রবিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৩

বরেন্দ্র ও প্রাগজ্যোতিষপুরের তেতুলিয়া - তৃতীয় পর্ব

 নুরুল্লাহ মাসুম


তৃতীয় পর্ব

পরবর্তী গন্তব্য খুনিয়া দিঘী বধ্যভূমি। প্রায় ২৫ মিনিট পথচলে আমরা পৌঁছে যাই খুনিয়ার দিঘী বধ্যভূমিতে। এই বধ্যভূমির অবস্থানও রানীশংকৈল উপজেলায়। এটি মহান মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁ জেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বর্তমান ঠাকুরগাঁ জেলার সীমান্তবর্তী হরিপুর উপজেলা, বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা, রানীশংকৈল উপজেলা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী রানীশংকৈলে ক্যাম্প স্থাপন করে। প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের লোকদের ধরে আনা হতো রানীশংকৈল আর্মি ক্যাম্পে। সেখানে বর্বর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করার পরে, লাশগুলোকে খুনিয়া দিঘীতে ফেলে দেওয়া হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার জন্য রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ডা. আব্দুর রহমান ও তার সহোদরকে খুনিয়া দিঘীর পাড়ে নিয়ে হত্যা করা হয়। দিঘী পাড়ের শিমুল গাছে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতের তালুতে লোহার পেরেক মেরে ঝুলিয়ে রেখে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করতো পাক হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা। কখনো কখনো হত্যার পূর্বে লোকজনকে কবর খুঁড়তে বাধ্য করতো। হত্যার পরে দিঘীর পাড়ের উঁচু জমিতে মাটি চাপা দিতো। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী,  রাজাকার, আলবদর আর আলশামসেদের সহায়তায় প্রায় ৩০০০ মানুষকে হত্যা করে খুনিয়া দিঘীতে ফেলে দেয়া হয়। ফলে মানুষের রক্তে দিঘীর পানির রং হয়ে যায় ঘন-খয়েরি। রক্ত, লাশ, কঙ্কালে ভরপুর খুনিয়া দিঘী নামটি আরো সার্থক হয়ে উঠে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দিঘী থেকে উদ্ধার করা মানুষের হাড়গোড় দিঘীর পাড়ে একটি গর্ত করে মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। শহীদদের স্মরণে দিঘী পাড়ের ওই জায়গাটিতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। ১৯৭৩ সালে জাতীয় চার নেতার মধ্যে অন্যতম আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান স্মৃতিসৌধটি উদ্বোধন করেন।

দিঘীটি ঠাকুরগাঁ জেলা শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার এবং রানীশংকৈল উপজেলা সদর থেকে মাত্র সিকি মইল দক্ষিণে অবস্থিত। দিঘীটি ৬ একর জুড়ে। জানা যায়, প্রায় দুশ বছর আগে স্থানীয় কোন জমিদার খনন করেছিল দিঘীটি। জনশ্রুতি, এলাকার ব্যাবসায়ীরা দিঘীর পাশ দিয়ে রায়গঞ্জে যেতেন। দিঘীর এলাকাটি নির্জন জঙ্গলার্কীণ থাকায় এখানে এক ব্যবসায়ীকে খুন করে দিঘীর পাড়ে ফেলে রেখেছিল দস্যুরা। তখন খেকে দিঘীর নাম খুনিয়া দিঘী। এখানে নির্মিত দুটি স্মৃতি স্তম্ভ রয়েছে, একটির নাম খুনিয়া দিঘী মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ অন্যটির নাম খুনিয়া দিঘী স্মৃতি সৌধ। এ দুটিই দিঘীর দুই পাড়ে স্থাপন করা হয়েছে। খুনিয়া দিঘী মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ-এর গেটের কাছে ২০জন শহীদের নাম তালিকা ঝুলানো রয়েছে। এখানে প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর ও ২৬ মার্চ রাত ১২টা ১মিনিটে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে স্থানীয় জনগণ।

আধা ঘন্টার একটু বেশী সময় আমরা এখানে অবস্থান করেছিলাম। স্মৃতি সৌধ ও স্মৃতি স্তম্ভ- দুটিই অযত্ন অবহেলায় পড়ের আছে। স্মৃতিস্তম্ভের গেটে নির্মিত পাবলিক টয়লেট কতকাল ধরে বন্ধ রয়েছ তা বোঝা গেল না। আমরা সেখানে কয়েকজন তরুনকে দেখতে পাই, যারা আমাদের দেখে চলে যায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে স্থানটি নেশাখোরদের তীর্থ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য স্থানীয় প্রশাসন দ্রুত স্মৃতি সৌধ ও স্মৃতি স্তম্ভের দায়িত্ব গ্রহণ করে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করবেন বলে আশা করছি। পর্যটকরা যাতে সহজে এই স্থানে আসতে পারে পারে সে জন্য সঠিত পথ নির্দেশনারও দরকার।

সকালের নাশতা বিলম্বে হওয়ার কারণে আমাদের দুপুরের খাবারও বিলম্বে হলো। বেলা ৪টা নাগাদ রাণিশংকৈল বাজারের প্রসিদ্ধ খালেক হোটেলে মধ্যাহ্নের আহার সম্পন্ন করে বিশ্রাম না নিয়েই ছুটে চললাম পরবর্তী গন্তব্যে। এবারের পথচলা একটি জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে- রাজা টংকনাথের রাজবাড়ি।

চলবে


কোন মন্তব্য নেই: