শুক্রবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৩

বরেন্দ্র ও প্রাগজ্যোতিষপুরের তেতুলিয়া - প্রথম পর্ব

নুরুল্লাহ মাসুম

প্রথম পর্ব

২৩ অক্টোবর রাত পৌনে এগারোটায় কমলাপুর থেকে রেলযাত্রা শুরু হওয়ার কথা। আমরা সকলেই ১০টার আগেই স্টেশনে হাজির, রেলগাড়ির দেখা নেই। গভীর রাতে, সোয়া ১২টায় ট্রেন এলো, ঘড়ির কাটা বলছে তখন ২৪ তারিখ শুরু হয়ে গেছে। যাত্রা শুরু হতে হতে সাড়ে ১২টা পেরিয়ে গেল। ট্রেন যাত্রা শুরু করলো গন্তব্যে- ঠাকুরগাঁর উদ্দেশ্যে।

টেকনাথ থেকে তেতুলিয়া- এভাবেই আমাদের প্রিয় দেশটার আদ্যপান্ত বর্ণনা দেয়া হয়ে থাকে। দেশের সর্ব দক্ষিণের মূল ভূখন্ডটি টেকনাফ উপজেলাধীন এবং সর্বউত্তরের ভূখন্ডটি তেতুলিয়া উপজেলাধীন- তাই এমনি করে বর্ণিত হয়ে থাকে বলেই আমার ধারণা। আমি টেকনাফের সর্বশেষ ভূখন্ড শাহপরীর দ্বীপ ভ্রমণ করলেও উত্তরের সর্বশেষ সীমানা তেতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা ভ্রমণ করা হয়নি। কাছাকাছি ঠাকুরগাঁ গিয়েছি কয়েকবার। এবার তেতুলিয়া ভ্রমণের সুযোগটা নিলাম; যখন কাব্যলোকের কবি জেবুননেসা হেলেন বলেলন, চলেন তেতুলিয়া ঘুরে আসি। যাওয়ার কথা ছিল জুন মাসে ঈদের পরে। রেলের টিকিট না পাওয়ায় এতদীর্ঘ পথে বাসযাত্রার ঝুঁকি নেয়া হয়নি তখন। সে সময়ে আমরা অবশ্য জনাদশেক মিলে নড়াইল, খুলনা, যশোর ও বাগেরহাট ঘুরে এসেছিলাম।

ঠিক হলো ২৩ অক্টোবর রাতে ট্রেনে যাত্রা করবো। এবারে আমরা মোট ছয়জন ভ্রমণকারী একত্রিত হলাম। আমি ছাড়া বাকী পাঁচজন হলেন- জেবুননেসা হেলেন, বিলকিস আক্তার, শেখ ইকরা তাইয়্যেবা, মুসরাত জাহান এবং আলী মোহাম্মদ মোহসিন। এছাড়া মুসরাত ও মোহসিন দম্পতির তিন বছরের কন্যা সারাহমণি ছিলো দলের সর্বকণিষ্ঠ সদস্য। এর আগেও সারাহমণি আমার সাথে ভ্রমণসঙ্গী ছিলো গত জুন মাসে। অনেক কসরত করে ট্রেনের টিকিট করা হলো অন-লাইনে। যাদের অন-লাইনে টিকিট কাটার অভিজ্ঞতা রয়েছ তারা বুঝতে পারবেন বিষয়টা।

তো, ট্রন চলছে। সামনে পেছনের তিনটি করে মোট ছয়টি আসন আমাদের। হেলেদুলে রাজসিক ভঙ্গিতে এগিয়ে চলছে আমাদের পঞ্চগড় এক্সপ্রেস নামের আন্তনগর ট্রেনটি। আমার আগের অভিজ্ঞতা বলছে নির্ধারিত সময়ে অর্থাৎ সকাল পৌনে-আটটায় এটি ঠাকুরগাঁ পৌঁছাতে পারবে না। আমাদের রেলমন্ত্রীর বাড়ি পঞ্চগড় জেলায়, তারই উদ্যোগে এই ট্রেনটি চালু হলেও, আমার মনে হয় পশ্চিমাঞ্চলের সবথেকে অবহেলিত ট্রেন এটি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্নিগ্ধা কোচের আসনগুলো মোটেই দূরপাল্লার যাত্রার জন্য উপযোগী নয়। এর থেকে পুরানো ট্রেনগুলোর আসনগুলো অনেক ভালো। পথে অন্য ট্রেনকে পথ করে দিতে দিতে আমরা এগিয়ে চলছি। ফলে সকাল হওয়ার আগেই আমরা দুই ঘন্টা পিছিয়ে গেলাম গন্তব্যে পৌঁছানোর সময় ধরে রাখতে। রাতে যে যার মতো খেয় আসলেও রাত দুটোর দিকে ট্রেনে আমাদের খাবার খেতে হলো একারণে যে, কখন, কোন স্টেশনে সকাল হবে আর খাবার পাবো তার কোন ঠিক নেই। ভোরে আমরা পার্বতীপুর জংশনে এসে রুটি, কেক জাতীয় খাবার দিয়ে অতি ভোরের নাশতা করে নিলাম। অবশ্য রাতভর ট্রেনে চা-কফির সরবরাহ ছিল প্রয়োজন মতো।

সকাল পৌঁনে-আটটার গাড়ি সকাল সাড়ে দশটায় ঠাকুরগাঁ স্টেশনে থামলো। আমরা তড়িঘড়ি করে নেমে গেলাম, এখানে ট্রেনের যাত্রা-বিরতী মাত্র তিন মিনিটের জন্য।


স্টেশনে নেমেই হেলেন বললেন, এবার আমার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে, টেকনাফ দেখেছি; তেতুলিয়া দেখবো। একই কথা আমারও বটে, তবে বলা হয়নি। ক্ষাণিকটা সময় অপেক্ষ করতে হলো মহিউদ্দীন ভাইয়ের জন্য। তিনি আগামী দুই দিনের জন্য ভাড়া করা মাইক্রোবাস নিয়ে স্টেশনের দিকে আসছেন। এরই মধ্যে ফটো সেশনের কাজ চলছে ক্রমাগত- একক ও দলগতভাবে। বাতাসে আর্দ্রতা কম, হেমন্তের সকালে শীতের আভাসও মিলছে। যাত্রার আগে সকলকেই গরম কাপড় সাথে নেয়া জন্য বলে দেয়া হয়েছিল। বাংলার উত্তরপ্রান্তে শীত নামছে ধীরে ধীরে।


মহিউদ্দীন ভাই, পুরো নাম আবু মহিউদ্দীন। আমার পাঠকরা তার নাম আগেই শুনেছেন আমার অন্য লেখাতে। অবসরপ্রাপ্ত জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা। চাকুরী জীবনের বেশীরভাগ সময় কাটিয়েছেন উত্তর বাংলায়। শেষের দিকে একই সাথে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁ ও পঞ্চগড় জেলার দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে তিনি উদীচী, নিরাপদ সড়ক চাই-সহ নানান সামাজিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত। তিনি বাংলাদেশ স্কাউটসের একজন দক্ষ লিডর ট্রেনার, মূলত স্কাউটিং-এর সূক্ত্র ধরেই তার সাথে আমার পরিচয়। তিনি কাব্যলোকের অনুষ্ঠানেও যোগদান করেছেন।

তিনি এলেন এবং মাইক্রোবাসে করে সরাসরি নিয়ে গেলেন শহরের খুব পরিচিত একটা রেস্টুরেন্টে- নাম কামালস কিচেন। সেখানে আমাদের সকালের নাশতা হলো বেলা ১১টায়। পরে আমাদের আবাসস্থল হিসেব আগে থেকেই বুকিং দেয়া ঠাকুরগাঁ ডাকবাংলোয় গেলাম। স্ব-স্ব কক্ষে অবস্থান নিয় খুব দ্রুত তৈরি হওয়ার জন্য বলা হলো সকলকে। কম সময়ে আমাদের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে হবে। এমনিতেই প্রায় তিন ঘন্টা বিলম্বে পৌঁছেছি আমারা- তাই আগে থেকে তৈরি করা ভ্রমণসূচিতে কিছুটা পরিবর্তন আনা হলো। এমনটি সবসময়েই হয়ে থাকে কম-বেশী। গত জুন মাসের ভ্রমণে তো আমাদের দুটো দর্শনীয় স্থান বাদ দিতে হয়েছিল রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের যাতায় পড়ে বিলম্বে যশোর পৌঁছানোর কারণে। কষ্ট হলেও সকলকে তা মেনে নিতে হয়েছিলো। এবারও হয়তো এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তবু চেষ্টা থাকবে প্রধান প্রধান গন্তব্যগুলো যাতে বাদ না পড়ে।

চলবে

কোন মন্তব্য নেই: