রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৩

ভুলেও ভুল স্বীকার করতে ভুলে যান ক্ষমতাসীন

ভুলেও ভুল স্বীকার করতে ভুলে যান ক্ষমতাসীনরা

নুরুল্লাহ মাসুম


‘ক্ষমতাসীন দল’- একটি বিশেষ গোষ্ঠীর দল, একটি বিশেষ দল। যে যখন ক্ষমতার মসনদে থাকেন, তখন তার চরিত্রের কিছু বিশেষ দিক জনসমক্ষে ফুটে ওঠে। সেই ক্ষমতাসীন দল সব সময় এক গোত্রের না হলেও ঐখানে গেলেই তাদের চরিত্র এক হয়ে যায়। ক্ষমতাসীন দল হতে পারে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি বা জাতীয় পার্টি থেকে আগত। যে দিন তারা সংবিধানের নামে শপথ নেন, সেদিনই তাদের চরিত্র বদলাতে শুরু করে। তারা ভুলে যান, জনগণ তাদের ভোট দিয়ে ঐ স্থানে পাঠিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের আবার বিশেষ কতগুলো পদ-পদবী আছে, যেখানে বসে তারা যখন কথা বলেন, তখন আম-জনতা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে এবং শোনে, বলা যায় শুনতে বাধ্য হয়- সময়ের হেরফেরে ঐ পদ-পদবীর লোকেদের কথার সুর এবং ধরণ একবোরেই একই রকম। কথায় বলে মানি লোকের কথার কোন পরিবর্তন নেই। তাইতো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কথা যখন জনতা শোনে তখন তারা বুঝতে পারেন না- কথাটা আওয়ামী লীগের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলছেন না বিএনপির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলছেন! জনতা আরো অবাক হয় যখন জাতীয় পার্টির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কথার সাথে অন্যদের কথার অবিকল মিল খুঁজে পান। এদের সকলেই ‘ক্ষমতাসীন দলের’ লোক। গদীতে বসলে তারা ভুলে যান যে, তারা আওয়ামী লীগ বা জাতীয় পার্টি বা বিএনপির লোক। রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের কর্মসূচী এক নয়, নির্বাচনী ইশতেহার এক নয়। কারো কারো অবশ্য ইশতেহার বলে কিছু থাকে না, দলীয় প্রধান যেটা বলেন- সেটাই বাইবেল। ইদানিং অবশ্য ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া প্রতিটি দলই ‘নেতা’ সর্বস্ব হয়ে উঠেছে। তাই ‘নেতা’র অসন্তুষ্টি যাতে না হয় সে বিষয়ে ‘ওখানকার সকলেই’ সচেষ্ট থাকেন। জনতার কথা ভুলে যান।
ক্ষমতায় যাওয়ার পর প্রত্যেকেই ভুলে যান যে, তারা মানুষ হিসেবে ভুল করতে পারেন। ক্ষমতার চর্চা করতে গিয়ে তারা এমন কিছু কাজ করেন, যা দৈবক্রমে ভুল হয়ে গেলেও তারা সে ভুল স্বীকার করতে একেবারেই ভুলে যান। যেন ভুল করাটা তাদের সাজে না। অন্য দিকে, দায়িত্ববোধ বলে কোন শব্দ তাদের অভিধানে আছে বলে মনে হয় না। এ বিষয়টা অবশ্য স্বাধীন বাংলাদেশেই নয়, পাকিস্তান আমল থেকেই চলে আসছে। রসিক লোকেরা যেমনটি বলে থাকেন, পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতাধর গভর্নর মোনায়েম খান নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আব্দুল হাইকে ডেকে পাঠিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, আপনার করেন কি, রবীন্দ্র সঙ্গীত লিখতে পারেন না? উত্তরে অধ্যাপক হাই কি বলেছিলেন তা আমার জানা নেই। সামরিক সরকার জিয়ার মন্ত্রীসভার সিনিয়র মন্ত্রী (তখন প্রধানমন্ত্রী বলে কেউ ছিলেন না) নাকি রেল দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে বলেছিলেন, মন্ত্রী কি রেল চালায় যে রেল দৃর্ঘটনায় তাকে পদত্যাগ করতে হবে! খালেদা জিয়ার গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী গোলাগুলিতে একটি শিশুর মৃত্যু নিয়ে ‘আল্লার মাল আল্লায় নিছে’ বলে বেশ বেকায়দায় পড়েছিলেন।
দগদগে সা¤প্রতিক সময়ে দেশের বিশিষ্ট দু’জন ব্যাক্তির (তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনির) সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হবার পর অবশ্য বর্তমান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এমন কোন বেফাঁস কথা বলেননি বটে তবে এক মন্ত্রী বলেছেন, চালকের দোষে দুর্ঘটনা হয়নি। অন্য দিকে যোগাযোগ মন্ত্রী হাসপাতালে আহত একজনকে দেখতে গিয়ে বলে এসেছেন- আপনার গাড়ীর চালকের জন্যই দুর্ঘটনা ঘটেছে। আহত যাত্রী অবশ্য মন্ত্রী এমন কথায় প্রতিবাদ করে বলেছেন, গাড়ীতে মন্ত্রী নয় তিনি ছিলেন এবং তিনি জানেন- কার দোষে দৃর্ঘটনা ঘটেছে।
মন্ত্রী- যিনি সড়ক পরিবহন শ্রমিক নেতা, তিনি তার সদস্যদের দোষ দেখতে পাবেন না, এটাইতো স্বভাবিক। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে তিনি যোগাযোগ মন্ত্রীকে বাধ্য করছেন তার কর্মীদের বিনা পরীক্ষায় গাড়ী চালাবার সনদ দিয়ে আরো ঘাতক তৈরী করার জন্য। ইতোপূর্বেও নাকি এমনটি ঘটেছে- যা আমাদের জানার বাইরে ছিল।
সড়ক দুর্ঘটনায় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনিরের মৃত্যু যেন কিছুটা হলেও বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ধাক্কা দিয়েছে সজাগ হওয়ার জন্য। মন্ত্রী পরিষদের বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক ‘ঝড়ো আলোচনা’ হয়েছে বলে শুনেছি। প্রধানমন্ত্রী দয়া করে দ্রুত সড়ক মেরামতের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকেই যদি সড়ক নিয়ে ভাবতে হবে- তাহলে যোগাযোগ মন্ত্রী নিয়োগ করে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে খরচ করা কেন? আবার নৌ-মন্ত্রীর সুপারিশ লাগবে কেন গাড়ী চালকের লাইসেন্স দেবার জন্য! তিনিইবা কেন এমন আবদার করবেন (অবশ্য এটাকে আবদার না বলে ধমকি বলাই সঠিক হবে)?
ভারতের মত দেশে এমন ঘটনায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও সরকারী কর্তা ব্যক্তিরা পদত্যাগ করতেন। ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়ক প্রায় সপ্তাহকাল ধরে বন্ধ, আর আমাদের মন্ত্রী বলছেন, কষ্ট হতে পারে যাত্রীদের- তবে রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী নয়। তাই তিনি বিআরটিসি মানে সরকারী বাস চালাবার ঘোষণা দিয়েছেন। বেশ চমৎকার ব্যাপার। দেখ অভাগা বাঙ্গালী (আমরা বাঙ্গালীইতো সংবিধান অনুসারে), সড়কের গর্তে পড়ে গাড়ি নষ্ট হবে, তাতে কি- ব্যক্তি মালিকদের গাড়িরতো কিছু হবে না। আর আপনারা সাধারণ জনতা, যাকে আমরা আম-জনতা বলি (উত্তর বঙ্গের ভাষায় মফিজ) আপনার না হয় একটু কষ্ট করলেনই। কেন, আমরা কি নির্বাচনের আগে কষ্ট করিনি- আপনাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরিনি?
যোগাযোগ মন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, পর্যাপ্ত তহবিলের অভাবে মহাসড়কগুলো নিয়মিত মেরামত করা সম্ভব হয় না এবং এ নিয়ে তিনি অর্থমন্ত্রীকে দায়ীও করেছেন। বিষয়টি কি তিনি বাজেটের আগে ভাবেন নি? তিনি কি জানতেন না, কোন্ কোন্ সড়ক মেরামত করতে হবে? জরুরী প্রয়োজনে কি অর্থ বরাদ্দের রেওয়াজ নেই নাকি? তিনি তো মন্ত্রী, তিনি না জানলেও তার মন্ত্রণালয় এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের বেতনভুক্ত ব্যক্তিরাও কি বিষয়টি নিয়ে কিছু জানেন না? দুর্মুখেরা অবশ্য বলেন, বাজেটে কি থাকে- স্বয়ং মন্ত্রী সেটা ভাল করে দেখার সময় পান না। নিজের বাণিজ্য নিয়ে, নেতার সন্তুষ্টি রক্ষা এবং সর্বোপরি নাদান জনতার দরবারে হাজিরা দিতে গিয়ে মন্ত্রণালয় নিয়ে ভাববার সময় কই? নৌ-মন্ত্রী অবশ্য নিজের মন্ত্রণালয় নিয়ে কাজ করেও পরিবহন নিয়ে বেশ সময় ব্যয় করে থাকেন। কারণ হিসেবে ধরে নেয়া যায় নৌ পরিবহনও যোগাযোগের বাইরে নয়।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে বোধকরি সড়ক দুর্ঘটনা অন্তর্ভুক্ত নয়। যদি হতোই তবে সড়ক ও জনপথ বিভাগ মহাসড়ক নিয়ে ভাববে না কেন? মহাসড়ক বন্ধ থাকায় মন্ত্রী বোধকরি জনতাকে রসিকতা করেই বলতে পারতেন, জনতা আবার যাতায়াতে আরাম চাইবে কেন? জনতা মানে পাবলিক- সরকারতো পাবলিকের জন্যই কাজ করে। পাবলিকের জন্য পাবলিকলি কাজ করতে গেলে সময়তো দিতেই হবে। আর যদি এমন কিছু না ঘটে, তবে আমাদের দেশের চ্যানেলগুলো খোরাক পাবে কোথায়!
সা¯প্রতিক সড়ক দুর্ঘটনাগুলোই কেবল নয়, নিয়মিত সড়ক দুর্ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে- অদক্ষ চালক এবং লাইসেন্স বিহীন চালক নামের হেলপারদের গাড়ী চালানোর জন্য এবং বেপরোয়া গাড়ী চালানোই অধিকাংশ দুর্ঘটনার কারণ। এসব চালকদের লাইসেন্স কে দেয়? সেখানে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দেখভাল করার কি কিছুই নেই? অন্যদিকে লাইসেন্স বিহীন চালকদের চিহ্নিত করার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন পুলিশ বাহিনীর- তাদের নিয়ে কিছু বলতে গেলে আরেকজন ‘কাদের’ তৈরী হতে সময় লাগবে না। আম-জনতা যাবে কোথায়? ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এ ছোট্ট দেশের গর্বিত জনতা কি কেবল আফসোস করে গাড়ী চাপা পড়ে মরবে?
কেবল দুর্মুখেরাই নয়, দেশের বিশিষ্টজনেরা পর্যন্ত পাবলিকলি (টেলিভিশন চ্যানেলে সকলের সামনে) বলে থাকেন, আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রী কথা বললেই বাজার দর বেড়ে যায়। এ যেন মোবাইল কোর্টে শাস্তি বর্ধনের মত। এ রমজানেও কি তিনি একটু চুপ থাকতে পারেন না? বাজার দর প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি অবশ্য মজাদার এক বাণী দিয়েছেন- জনতা তোরা খকাবার জন্য লালসা করো না, কম খাও। স্বাস্থ্য ভাল থাকবে। আরো আগে দেশের অর্থ মন্ত্রী জনতাকে বলেছেন- একদিন বাজারে না গেলেই হলো। কি দারুন প্রেসক্রিপশন! এরপর হয়তো যোগাযোগ মন্ত্রী বলবেন, গাড়ীতে চড়েন কেন? হেঁটে চলুন; ডায়াবেটিকের মত মরণ ব্যাধি থেকে রেহাই পাবেন।
সামনে ঈদের মওসুম। মানুষ নাড়ির টানে গ্রামে ছুটবে। নৌ মন্ত্রী হয়ত ফি-বছর লঞ্চ দুর্ঘটনার বিষয়ে বলবেন, লঞ্চে চড়ছেন কেন? সাঁতরে বাড়ি যান, শরীরটা ভাল থাকবে- বাংলাদেশ এভাবে আরো ভুরি ভুরি ‘ব্রজেন দাস’ পাবে, বিশ্ব দরবারে আমাদের নাম উজ্জল হবে। আর ¯^রাষ্ট্র মন্ত্রীর কথা কি বলবো। তাকে নিয়ে কিছু বলতে গেলেই তিনি কথার মধ্যে জঙ্গী সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাবেন। তার বিশাল বাহিনী (গতানুগতিক পুলিশ- আনসার, আধুনিক র‍্যাব) অনায়াসে এমন দুর্গন্ধ খুঁজে বের করে ফেলতে খুবই পারদর্শী। সাধারণ আসামী বা অপরাধী ধরতে তাদের যেন ভাল লাগে না। সন্ত্রাসী বা জঙ্গী ধরতে এক ধরণের থ্রীল আছে; সেই সাথে ভাগ্যোন্নয়নের বিষয়টিও জড়িয়ে আছে বলে শুনেছি। জজ মিয়াদের গল্পতো মানুষ এখনো ভোলেনি।
লিমনে পা কেটে ফেলতে হলো, নোয়াখালিতে এবং আমিনবাজারে পুলিশের সামনে গণপিটুনিতে ছেলেরা মরলো। উত্তরায় একতরফা ‘গুলি বিনিময়’ হয়ে গেল- সবই আত্মরক্ষার জন্য। জনতা আত্মরক্ষা করবে কি করে? এতকিছুর পরও আমাদের মন্ত্রীবর্গ একটিবারের জন্য বলেন না, এ কাজটা ভুল হয়ে গেছে- ব্যবস্থা নিচ্ছি। ‘সব দোষ নন্দ ঘোষ’- কথাটা এঁরা ভাল ভাবেই রপ্ত করেছিলেন ছোটবেলায়। তাইতো সব দোষ আম-জনতার। তাদের কোন দোষ বা ভুল নেই।
তাদেরই বা দোষ দেই কি করে? ‘ক্ষমতাসীন দল’ কখনোই ভুল করতে পারে না। ভুল বলে তাদের অভিধানে কোন শব্দ থাকতে নেই। এটাতো ভারত বা গণতন্ত্রের সুতিকাগার যুক্তরাজ্য নয়! লন্ডনসহ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে দাঙ্গার জন্য পুলিশ প্রধান কি বোকার মতই না পদত্যাগ করে বসলেন! ভারতেও সড়ক দুর্ঘটনায় সড়ক বিভাগের দায়িত্বশীল কর্তারা পদত্যাগ করেন। আমাদের কর্তাব্যক্তিরা তাদের মত বোকামী করবেন কেন? লন্ডনের দাঙ্গায় পুলিশ কমিশনার কি যুক্ত ছিলেন, না দাঙ্গা বন্ধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় পদত্যাগ করলেন- বিষয়টি নিয়ে একটি টক-শো হতে পারে। আলোচক হতে পারেন আমাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মন্ত্রী-সচিবসহ উর্ধতন কর্তাব্যক্তিরা।
আমরা বাঙ্গালীরা ইতিহাস না পড়লেও ইতিহাসের কথা বলতে বেশ ভালবাসি। আবার নিজের পক্ষে না এলে সেই ইতিহাস সহজেই ভুলে যেতে পারি, প্রয়োজনে ইতিহাস বদলাতেও পারি। এ যেন আব্দুল হাই এর রবীন্দ্র সঙ্গীত রচনা! তবে আমরা কখনোই একটি বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করিনা। আমরা যে দলেরই হই না কেন, যখনি ক্ষমতাসীন দলের সদস্য হই, আমরা ভুলে যাই ‘ভুল’ নামক শব্দটি। ভুলেও আমরা স্বীকার করতে ভুলে যাই যে আমরা ভুল করতে পারি। তবে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার পর ভুল করার বিষয়টা মনে এলেও সাহস করে বলতে পারি না, কারণ আবারো ক্ষমতায় যেতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই: