটেড ও ষষ্ঠ তলার ঈথার টেক্সটাইল লিমিটেডে পাঁচ থেকে ছয় হাজার শ্রমিক কাজ করতো বলে জানা গেছেনীচের তলা গুলোয় ব্যাংক ও মার্কেট ছিলহরতাল তাকায় মার্কেট ছিল বন্ধ, না হলে হতাহতের সংখ্যা আরো বাড়তোভবনটিতে আগেই ফাটল দেখা দেয়ায় ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়প্রকৌশলীদের নিষেধাজ্ঞা সত্তে¡ও ভবন মালিকের আশ্বাসে গার্মেন্ট মালিকরা কারখানা খোলা রাখেধ্বংসযজ্ঞের ভেতর থেকে উদ্ধার পাওয়া আহত কর্মীরা জানিয়েছেন প্রকাশ্যে- কারখানার মালিকপক্ষের লোকজন জোর করে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করেশ্রমিকরাও জানতো ভবণে ফাটল ধরার কথাকারখানা মালিকদের আশ্বাস দিয়েছিলেন ভবনের মালিক, স্থানীয় যুবলীগ নেতাফাটল আসলে ভবনে নয়, পলেস্তায়- এমন কথা তিনি বেসরকারী টেলিভিশন ক্যামেরার সামনেই বলেছেন
খবরে প্রকাশ, ভবন মালিকও দুর্ঘটনার সময় ভবনের নীচ তলাতে অবস্থান করছিলেনএ সংক্রান্ত পত্রিকার খবর এমন- বুধবার সাভারের বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বহুতল ভবন রানা প্লাজার মালিক স্থানীয় যুবলীগ নেতা মো. সোহেল রানাও ভবনটি ধ্বসের সময় নিচতলা ছিলেনজনতার রোষানলে পড়ার ভয়ে তিনি বের হতে না পেরে স্থানীয় সাংসদসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের খবর দেনপরে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সাংসদ তৌহিদ জং মুরাদ ঘটনাস্থলে গিয়ে ভবন মালিক রানাকে বের করে নিয়ে যানভবন ধ্বসে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটলেও সোহেল রানা আঘাত পাননি বলে জানান ঘটনাস্থলে রানার সঙ্গে থাকা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এডভোকেট মাসুদ চৌধুরী
মঙ্গলবার বিকেলেই ভবনটিতে বড় ধরণের ফাটল দেখা দিলে ভবন মালিক সাভার পৌর যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক মো. সোহেল রানা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ভবনের বড় ধরনের কোন তি হয়নিসামান্য একটু প্লাস্টার খসে পড়েছেএটা তেমন কিছু নাযদিও স্থানীয় প্রকৌশলী আব্দুর রাজ্জাক ভবন ঘুরে দেখে বলেছিলেন, ভবনের নিরাপত্তার স্বার্থে বুয়েট থেকে প্রকৌশলী এনে পরীক্ষা করা প্রয়োজন, তা না হলে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারেবুধবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে নয় তলা ভবনটি ধসে পড়ে বহু মানুষ হতাহত হয়ওই ভবনে চারটি তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে, যেখানে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক কাজ করেধ্বসের সময় কারাখানায় কাজ চলছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম বলছে, ভবনটি নির্মান করা হয়েছিল একটি পুকুর ভরাট করেএমনও শোন গেছে ভবনটির নকশা অনুমোদন করেছে সাভার পৌরসভারাজউক বলছে তাদের অনুমতি না নিয়েই পৌরসভা ভবনটির নকশার অনুমোদন দিয়েছেসংগত কারণে ধরে নেয়া যায়, অনুমোদন দেয়ার আগে পৌরসভার প্রকৌশলী সয়েল টেস্ট করেননি যথাযথভাবেঅথবা এমনও হতে পারে, রাজনৈতিক চাপের কারণে পৌরসভারও হয়তবা তেমন কিছু করার ছিলনাকারণ যা হোক, ভবন মালিক এ দুর্ঘটনার দায় এড়াতে পারেন নাতেমনি সাভার পৌর কর্তৃপক্ষ এবং এমনকি রাজউকও এর দায়িত্ব এড়াতে পারে নারাজধানীর এতকাছে, গুরুত্বপূর্ণ শিল্প এলাকা সাভার, সেখানে ভবন নির্মানে তাদের কোন দায়িত্ব নেই এমনাটাতে ভাবা যায় নাএমনও শোন যাচ্ছে, ভবন মালিক নাকি বলেছেন, একটা পিলার ফাটলে কিছু হয় নাপ্রকৌশলীদের চেয়ে তিনি বেশী বুঝেছিলেন বলেই এমন দুর্ঘটনা
শ্রমিকদের আপত্তির মুখেও তাদের জোর করে, কারো কারো ভাষ্যমতে পিটিয়ে কাজে যোগদানে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়ার জন্য কারখানার মালিকরাও দায়ী; তাদেরকে সকলের আগে বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করাতে হবেভবন মালিক ক্ষমতাসীন দলের বলেই নিয়ম ভেঙ্গে চাঁচ তরা ফাউন্ডেশনে আট তলা নির্মান করবেন, এটাও কি মেনে নেয়ো যায়? বিল্ডিং কোড না মানলে যে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, এমন উদাহরণ আমাদের সামনে অনেক রয়েছেমালিকরা হয়ত বীমার টাকায় উদ্ধার পেয়ে যান, কিন্তু অভাগা এই শ্রমিকরা- তারা কি একরে পর এক জীবন দিয়েই যাবে? তারা কি ক্রমাগত সংবাদ মাধ্যমের লিড নিউজ হয়ে থাকবে?
যে কোন জরুরী প্রয়োজনে উদ্ধার কার্যে সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন স্থানীয় জনসাধারণসাভারের এবারের ভয়াবহতম দুর্ঘটনায়ও তাই ঘটেছেআশেপাশের সাধারণ মানুষ নিজ নিজ সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন উদ্ধার কাজ চালাতেপরে যোগ দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস, সেনা বাহিনী, নৌ বাহিনীসহ অন্যান্য সরকারী বিভাগদেশবাসী ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে দেখেছন, উদ্ধারকাজে ধীরগতি এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমš^হীনতার বিষয়টিআমাদের দেশের সরকারী সংস্থায় যারা কাজ করেন তারা হয়তো অসাধারণ মানুষ, তাই সাভারে উদ্ধার কাজে নিয়োজিত সেনা সদস্যদের মতো তাদের চোখে হয়তো পানি আসে নাতাই অবস্থাটা এমন- দেখি না কি হয়
দেশের যে কোন বিপদে সাধারণ মানুষ সবার আগে- এটা আবারো প্রমানিত হলইন্টারনেটে কয়েকটি পোস্টের মধ্যদিয়ে দ্রুত শুরু হয়ে যায় শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের রক্ত সংগ্রহ অভিযানজানা গেছ কেবল গণজাগরণ মঞ্চ থেকেই পাঁচ সস্রাধিক ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ হয়েছে বুধবার রাত আটটার মধ্যেরক্ত সংগ্রহ করেছে বিরোধী দল বিএনপি- দলীয় কার্যালয়ের সামনেরক্ত দিয়েছে স্কাউটরাও- রেড ক্রিসেনট সোসাইটিতেদুর্ঘটনাস্থলেও স্কাউটরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেসাধারণ মানুষের রক্ত দেবার এ মহৎ কাজে হাজার হাজার তরুণ অগ্রগামী, অন্তত শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ চত্তরে মানুষের ভীরে তাই মনে হয়েছে
বিরোধী দল দেরিতে হলেও হরতাল তুলে নিয়েছে, সে জন্য সংসদে দাড়িয়ে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলকে ধন্যবাদ জানিয়েছেনআমার জানতে ইচ্ছে করে, দুর্ঘটনা ঘটলো সকালে- হরতাল প্রত্যাহারে বিরোধী দলের এত বিলম্ব হলো কেন? তারা কি পারতো না তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্তে অবিলম্বে হরতাল কর্মসূচী প্রত্যাহার করে নিতে? যদি তাই হতো, সাধারণ মানুষের আস্থা তাদের প্রতি বাড়তো বই কমতো না
দুর্ঘটনার পরে ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই সেখানে গেছেনগেছেন  বিরোধী দলের নেতাসহ অনেকে নেতাঅনেকের কথার মাঝে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কথাটা প্রনিধান যোগ্য, যদিও তিনি কথাটা বলেছেন মুন্সীগঞ্জে গিয়ে- পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদটি এমনতরে:  সাভার ট্র্যাজেডিকে মানবতাবিরোধী অপরাধ আখ্যায়িত করে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার করার দাবি জানিয়েছেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরতিনি বৃহস্পতিবার সকালে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ঘাটে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ পরিদর্শনের আগে মাওয়া সার্কিট হাউসে সাংবাদিকেদের এ কথা বলেনএ সময় তিনি আরো বলেন, সেখানে নিরীহ শ্রমিকদের জোর করে কাজে পাঠিয়ে তাদের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে, এটাকে আমি আরেক রকমের মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে মনে করিবিষয়টা এখন দিবালোকের মতো পরিষ্কার, নড়বড়ে একটা ভিত্তির ওপর নয়তলা বিল্ডিং করা হয়েছেযারা অপরাধ করেছে তদন্ত কাজের নামে তাদের বিচারকে বিলম্বিত করার কোনো মানে হয় নাএ ধরণের তদন্তের ওপর দেশের মানুষের খুব একটা আস্থা এখন নেইসাভারের ঘটনাকে তিনি সতর্কবার্তা হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, দেশে মাঝারি আকারের ভূমিকম্প হলে দেশ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে সাভার ট্রাজেডি নিয়ে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য এখানে উল্লেখ না করাই ভালতবে সাধারণ মানুষ বলছেন, যদি গুটি কয়েক পিকেটারের ধাক্কায় আটতলা ভবন ভেঙ্গে যায়, তবে সেই সব পিকেটারদরে জাতীয় সম্মাননা দেয়া হোক- কেননা, তারা জাতির গর্ব হতে পারে, তাদের দিয়ে অনেক শক্ত কাজ করানো যেতে পারে
গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সংশ্লিষ্ট পাঁচ কারখানার সদস্যপদ স্থগিত করেছে বলেও জানা গেলমামলাও হয়েছে একাধিকসরকারী নিয়মে তদন্ত কমিটিও হয়েছে; তবে কমিটির রিপোর্ট আদৌ কোনদিন প্রকাশ পাবে কি না, পেলেও দোষীরা রাজনৈতিক কারণে পার পেয়ে যাবে কি না, তা ভবিষ্যতই বলতে পারে
আশুলিয়ার তাজরিন গার্মেন্টস দুর্ঘটনার ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই সাভারের এ ঘটনা, এতেও যদি দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের হুশ ফিরে না আসে, তবে বলতেই হবে একবিংশ শতকের অগ্রসরমান এ জগতে বসবাসের যোগ্য নই আমরাআমাদের নতুন করে ভাবতে হবে অগ্রসরমান দুনিয়ার বাসিন্দা হতে হলে প্রয়োজন নতুন প্রজন্মের নতুন নেতৃত্বধুয়ে মুছে সাফ করতে হবে পুরাতনের ধ্যান ধারণা
আমরা দেশবাসীর সাথে একমত হয়ে বলতে চাই, এ জাতীয় দুর্ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের প্রকৃতার্থে বিচার হতে হবে, দিতে হবে কঠোর শাস্তি, নইলে দেশে এ শবে মিছিল থামবে না, দিনে দিনে জাতীয় শোক দিবসের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে, যা আমরা আর দেখতে চাই না