নদী সমুদ্র আকাশ
নুরুল্লাহ মাসুম
উত্তাল তরঙ্গ আছড়ে পরছে সাগরতটে। বঙ্গপোসাগরের বেলে মাটিযুক্ত সৈকতে
আছড়ে পরা ঢেউগুলো বালির সাথে লুকোচুরি খেলে ফিরে যাচ্ছে সাগরের অথৈ বুকে। মাঝখানে ঢেউয়ের মাথার ফুটে থাকা
ফুলগুলোর শ্বেতশুভ্র অসাধারণ সৌন্দর্য সমুদ্রের চোখ জুড়িয়ে দেয়।
সাগর তীরে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো অসংখ্য
পাথরের একটার ওপর বসে আছে সমুদ্র,
দক্ষিণ
বাংলার সন্তান হয়েও সাগর পাড়ে বেড়ানো অভিজ্ঞতা তার বেশি দিনের নয়। যে কারণেই বারে বারে সৈকতে আছড়ে পরা
ঢেউগুলো দেখতে তার ভালো লাগে। মন্ত্রমুগ্ধের
মতো তাকিয়ে থাকে সে ঢেউগুলোর দিকে। ঢেউগুলোর
উৎস কোথায় জানে না সমুদ্র। তবে
সাগরের বুকে সৃষ্ট ঢেউগুলোর সাতে নিজর একটা মিল খুঁজে পায় সে। জীবনের নানান চরাই-উৎরাই এবং সাগরের
ঢেউগুলোর সৈকতে আছড়ে পরা,
আবারো
সাগরের ফিরে যাওয়ার মধ্যে দারুণ একটা যোগসূত্র আবিষ্কার করে সে। এতে করে মনটা আরও বেশি উদাস হয়ে যায়।
সূর্য পশ্চিমাকাশের শেষ প্রান্তে চলে
এসেছে। লক্ষ-লক্ষ সূর্য
যেন সাগরের বুকে লুকোচুরি খেলছে। সূর্য
যত নিচে নামছে, সাগরের
মাঝে ততবেশি সূর্য বেড়ে যাচ্ছে। প্রশান্ত
মহাসাগরের বুকে এ দৃশ্য আরও বেশি লোভনীয় হতো বলে তার মনে হয়। সেখানে পানি আরও বেশি স্বচ্ছ। শ্যাম উপসাগরের পানিও স্বচ্ছ। এখানে পানি ঘোলা বলে দৃশ্যটা তার কাছে
কিছুটা হলেও ম্রিয়মাণ।
উঠে দাঁড়ায় সমুদ্র। সৈকতে লোকের ভিড় বেড়েছে। ঘণ্টাখানেক আগেও খুব কম সংখ্যক
দর্শনার্থী ছিল, এখন
কয়েকগুণ বেশি। ভিড়টা তার ভালো লাগে না।
একাকী হাঁটতে থাকে সমুদ্র, উত্তর দিকে। ও দিকটায় মানুষের ভিড় কম। দর্শনার্থী ওদিকটায় কম বলে পাথরের
সংখ্যা যেমন বেশি, তেমনি
পাথরগুলো ময়লাও বেশি।
আরও সামনে আগায় সে; আরওথ আরও।
এদিকটায় গাছ-গাছালির সংখ্যা বেশি। কিছুটা অন্ধকারও বটে। আর এগুতে সাহস হয় না। নির্জনতা বেশ পছন্দ তার। তাই বলে নিরাপত্তার দিকটাও তাকে ভাবতে
হয়। অন্তত একজন সাথী থাকলে আরও একটু এগুনো
যেত। একটা গাছের পাশে দাঁড়ায় সমুদ্র। সূর্য তখন দিগন্তের একেবারে শেষ সীমানায়। অপূর্ব এক দৃশ্য। লক্ষ-কোটি সূর্য যেন সাগরের পানির মধ্যে জোটবদ্ধ হয়ে বিশাল লম্বাটে
এক আকার ধারণ করেছে। দমবন্ধ
করে অপরূপ প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
- কি চমৎকার! তাই না?
বা দিকে তাকায় সমুদ্র। সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়
- অপূর্ব!!
ক্ষাণিকটা সময় কেটে যায়। সমুদ্র তখনো দিগন্তের দিকে পলকহীন
দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
আগন্তুকও চুপ করে দাঁড়িয়ে।
সূর্য সাগরের পানির নিচে হারিয়ে গেছে। আকাশ এবং সাগরের পানিতে তখনো তার আভা
লেগে আছে। আগন্তুক আবারো বলে
- জায়গাটা নিরাপদ নয়; ও দিকটায় যাই, চলুন।
- চলুন।
বলে সমুদ্র হাঁটতে আরম্ভ করে।
- আমি নদী। পাহাড় তলী থাকি।
ক্ষাণিক বাদে সমুদ্র বলে
- বেশ নামতো আপনার। আমি সমুদ্র। গতকালই চট্টগ্রাম এসেছি।
পাশাপাশি হাঁটতে থাকে ওরা।
পুরো সৈকত জুড়ে তখন আধাঁর নেমে এসেছে।
নদী আর সমুদ্রের জানা-শোনার তিন মাস। নদী চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে থাকলেও
আদিতে ওরা চন্দ্রদ্বীপের বাসিন্দা। বাবা
বড় ব্যবসায়ী। ওদিকে সমুদ্র ঢাকার বাসিন্দা হলেও আদিবাস
খলিফাতাবাদ। পরে এক পুরুষ চন্দ্রদ্বীপে। নিজেদের পূর্ব পুরুষদের মধ্যে একটা মিল
যেমন ওরা খুঁজে পায়, তেমনি
ওদের নামের মিলটাও চমৎকার। নদী পথ
চলতে চলতে সমুদ্রে তার শেষ গন্তব্য। এটা স্বভাবিক
নিয়ম। এক্ষেত্রেও তাই হয়। তিন মাসেই নদী আর সমুদ্র তেমনি গন্তব্যে
পৌঁছে যায়। যদিও গতি উল্টো।
সমুদ্রকেই আসতে হয় নদীর কাছে বারংবার।
তিন মাসে সমুদ্র কম করে হলেও নদীর কাছে
পাঁচ বার এসেছে। প্রতিবারেই ওরা ওদের প্রথম সাক্ষাতের
সেই গাছটার কাছে এসে বসে;
নিরবে
সময় কাটায়। সাগরের বুকে সূর্যের হারিয়ে যাওয়ায়
দৃশ্য নয়ন ভরে অবলোকন করে। সময়ান্তে
সমুদ্র ফিরে যায় ঢাকায়।
বর্ষাকাল। সাগরের বুক ভরা জল। ভরা যৌবনা কর্ণফুলি, বুক উজার করা ভালোবাসার
ডালি সাগরের বুকে ফেলে দেয়। সাগরের
বুকের সে ভালোবাসা উত্তাল তরঙ্গের আকারে আছড়ে পরে সৈকতে। মেঘলা আকাশের এমন এক দিনে সমুদ্র আর নদী
কাছাকাছি; সৈকতের
সেই গাছ তলায়।
- কেমন লাগছে? জানতে চায় নদী।
- মন্দ নয়। জবাব সমুদ্রের ।
- কেমন? আবারো জানতে চায় নদী।
- ভরা ভাদরের আনন্দ বেদনার মতো। উত্তর সমুদ্রের।
- এর পর দু'জনেই উদাস।
সন্ধ্যার মৃদু-মন্দ বাতাস হঠাৎ করেই গতি
পায়। গাছের পাতায় ঝিরি-ঝিরি শব্দ। প্রকৃতি যেন প্রাণ ফিরে পায়।
নদী আর সমুদ্রের মধ্যে আসে জীবনের
মাদতকতা।
হঠাৎ করেই ওদের জীবনের গতির পরিবর্তন
হয়। তখনই ওরা ছক করে ফেলে সিলেট যাবে
বেড়াতে; সম্ভব
হলে পরদিনই।
হোটেলে ফিরে ঢাকায় ফোন করে সমুদ্র। বাড়িতে জানায় ফিরতে দেরি হবে। তখন তার চোখের সামনে জাফলং আর তামাবিলের
অপরূপ প্রকৃতি। চট্টগ্রামের বিপরীত এক দৃশ্য।
ওদিকে নদীর বাড়িতে ভিন্ন দৃশ্য। পরদিনই সিলেট যাবার মতো ছক সে তৈরি করতে
পারে নি। তাইতো ফোনে সমুদ্রেকে জানায়, আরো একদিন সময় লাগবে। ফোনটা পেয়ে সমুদ্র ভাবে, ভরা ভাদরের আনন্দ বেদনার
কাব্য এমনিই হয়।
দু'দিন বাদে রাত দশটার ট্রেনে ওরা রওয়ানা হয় সিলেটে। প্রথম শ্রেণীর বার্থ। রাতটা ঘুমিয়ে কাটাবার কথা, বাস্তবে তা হয় না। সারা রাত ওদের কাটে না ঘুমিয়ে, হাজারও কথার মালা গাঁথতে
গাঁথতে। দু'টো ভিন্ন জগতের মানুষ। একাকার
হয়ে যায় ওরা – অন্তত
কথার মালায়। যেন কত জনমের জানা শোনা ওদের। হঠাৎ করেই সমুদ্র জানতে চায়।
- তোমার ভয় করছে না?
- কিসের ভয়?
- আমাকে?
- কেন?
- আমিতো পুরুষ।
- তাতে কি?
- যদি অশুর ভর করে?
- তা করবে না।
- কি করে বুঝলে?
- বুঝতে পারি।
- কিভাবে?
- এমনিই।
এমনি নানান কথার মাঝে ওদের রাতটা পার
হয়ে যায়। শেষ রাতে শ্রীমঙ্গলে এসে দু'জনেই সিদ্ধান্ত নেয়
এখানেই নেমে যাবে, সিলেট
যাওয়া হবে না। ট্রেন থেকে নামার আগে দু'জনার মধ্যে একটা অলিখিত
চুক্তি হয়। সে মতেই ওরা পথ চলবে।
রাতের বাকি সময়টা ওরা স্টেশনের চায়ের
দোকানে কাটিয়ে দেয়। ভোরের
আলো ফুটলে রিক্সায় চা বাগানে। চট্টগ্রাম
থাকতেই বাগানের রেস্ট হাউসের থাকার ব্যবস্থা করেছিল সমুদ্র। বাগানের ফটকে পোঁছতেই ছোকরা গোছের একজন
ওদের অভ্যর্থনা জানায়। পরে
ওরা জেনেছিল ছেলেটি বাগানের সুপারভাইজার।
বেলা আটটা নাগাদ ম্যানেজার হুমায়ূন
কবীর ওদের সাথে দেখা করে। তার
প্রথম প্রশ্ন
- সমুদ্র, তুমি বিয়েটা করলে কবে?
সমুদ্র তার কথায় সঠিক কোন উত্তর না
দিয়ে বলে
- আপনার সৌজন্যে বৌ-ভাতটা এখানেই আয়োজন
করবো।
সমুদ্র তার কথা রেখেছিল। চা বাগানের কর্তাগোছের লোকদের সম্মানে
দু'দিন
বাদেই আয়োজন করেছিল ডিনার পার্টির।
সকলের নাম আর আজ মনে নেই নদীর। তবে কাশেম, ইমরান, এমদাদ আর মতিউরের কথা আজও
তার মনে আছে।
দিন সাতেক ছিল ওরা ওখানে। কাশেম আর মতিউর সব থেকে বেশি সময়
দিয়েছিল ওদের। বাগানে ঘুরিয়ে দেখানো। কুলিদের বস্তিতে নাচ – গানের আসরে নিয়ে যাওয়া
আর কমলা বাগান ঘুরিয়ে দেখানো,
সবই
করেছিল ওরা। কাশেমের কথা আজও মনে পড়ে নদীর, কি আন্তরিকভাবেই না নদীকে
সে 'ভাবী' বলে ডেকেছিল।
সেই সাত দিনের কথা নদী আজও ভুলতে পারে
নি। কোন দিন ভুলতেও পারবে না সে। চা বাগানের ভেতরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা
হেঁটেছিল ওরা দু'জন। না, কোন ক্লান্তি আসেনি সে দিন ওদের। অথচ আজ অল্পতেই ক্লান্তিতে কাতর হয়ে
ওঠে নদী, আগের
মতো মনযোগ দিতে পারে না কোন কাজে। সাত
দিনের কোন সময়ই সমুদ্র কোন প্রকার অসহনীয় দাবী করেনি। অভিমান করে নদীও এক রাতে জানতে চায়
- কেন আমার এখানে এসেছি?
- বেড়াতে।
- শুধুই বেড়াতে?
- তা নয় তো কি?
- ওরা আমায় ভাবী ডাকে।
- তাতো ডাকবেই।
- তাহলে আমরা দূরে কেন?
- কই, যথেষ্ট কাছেই তো আছি।
- হাঁ, যা, এক
ছাদের নিচে, তবে
বহু দূরে।
সমুদ্র বোঝে নদীর কথা। তবে যথেষ্ট সাবধানী সে। গম্ভীর ¯^রে বলে
- বিপদে ডাকতে যাও?
- কিসের বিপদ?
- সামাজিক।
- যা হবার হবে, আমি সামলাবো।
এরপর ওদের ব্যবধান কমে। নদীর জল যে ভাবে সাগরে মেশে, সাগর যেমন নদীর জল নিজ
বুকে ধারণ করে, তেমনি
এক বাধাহীন স্রোতে মিশে যায় নদী আর সমুদ্র। পৃথিবীর
তাবৎ বাধা দূর করে ওরা একাকার হয়ে যায়। কাশেম
আর মতিউরের 'ভাবী' ডাক সার্থকতা লাভ করে।
মাস খানেক পর নদী আর সমুদ্র সিদ্ধান্ত
নেয়-ওরা বিয়ে করবে। এর
আগেই ওরা ঠিক করে অনাগত অতিথির নাম হবে আকাশ। নদী জানতে চায়।
- নামটা আকাশ হবে কেন?
- নদী সাগরে মেশে, আর সাগর আকাশে বিলীন হয়, তাই।
- যদি মেয়ে হয়?
- না ছেলেই হবে।
- যদি হয়?
- হোক, নামটা আকাশই হবে।
নির্ধারিত দিনে সমুদ্র ঢাকা থেকে
চট্টগ্রামে আসেনি। ঢাকা
থেকে আসা সবগুলো ট্রেন চেক করা হয়। সমুদ্র
কোনটাতেই আসেনি। ঢাকায় ফোন করা হয়। ঢাকা থেকে জানান হয় সমুদ্র চট্টগ্রাম
গেছে।
কিছুদিন বাদে পত্রিকা আর টিভিতে
সমুদ্রের নিখোঁজ সংবাদ ছাপান হয়। সমুদ্রের
হদিস আর মেলেনি।
সামাজিক অপবাদ মাথায় নিয়েও নদী আকাশের
জন্ম দেয়। সমাজ থেকে পালায় সে। আশ্রয় নেয় ভানুগাছ গ্রামে। কাশেম আর মতিউর তাকে সহায়তা করে।
সেই ভানুগাছ, যেখান থেকে সমুদ্রের দেয়া
উপহার আকাশকে নিয়ে নদী ফিরে গিয়েছিল চট্টগ্রাম। অনাকৃতির আকাশ আজ আকৃতি পেয়েছে। বাস করছে মায়ের সাথে, সেই ভানুগাছ গ্রামে। আকাশ আছে, সমুদ্রের পরিচয়ে। নদী
আছে সমুদ্রের পরিচয়ে; নেই
কেবল সমুদ্র।
আকাশ আর নদীর থেকে সমুদ্র আজ বহুদূরে। দিগন্তের ওপারে ঠিকানা বিহীন কোন
জায়গায়। নদী আজও সমুদ্রের অপেক্ষায়, তাকিয়ে সামনের দিকে নয়; আকাশ পানে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন