দেশের কথা ভাবুন
নুরুল্লাহ মাসুম
দেশটা যাচ্ছে কোন দিকে? মহাজোট সরকারের শেষ বছরে
এসে দেশের উন্নয়ন এবং অগ্রগতিতে মহাজট লেগে যাচ্ছে- অবস্থাদৃষ্টে তাই-ই মনে হচ্ছে। বিরোধীদলের ক্রমাগত হরতালে দেশের
অর্থনীতি এবং উন্নয়ন শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। কাগজে-কলমে দেশের প্রবৃদ্ধি যতই বাড়ছে
বলে দেখানো হচ্ছে বা দেখা যাচ্ছে- আসল চেহারাটা কি, তা বোধ করি পজিশন অপজিশন কেউই ভাবেছে না। উভয়ের লক্ষ্য একটাই- যে কোন ভাবেই হোক
ক্ষমতার মসনদে আরোহন করা। মহাজোট
সরকারের সবচেয়ে বড় শরীক আওয়ামী লীগ আগামীতে আবারো ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয়
সবকিছু করছে এবং করবে; সাদা
চোখে এটাই সবাই দেখতে পায়। অপর
দিকে বিরোধী ১৮ দলীয় জোটের বৃহৎ দল হিসেবে জাতীয়তাবাদী দল ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য
মরিয়া হয়ে উঠেছে। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় এটাই স্বাভাবিক
পন্থা। তবে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে অস্বাভাবিক
যে বিষয়টি আপামর জনসাধারণ বুঝতে পারছে তা হলো- ক্ষমতায় টিকে থাকা বা ক্ষমতায় ফিরে
আসার জন্য এ বৃহৎ দল দু’টি যা
করছে, তাতে
ক্ষতি হচ্ছে সামগ্রীক অর্থে দেশের এবং দেশের সাধারণ মানুষের। বিএনপিকে ভুলে গেলে চলবে না, তারা যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন আওয়ামী লীগের দেশ অচল
করার প্রক্রিয়ার পর একটা ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে তাদের পথ চলতে হয়েছিল। একই ভাবে বিএনপির একই কার্যক্রম এবং
তত্বাবধায়ক সরকারের পরে ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগকে ভীষণ এক দূর্বল
অর্থনীতি নিয়ে দেশ চালাতে হয়েছে। স্বৈরাচারী
এরশাদের বিরুদ্ধে এ দু’টি দল
যখন যুথবদ্ধ আন্দোলন করেছিল জামায়াতকে সাথে নিয়ে সেই নব্বই দশকে; তারপর ক্ষমতায় এসে
বিএনপিকেও মোকাবেলা করতে হয়েছিল দূর্বল অর্থনীতি।
সংবিধান থেকে তত্ত্বাাবধায়ক সরকার
ব্যবস্থা তুলে দেয়ার পর সেই ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য বিএনপি মূলত আন্দোলন শুরু
করে বর্তমান মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে। এর
সাথে যোগ হয়েছে মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য বিচার কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে
জামাতের আন্দোলন। এক পর্যায়ে মানবতা বিরোধী অপরাধের রায়
ঘোষণা হলে জামায়াত মরিয়া হয়ে ওঠে বিচার প্রক্রিয়া বাতিল করার জন্য। প্রাকারান্তরে জামায়াতের প্রতিটি
কর্মসূচীতে বিএনপি ও তার সহযাত্রীরা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে তা সমর্থন করে। ফলে হরতাল, ভাংচুরসহ শুরু হয়
হত্যাকান্ড। উভয়পক্ষই এ সব কাজের জন্য একে অপরকে
দায়ী করে চলেছে। মাঝখানে প্রাণ যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। প্রসঙ্গত বলতে হয়, চর দখল প্রক্রিয়ায় লাভবান
কোন না কোন ভন্ডাামী, প্রাণ
দেয় তাদের লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্যরা অথবা সাধারণ মানুষ।
গণতন্ত্রের মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে
পরমতসহিষ্ণুতা। বাস্তবিক অর্থে বাংলাদেশে যা কখনোই
দৃশ্যমান হয়নি। বরং বলা যায়, আমাদের দেশের গণতন্ত্র
হচ্ছে নির্বাচিত স্বৈরতান্ত্রিকতার এক জলন্ত প্রমান। প্রথমত ক্ষমতাশীন দল, সেটা যে দলই হোক- তাদের
দলের ভেতরেই গণতন্ত্রের প্রকৃত চর্চা নেই। বৃহৎ
দু’টি
দলেই চলছে এক ব্যক্তির ক্ষমতার দাপট। এ কথা
কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে,
আওয়ামী
লীগ বা বিএনপি- কোন দলেই এমন কেউ নেই যে দলীয় প্রধানের মতের বাইরে কোন গঠনমূলক মত
প্রদানে সাহসী। বিএনপির আত্মপ্রকাশ সেনানিবাসে, তবে শুরু থেকে আওয়ামী লীগ
ছিল গণতান্ত্রিক দল, যে দলে
নিয়মিত কাউন্সিল হতো এবং নেতা নির্বাচনও হতো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। আওয়ামী লীগে এখন আর সেই দিন নেই; কাউন্সিল হলেও দলীয় দলীয়
নেতা নির্বাচন করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করে থাকে। পরে দলীয় প্রধান কেন্দ্রীয় কমিটি ও
অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতা তিনিই মনোনয়ন দিয়ে থাকেন। এমনকি এ বছর দেখা গেল দলের ঢাকা মহানগরে
কারা নেতৃত্বে আসবে, তাও
দলীয় প্রধানের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বিএনপির
অবস্থা আরো ভয়াবহ, সেখানে
কেবল দলীয় কেন্দ্রীয় কমিটি নয়,
অঙ্গসংগঠনের
নেতা নির্বাচনও দলীয় প্রধানের ইচ্ছাধীন; তার দপ্তর থেকেই নেতা নির্বাচন করে নাম ঘোষণা করা হয়। এ দু’টি দলের কাছ থেকে দেশ পরিচালনায় আর যাই হোক গণতান্ত্রিক আচরণ
আশা করা যায় না বলেই প্রতীয়মান হয়। মন্ত্রিপরিষদের
কথা যদি বলি, গণতান্ত্রিক
দেশে সরকার পরিচালিত হয় মন্ত্রিপরিষদ দ্বারা এবং সেই মন্ত্রিপরিষদ আবার নির্বাচিত
সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। আমাদের
দেশে তা হচ্ছে কেবল প্রধানমন্ত্রী দ্বারা। ছোট-খাট
বিষয়েও এখানে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। তাহলে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার আর
বাংলাদেশের বর্তমান সংসদীয় সরকারের পার্থক্য থাকলো কোথায়? আমাদের দেশে সংসদে
নির্বাচিত সংসদ সদস্যগণ কেবল আর্টিকেল ৭০ এর বাধ্যবাধকতায় সংসদে দাড়িয়ে সরকার
প্রধানের প্রশংসা করা এবং কদাচিৎ নিজ এলাকার সমস্যার কথা বলা ছাড়া আর কিছু বলতে
সক্ষম নন বলেই মনে হয়। এমনি
অবস্থায় জনগণের কথা ভাববার সময় বা ফুসরৎ তাদের আছে বলে মনে হয় না। তাইতো, বৃহৎ দল দু’টি যখন
ক্ষমতার লড়াইয়ে ব্যস্ত তখন দেশের কথা ভাববার মত কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে
উঠেছে। এ মুহূর্তে আমরা ভরসা করতে পারি দেশের
অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি ব্যবসায়ীদের ওপর। তারাই কেবল উদ্যোগ নিতে পারেন, দেশে ব্যবসা করা মত সুন্দর
পরিবেশ তৈরীতে উভয় পক্ষকে আহ্বান জানাতে। বিশেষ
করে ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ সংগঠন এফবিসিসিআই এবং গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের সংগঠন
বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ যদি এ দল দু’টিকে
বর্তমান অবস্থায় ব্যবসার চরম দুর্গতির কথা তাদের বোঝাতে সক্ষম হন কোনও ভাবে যে, এভাবে চললে আগামীতে
ব্যবসায়ীরা সরকার পরিচালনার জন্য নিয়মিত কর প্রদানের সক্ষমতাও হারাবে। বিশেষত রফতানী নির্ভর ব্যবসাগুলো বাজার
হারিয়ে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়বে যে,
তাদের
ব্যবসা পরিচালনার মত কোন অবস্থাই থাকবে না। বর্তমান
বিশ্বে প্রতিযোগিতামূলক বাজারের কারণে কোন আমদানীকারক দেশই আমাদের জন্য বসে থাকবে
না। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয়, হরতাল অবরোধে সবচেয়ে বেশী
ক্ষতিগ্রস্থ হয় রফতানী ব্যবসা। দেশের ভেতরের কথাইবা বাদ দেই কি করে। কাচামালের ব্যবসাও ব্যাপকভাবে
ক্ষতিগ্রস্থ হয় হরতাল-অবরোধে। দেশের
অভ্যন্তরে বা বাইরে, যেটাই
হোক না কেন লাগাতর হরতাল বা অবরোধে এবং পরিবহন ব্যবস্থায় বাধা দেয়া হলে ব্যবসার
ক্ষতিতো হবেই। স¤প্রতি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে দেখা গেছে, পরিবহন ব্যবস্থা অচল থাকার
কারণে কৃষক উৎপাদিত কাঁচা পণ্য সঠিক সময়ে
বাজারজাত করতে না পারায় কি ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। একই সাথে ভোগ্যপণ্য ব্যবহারকারীগণ, বিশেষত শহরে বসবাসরত সাধারণ
মানুষকে কতটা চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে এ কারণে। পাশাপাশি
হরতাল-অবরোধের কারণে নিয়ত ধ্বংসের মুখোমুখি হচ্ছে জান ও মাল। প্রতিটি হরতালে আমাদের চোখের সামনে
জ্বলে-পুড়ে ছাড়খার হচ্ছে কোটি কোটি টাকার যানবাহন। এগুলো
ক্ষতিপূরণ হবে কি করে? যারা
এর মালিক, যারা
এগুলোর উপর জিবিকা নির্বাহ করে;
তাদের
অবস্থাইবা কি হবে? দেশের
বড় দল দু’টো কি
কখনো তা ভেবে দেখেছ বা দেখছে?
কথায়
কথায় আমাদের নেতারা বলে থাকেন,
দলের
চেয়ে দেশ বড়। একথা যদি তারা অন্তর দিয়ে বলে থাকেন, তাহলে দেশের সার্বিক ক্ষতি
সাধন করে কোন্ গণতন্ত্র বাস্তবায়ন করতে চান, তা সাধারণ মানুষ বোঝে না, বুঝতে চায় না। জনগণ
চায় শান্তি পূর্ণভাবে বাঁচতে,
নিরাপদে
পথে চলতে, স্বল্পমূল্যে
দু’টো শাক-ভাত
(ডাল এখন এতটা দামী যে ডাল-ভাত বলতে সাহস হয়না) খেয়ে বেঁচে থাকতে।
ইতোমধ্যে ব্যববসায়ীরা নড়েচড়ে বসেছেন। আমরা দাবী করছি ব্যবসায়ীরা দুই প্রধান
দলের নেতৃবৃন্দকে এক টেবিলে এনে দেশকে সার্বিক ক্ষতির হাত থেকে উদ্ধারের জন্য
প্রাণান্ত প্রচেষ্টা নেবেন। সপ্তাহজুড়ে
হরতাল করে আর যাই হোক দেশের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়, রাজনৈতিক নেতারা না বুঝলেও ব্যবসায়ী নেতা তা বুঝতে সক্ষম হবেন, এটা আমরা প্রত্যাশা করি। আমরা ইতোমথ্যে শিক্ষা-ব্যবসাসহ যতসব
ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি,
সেগুলো
পুষিয়ে নিয়ে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে যাতে টিকে থাকতে পারি, সেদিকে রাজনৈতিক নেতারাও
মনযোগী হবেন এটাই কাম্য। নয়তো
আগামীতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে দারুন এক ভয়াবহ সময়। দেশবাসী এমন সঙ্কট আর দেখতে চায় না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন