একদিন তুমি হাসতে হাসতে জানতে চেয়েছিলে:
- আমায় একটা প্রেমপত্র লিখবে?
অবাক বিষ্ময়ে ক্ষাণিক সময় বিমূঢ়; ততধিক বিষ্ময় নিয়ে আমি
পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম:
- আমি, তোমাকে?
আরও ক্ষাণিকটা সময় কাটলো- হয়তোবা
বিষ্ময়ের ঘোর কাটাবার ব্যর্থ চেষ্টার সময় ক্ষেপণ; আবারো প্রশ্ন রেখেছিলাম:
- আমি তোমাকে প্রেমপত্র লিখবো?
শেষ হেমন্তের সোনলী ধানের ক্ষেতে বয়ে
যাওয়া মৃদুমন্দ হাওয়ার তালে যেমন করে ধানের শীষ দোলে, ঠিক তেমনি করে দুলে উঠলে
তুমি; খিল্খিল
করে হাসির নহর বইয়ে দিয়ে মৃদু স্বরে তোমার উত্তর- ছোট্ট, সুন্দর ও মিষ্টি উত্তর:
- হ্যা।
বিমোহিত আমি; বিশ্বাস করো নন্দিনী- আমি
সত্যিই বিমোহিত, পুলকিত, চমৎকৃত হয়েছিলাম সেদিন। আমার মনের প্রতিটি কোনায়; নাহ্, সঠিক শব্দ ব্যবহার করা হলো
না, প্রতিটি
অনু-পরমানু সেদিন আনন্দে ভেসেছিল কেতম তরো! সেই অনুভূতির ব্যাখা তোমায় আমি দিতে
পারবো না।
ক্ষাণিকটা সময় সেদিন তুমি আমার পাশে
ছিলে। ঘোর বর্ষাকাল। গাঁয়ের মেঠোপথ তখন ভিজে একাকার- ক্রমাগত
তিন দিনের মুষল ধারায়। মাসটা
ছিল আষাঢ়- তবু বর্ষাধারা মনে করিয়ে দিচ্ছিল শ্রাবণের আগমণী বার্তা। কাঠর বাঁটের সেই-ই পুরানা দিনের মোটা
কালো কাপড়ের একটিমাত্র ছাতা;
তোমাকে-আমাকে, কাউকেই সেই অঝোর ধারা থেকে
রক্ষা করতে পারছিল না। তবু
শক্ত হাতে ধরেছিলাম ছাতার বাঁট। ঝড়ো
হাওয়া যদিবা ছিলনা, তবু
দুই ফার্লং পথ তোমায় এগিয়ে দিয়েছিলাম। তোমার
ফেরার তাগিদ ছিল। আকাশে সূর্য নেই, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার চিহ্ন
ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হচ্ছিল। ভেজা-কর্দমাক্ত
মেঠো পথে দ্রুত পা চালাবার মত অবস্থাও ছিল না। নন্দিনী, তোমার কি মনে আছে- সেই বৃষ্টি ভেজা বিকেল বা সন্ধ্যায় তোমার
পড়নে ছিল গাঢ় সবুজ রঙের সুতি শাড়ি?
ব্লাউজটা
ছিল গাঢ় হলুদ বা সোনলী। আমাদের বাড়িতে তোমার আগমনের সাথে সাথেই
বলেছিলাম:
-হেমন্ত আসতে এখনও বাকী অনেকটা- প্রকৃতির মাঝে। অথচ তোমায় দেখে মনে হয় হেমন্ত এসে গেছে।
-কি করে?
বিষ্ময়ভরা চোখে জানতে চাইলে তুমি।
হেসে আমি বলেছিলাম:
- সবুজ জমিনে সোনলী ফসল, এতো
হেমন্তের আগমনী বার্তা। তোমার
শরীরে সবুজ জমিন আর.........
তুমি সেই সময়ে কী সাবলিল ভঙ্গিমায় হেসেছিলে; তোমার সেই হাসি আজো আমার
চোখে ভাসে। নিভৃতে শুনতে পাই তোমার কণ্ঠের কলধ্বণী।
আজ আমি বড্ড আনমনা। কোন কাজে মন বসছে না। প্রথাগতভাবে সবচেয়ে কঠিন অথচ বিখ্যাত, অবশ্যই বিশ্ববিখ্যাত
নাট্যকার শেক্শপিয়ারের ওথেলো নিয়ে বসলাম। ছেলেবেলা
থেকেই জেনে এসেছি, কঠিন
ভাষায় লেখা বই নিয়ে বসলে সহসাই ঘুম পায়। বিশ্বাস
করো, ওথেলো
আমায় ঘুমের রাজ্যে নিয়ে যেতে পারেনি। বরং
কেবলি সেই বৃষ্টিস্নাত বিকেল বা সন্ধ্যার কথা বারবার মনে হতে থাকে। অবশেষে-
কতকাল আগের সেই কথা। তোমার সেই-ই ছোট্ট অথচ সুন্দর একটা
অনুরোধ রক্ষার কাজে বসে গেলাম। হাতের
কাছে কাগজ কলম ছিল না; একটু
সময় করে সংগ্রহ করতে হলো। ফাঁকে
এককাপ চা তৈরী করে নিলাম। তুমি
তো জান, জানি
না এখন আর তোমার মনে আছে কি না;
আমি
নিজের হাতে চা তৈরী করতে পছন্দ করি সে-ই কবে থেকে। সে দিন বিকেলেও তোমায় নিজ হাতে চা করে
খাইয়েছিলাম। না, এখন আর কাঠের জ্বালানি দিয়ে চা করতে হয় না; গ্যাসের চুলা তো আছেই। রয়েছে ওভেন- মুহুতেই পানি গরম। সহজেই হাতের মুঠোয় তৈরী চা।
কি লিখবো তোমায় নন্দিনী? প্রেমপত্র লেখে কি করে? আমরা কি কখনো প্রেম করেছি? সত্যি করে বলো তো, তুমি কি কখনো আমার প্রেমে
হাবুডুবু খেয়েছে? অথবা
আমি তোমার......?
এক সাথে পথ চলেছি কতদিন? আমরা কি আদৌ কোন কালে খোলা
ময়দানে গোল্লাছুট বা বৌ-চি খেলেছি?
আমার
একটা বিষয় পরিস্কার মনে আছে,
আমরা
বর্ষা কালে ভরা যৌবনা নদীতে একত্রে অনেকে মিলে সাঁতার কেটেছি। মনে আছে তোমার? সাতারে তুমি আমার চেয়ে
অনেক ভাল ছিলে। এ নিয়ে মাঝে মাঝে হারু আর মম কতই না
খেপাতো আমায়। বেটা ছেলে হয়েও আমি একটা মেয়ের সাথে
সঁতারের পাল্লায় হেরে যেতাম! তবে আমার সুখ ছিল অন্যত্র। দীর্ঘক্ষণ পানিতে ডুবে থাকার রেকর্ডটা
ছিল আমারই; অন্যদের
সেখানে কোন ঠাঁই ছিল না।
ছেলেবেলার সেই দুষ্টু রেকর্ডটাই আমার
জীবনের সাথী হয়ে রইল। তাইতো
তোমার সেই ছোট্ট অথচ সুন্দর একটা আব্দার রাখতে আমি ব্যর্থ হয়েছি। বলতে পার- আমি পানির নিচেই ডুব দিয়ে
লুকিয়ে ছিলাম দীর্ঘ দিন। আজ যখন
পানির ওপর ভেসে উঠলাম; মনে
হলো হেমন্তের সেই সবুজ মাঠে সোনালী ধানের ওপর বয়ে যাওয়া মৃদুমন্দ হাওয়ায় দোল খাওয়া
তোমার মুখখানি। তাইতো কাগজ-কলম নিয়ে বসলাম।
হয়তো তুমি হাসবে। একবিংশ শতকের আধুনিকতায় যখন চার বছরের
শিশুর লেখা-পড়ার হাতেখড়ি হয় ল্যাপটপ বা পিসিট্যাব দিয়ে, সে সময়ে আমি প্রাচীনপন্থী
কাগজ-কলম নিয়ে তোমায় প্রেমপত্র লিখছি। কি
করবো বল? আমারতো
মনে হয়, কাগজ-কলম
না হয়ে এ লেখাটা যদি তালপতায় কয়লার কালি ও বাঁশের কঞ্চির কলম দিয়ে লিখতে পারতাম- আমার
আনন্দ হতো আরো মধুর, আরো
আবেগঘন।
ঝিনুকের খোল পাকা শান-বাঁধানো ঘাটে ঘসে
ঘসে কাঁচা আম কেটে আচার খাওয়ার কথা কি তোমার মনে আছে? সে সময়ে গাছের আম চুরি করে, বাগানের কাঁচা লঙ্কা চুরি
করে, নদীর
ধারে নল-খাগড়ার বনে তুমি,
আমি, লুকিয়ে আমের আচার খেতাম; মাধবী, ললিতা, হাসু, কাকন, মতি, রুদ্র- আরো কতজনাই থাকতো
সাথে। সকলে সব সময় না থাকলেও তুমি আর আমি
থাকতাম সব সময়ে। বলা যায় ওটা ছিল আমাদের দল। আজকের দিনে দেখ, প্রাকৃতিক ঝিনুকের সেই
জায়গাটা দখল করেছে “পিলার” নামের ছোট্ট যন্ত্র; যা সব ধরণের সবজি ও ফলের
বাঁকল তোলার কাজে ব্যবহৃত হয়;
তোমার
আমার বাঁকলও তুলতে পারে এই “পিলার”।
প্রেম কি নন্দিনী? তুমি কি আমার কথা ভাব? আমি কি তোমার কথা ভাবি? একে অপরের দুঃখের সাথী কি
আমরা হতে পেরেছি? আজ
তুমি কোথায়, আর আমি? কতদিন আমাদের দেখা হয় না, মনে পড়ে? তবু তোমায় নিয়ে আজ লিখছি? শরতের মুক্ত আকাশ যেন আমার
বাড়ির ছাদে নেমে এসেছে। সেখানে
ইচ্ছে করলেই হাত বাড়িয়ে পূর্ণিমার চাঁদ ছোঁয়া যায়।
তর্জন-গর্জনে ভরা সেই ভয়ঙ্কর নদীর পাড়ের
ছোট্ট সুন্দর গাওখানি ছেড়ে একে একে সকলেই শহরে পাড়ি জমাল। সত্যি কথা বললে বলতে হয়, শহরমূখী হতে বাধ্য করলো
প্রকৃতি আমাদের। বাস্তবস্থা আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিল
একে অপরকে- সকলকে। উত্তর-দক্ষিণে
বয়ে যাওয়া সেই নদীর ধারে কত রাত আমরা পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় স্নাত হয়েছি; মনে পড়ে কি? দল বেধে সেই রাতগুলোয় হেড়ে
গরায় কত গান আমরা গেয়েছি- তা কি হিসেবের খাতায় লেখা যাবে?
শীতের রাতে খেজুর রস চুরি করে পাতার
উনানে পায়েস খাওয়ার কথা, মনে
পড়ে তোমার? আজো
আমি সেই পায়েসের স্বাদ পাই নির্ভতে- একান্তে। তুমি কি পাও?
কতকাল হলো, পূর্ণিমার আলোয় স্নাত
হচ্ছি না; বা
বলতে পার হওয়ার সুযোগ নেই- যান্ত্রিক এই শহরে। তুমি আমি কত কাছাকাছি এই শহরে; অথচ সপ্তাহান্তে আমাদের
দেখা হয় না বললেই চলে। ভাবতো
একবার- পল্লীর সেই সব দিনের কথা। দুই
ফার্লং পথ পাড়ি দিয়ে কতদিন,
কত
রাত তুমি আমাদের বাড়ি চলে আসতে হেঁটে। আমার
কথা না হয় বাদই দিলাম। গাঁয়ের
বেশীর ভাগ ছেলে-মেয়ে ভুতের ভয়ে সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বেড় হতো না; ব্যতিক্রম ছিলে তুমি। আর আমি, আজও পর্যন্ত কোন ভুত বা পেত্নীর সাক্ষাৎ পেলাম না- দুঃখটা
থেকেই যাবে।
কি লিখবো নন্দিনী? তোমার ডাগর চোখ দু’টির কথা? ঐ মায়াবি চোখ আমায় আজও
ভাবায়; আজও
আমি ডুবে যেতে পারি ঐ কাজল কালো চোখের গহীনে। অথবা তোমার সেই নেচে যাওয়া শস্য ক্ষেতের
মত মিষ্টি হাসি আর মুক্তোর মত দাঁত। কোনটা
রেখে কোনটা নিয়ে লিখবো? তোমার
দেখা মিলতেই আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যেতাম- তোমার একই অঙ্গের কোন্ অনু-পরমানু আগে
উপলব্ধি করবো; সত্যি
নন্দিনী আমি ভেবে পাই না,
চোখ
আগে না মুখ আগে; না কি
তোমার তীক্ষ্ণ নাসিকা!
তোমার চুলের কথা নাইবা বললাম।
আমার ভাল লাগে তোমার ছন্দময় হাঁটার গতি-
যেন কূল কূল ধ্বনীতে বয়ে চলা নদী; ক্রমাগত তাকিয়ে থাকার মত, ক্লান্তিহীন; নেশাগ্রস্তের মত। নাহ্, এ কথাগুলো বলা হয়নি তোমায়। কখনও কখনও মনে হয়, তুমি এলে- তোমায় কাছে
পেলেই তোমার অস্তিত্ব অনুভবে এতটা কাছাকাছি হব; যেখান থেকে তুমি পালাতে পারবে না। বিশ্বাস করো, তুমি কাছে এলে আমার সেই
সুপ্ত বাসনা একেবারেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, মনে হয় গাছের গোলাপ ছিড়ে হাতে নিলেই ওর সৌন্দর্যহানি ঘটবে; শুকিয়ে যাবে, মরে যাবে। গাছেই ও চিরযৌবনা- থাক না ওখানেই! বলতে
পার, এটা
আমার দুর্বলতা বা ভীরুতা। গোলাপের
সৌন্দর্য প্রকৃতির মাঝেই যথার্থ। হেমন্তে
খাদ্যের প্রয়োজনে ধান কাটা হয়ে গেলে মাঠ হারায় সৌন্দর্য; পেট ভরে গৃহস্থের। আমি অনাহারী থাকতেই বেশী পছন্দ করি। বলতে পার- এটাও আমার ভীরুতা। অভুক্ত থেকেও মনের আনন্দ; এটাই বা কম কিসের?
নারে নন্দিনী, প্রেমপত্র লেখা আমার কম্ম
নয়। প্রেমই করতে পারিনি আজও- কি করে
প্রেমপত্র লিখবো বলো?
কবে থেকে তোমায় ভাললাগে, বলতে পারবো না। ছোট্ট বেলাটা বেশ অনেকগুলো বছর একসাথে
খুব কাছাকাছি ছিলাম; তারপর
অনেকগুলো বছর কেটে গেল ভীষণ একাকীত্বে! কখনও-সখনও, একাকীত্বের মাঝে তোমার স্মৃতি নিয়ে সময় কেটেছে আমার। তোমারও কি তেমনটি ঘটেছে কখনও? আবার যখন ইট-পাথরের এই প্রাণহীন
নগরীতে আমরা মিলিত হলাম- আমরা সমব্যাথী, সহযাত্রী। উভয়েই
হারানোর বেদনাসিক্ত; তবু
জীবন বহমান। কেউ কারো সাথে নয় অথচ কত কাছে- ঠিক যেন
রেল সড়কের মত। সমান্তরালে পথ চলছি নিরন্তর, শুনছি-জানছি একে অপরের সুখ-দুঃখের
গল্পকথা, চোখর
জল ফেলছি, কখনওবা
হেসেই লুটোপুটি খাচ্ছি; আবার
শান্তনাও দিচ্ছি, মিলতে
পারার ইচ্ছেটা পূরণ হচ্ছে না;
পূরণ
হবারও নয় কোন দিন।
নাহ্, আমার দ্বার প্রেমপত্র লেখা হবে না নন্দিনী। ক্ষমা করো আমায়। তোমার ধ্রুব না হয় আরেক দিন চেষ্টা করবে
তোমার উদ্দেশ্যে সুন্দর একটা প্রেমপত্র লিখতে। অপেক্ষায় থাক ততদিন এবং ভাল থেকো
নিরন্তর।
ধানমন্ডি, ঢাকা
১৯০১৪৩ মে ২০১৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন